পারিবারিক বদান্যতা
অশোক কুমার হালদার
রমেন দাস এর বাড়ি শহর থেকে কিছুটা দূরে হলেও, শহরের নিকটেই বলা যায় কোন পাড়া গ্রামে নয়। একসময় রমেন দাস শহরে সরকারি অফিসে চাকরি করতেন। এখন চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। রমেন দাসের এখন বয়স হয়েছে। আর উনার পরিবারটি বড়ো। পরিবারে স্ত্রী রয়েছেন নমিতা দাস। রমেন দাসের পরিবারটি বেশ বড়োসড়। কারণ রমেন দাসের চার পুত্র সকলেরই বিয়ে হয়ে গেছে। বর্তমানে পরিবারে সদস্য সংখ্যা বারো জন। বড় পুত্র মঙ্গল দাস স্ত্রী হেনা দাস। দ্বিতীয় পুত্র রবি দাস স্ত্রী সবিতা দাস। তৃতীয় পুত্র চিত্ত দাস স্ত্রী করুণা দাস। চতুর্থ পুত্র সোম দাস স্ত্রী কল্পনা দাস। রমেন দাসের স্ত্রী, নমিতা দাসের মনে একটা আক্ষেপ ছিল যে তাদের সংসারে কোন কন্যা সন্তান ছিল না। কন্যা সন্তান না থাকলে সংসারে পূর্ণতা আসে না। তবে হ্যাঁ রমেন দাসের ছেলেদের মধ্যে অর্থাৎ ভাইদের মধ্যে রক্তের বন্ধন অটুট অর্থাৎ সহৃদয়তা, ভাইদের মধ্যে মধুর সম্পর্ক এবং সদয়ভাব রয়েছে। মঙ্গল দাস বড়ো, ছোটোবেলা থেকেই পড়াশোনায় খুব ভাল ছিল। বর্তমানে সে শহরের একজন নামকরা চিকিৎসক। বর্তমানে পেশার তাগিদে শহরেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। ডাক্তারবাবুর একটি কন্যা সন্তান রয়েছে তার নাম শান্তি। কিন্তু তার মা হেনা এবং ডাক্তারবাবুর মা তার নাতনীকে আদর করে এবং ভালোবেসে নাম রেখেছে শানু। ডাক্তারবাবুর সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কোন অবসর নেই। একদিকে হাসপাতালের সরকারি সেবাদান রোগীদের করতে হয় এবং অন্যদিকে বেসরকারি চিকিৎসালয় রয়েছে। সেখানেও রোগীদের সেবা করতে হয়। ডাক্তারবাবুর জীবন ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে ছন্দ তাল রেখে চলতে হয়। এইটা তার প্রতিদিনের কর্তব্য কার্যের ধারা বা নিত্য কর্ম। কিছু কিছু মানুষ আমাদের এই সংসারে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কর্তব্য করে যান। কিন্তু তবুও মা বাবা ভাইদের প্রতি সহৃদয়তা এবং বদান্যতা রয়েছে। অর্থাৎ নিত্যদিনের নানান কাজের ভেতরে থেকেও পিতা, মাতা, ভাই, বন্ধু এবং আত্মীয় পরিজনদের প্রতি পারিবারিক বদান্যতা রয়েছে। হেনা দেবী ডাক্তার বাবুর স্ত্রী মাঝে মাঝে তার স্বামীকে বলেন যে তোমার ভাই এবং বাবা ও মা সকলেই তো বেশ স্বছন্দের মধ্যে জীবন কাটাচ্ছেন তবুও তোমার পরিবারের প্রতি বদান্যতা কেন? উত্তরে ডাক্তার বাবু মঙ্গল দাস বলেন যে ভালোবাসা এবং রক্তের অটুট টানই হচ্ছে এই বদান্যতার কারণ। রমেন বাবুর দ্বিতীয় পুত্র রবি দাস রেলওয়ে অফিসে কেরানিকের কাজ করেন জলপাইগুড়িতে।
সেখানে বর্তমানে স্ত্রী সবিতা দাস এবং পুত্র অনিকেত রেলওয়ে কোয়ার্টারে থাকে। বছরে একবার হয়তো পূজার ছুটিতে দেশের বাড়িতে আসে। রমেন দাসের তৃতীয় পুত্র চিত্ত দাস তার পরিবার নিয়ে শিলিগুড়িতে থাকে। স্ত্রী করুণা দাস তাদের বর্তমানে কোন সন্তান হয়নি। চিত্ত বাবু একটা অফিসে শিলিগুড়িতে চাকুরিরত রয়েছেন। কেবলমাত্র ছোটো ছেলে সোম দাস সেই পিতা-মাতা ও স্ত্রী কল্পনা দাসকে নিয়ে বাবা মায়ের সঙ্গে বাস্তু ভিটেই বসবাস করেন। পরিবার বড়ো হলেই সংসারে বিভিন্ন রকম সমস্যা পরিবারে থাকবেই। সেখানে থাকে ক্লান্তি, শ্রম এবং বার্ধক্য জনিত অবসন্নতা। নমিতা দাস তার স্বামী রমেন দাসকে একদিন বলছেন যে আমাদের দুজনেরই বয়স হয়েছে। তবুও আমাকে এখন রান্না ঘরের উনান সামলাতে হয়। কারণ বাহিরের লোক দিয়ে রান্নাবান্না আমার পছন্দ নয়। আর আমাদের ছেলেরাও কাজের লোকের হাতে রান্না খুব একটা পছন্দ করে না। আর ছেলেদের বিয়ে হওয়ার পরে বৌমা বাড়িতে এলো বটে এবং সংসারে বা আমাদের পরিবারে সদস্য সংখ্যা বাড়লো কিন্তু পরিবারের কাজ তো কমলো না বরং বেড়ে গেল। আর এখন যে কাজের মেয়েটা রয়েছে সে কোন দিন কাজে আসে আবার কোন দিন কাজে আসে না। হয়তো দেখা গেল যে দিনটা আমার শরীরটা একটু খারাপ সেই দিনটাতে সে কাজে এলো না। তখন তো আমি হাত পা গুটিয়ে ঘরে শুয়ে থাকতে পারি না। রান্না না করলে উপবাস করতে হবে। আর ছোটো বৌমা প্রায়ই বাপের বাড়ি চলে যায়। সেই সময় স্বামী রমেন দাস বলছেন যে হ্যাঁ সংযোজন অর্থাৎ সদস্য সংখ্যা আমাদের সংসারে বেড়েছে ছেলেদের বিয়ে দেওয়ার পরে কিন্তু বৌমাদের সেইরূপভাবে সংসারের প্রতি শাশুড়ির সঙ্গে কর্ম সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়নি। অর্থাৎ সেরূপভাবে পারিবারিক বদান্যতা কোন বৌমার ভেতরে সঞ্চার হয়নি। অর্থাৎ সমন্ধেয়র একটা অভাব থেকেই গেছে। আমি আমার এই বৃদ্ধ অবস্থায় উপলদ্ধি করলাম যে সংসারিক ক্ষেত্রটা বড় গভীর এবং জটিল। এই পরিবারের মধ্যে অংশীদার আছে কিন্তু আন্তরিক ভাবে সহযোগিতা করার সদস্য সংখ্যা খুব কম। এইবার রমেন বাবু তার স্ত্রীকে বলছেন যে আমাদের যথেষ্ট বয়স হয়েছে। তাই ভাবছি এইবার পূজার ভেতর সব ছেলে এবং বৌমারা যখন একত্রিত হবে, তখন আমাদের যা কিছু বিষয় সম্পত্তি সেগুলো ছেলেদের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে দেব। এই কথা শুনে স্ত্রী নমিতা দেবী বলছেন যে ছেলে বৌমাদের উপর আস্থা স্থাপন বা নির্ভরশীল হওয়া বোধহয় ঠিক হবে না। কারণ পারিবারিক বদান্যতা কোন ছেলে বৌমার থাকবে কী থাকবে না, সেটা তো আগে থেকে বোঝা যায় না। যদিও আমাদের এই বয়সটা অধীনতার বয়স, তবুও গচ্ছিত বস্তু বা আমাগত এই মুহুর্তে সকলের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে দেওয়া বাঞ্ছনীয় হবে কী? তাছাড়া ছেলেরা সবাই তো উপযুক্তভাবে কাজকর্ম করেই নিজ নিজ সংসার পরিচালনা করছে। শুধু ছোটো ছেলেটা আমাদের সঙ্গে বাড়িতেই রয়েছে। সে এখনও নিজেকে স্বতন্ত্র করে গড়ে তুলতে পারেনি। ছোট বৌমা বাপের বাড়ি চলে গেলে ছোটো ছেলেটাও বৌমার সঙ্গে যায়। তখন আমাদের বুড়ো বুড়ীদের সংসারের সবকিছু দেখভাল করে চলতে হয়। আর বড়ো ছেলেটার সংসার দেখভালের ইচ্ছা রয়েছে মনে, কিন্তু তার উপর এত কাজের চাপ নিত্যদিনের যার ফলে ছেলেটা একটুও আরাম পায় না। পারিবারিক বদান্যতা থাকলেও কর্ম জীবনে দায়িত্বের কারণে পারিবারিক বদান্যতা শিথিল হয়ে যায়। এটা বড়ো ছেলের মনের কোন সহানুভূতিহীন বা বিপরীত ভাব নয়।
স্বামীর সঙ্গে এইরূপ কথাবার্তা চলাকালীন বড়ো বৌমা আর শানু বাড়িতে প্রবেশ করলো। ঠাকুমা তার নাতনীকে দেখে বলছে কীরে, আমাদের কথা মনে পড়েছে বুঝি? শানু বলছে ঠাকুমা আমার জন্মদিন আগামীকাল, তোমরা যাবে। হ্যাঁ নিশ্চয় যাব। কিন্তু তুই তো তোর মাকে নিয়ে মাঝে মাঝে এ বাড়িতে আসতে পারিস? এবার বড়ো ছেলের বৌ হেনা তার শাশুরি মাতাকে বলছেন মা শানুর স্কুল প্রাইভেট পড়া, স্কুলের পড়া নিয়ে সারাটা দিন কেটে যায়। একটুও সময় পাওয়া যায় না। এইবার শান্তির ঠাকুমা বলছেন হ্যাঁরে শানু বড়ো হয়ে তুই কী তোর বাবার মতো ডাক্তার হবি? তোর বাবার ভীষণ কাজ রোগী দেখা হাসপাতালে যাওয়া আবার হাসপাতল থেকে বাড়ি ফিরে আবার রোগী দেখা শুরু করে দেয়। তোদের বাড়িতে আমি গেলে তোর মায়ের সঙ্গে একটু কথাবার্তা বলি। তোর এবং তোর বাবার সময় নেই কথা বলার কিন্তু ইচ্ছা আছে। রমেন বাবু বলছে এরে শান্তি কেমন আছো দিদিভাই। দাদু আমার কাল জন্মদিন উৎসব পালন হবে তোমার সকলে যাবে? ছোটো কাকা এবং কাকিমা কোথায়? তাদের তো দেখতে পাচ্ছি না? তোমার কাকা এবং কাকিমা তোমার আর এক দাদুর বাড়িতে গিয়েছে? হয়তো আগামীকাল সকালে এসে যাবে। আর এলেই তোমার দিদা, ছোটো কাকা এবং ছোটো কাকিমা তোমার জন্মদিনের উৎসবে তোমার বাড়িতে যাবে। আর শোনো দিদিভাই এটাই তোমাদের বাড়ি। তুমি এলে আমাদের সবার খুব ভালো লাগে এবং আনন্দ হয়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct