রেবাউল মন্ডল, থানারপাড়া: কতজনের আর মনে আছে সেই ক্লাস ফাইভের কথা। হাফ প্যান্টে পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুল যাবার কথা। কে এসেছে কে গিয়েছে কেই বা মনে রেখেছে নাম গুলি। ক্লাস ফোরের সেই বান্ধবীটাই বা কোথায়। ব্যস্ত জীবন কখনো কি খোঁজ রাখে শৈশবের সেই সহপাঠীদের কথা? একজন এমএ পাশ করার পর তার জীবনে কয়েক হাজার বন্ধু বান্ধবীর হাতছানি হয়। জীবনের সেই গতিপথে অনেককেই আর চেনা যায়না। সময়ের স্রোতে ভুলে যাওয়া হয় তাদের। আর এই ভুলে না গেলে নাকি পৃথিবীর চাকা নাকি ঘোরে না!
হঠাৎই একদিন পুরাতনকে কিভাবে ফিরে পাওয়া যায় তা নিয়ে ভাবছিলেন নদিয়ার নতিডাঙা অমিয় স্মৃতি বিদ্যালয়ের প্রাক্তনী নজিবুর রহমান। পেশায় শিক্ষক নজিবুর কথায়, ভাবতে ভাবতেই আমার মনে এল বাল্য বন্ধুদের নিয়ে পিকনিকের কথা। ইতিমধ্যেই হাতে এসেছে সোশ্যাল মিডিয়া। নতুন করে বন্ধুত্বের শুরু হল। প্রথমে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট, তারপর ম্যাসেঞ্জারে চ্যাট। একে একে হোয়াটসআপ গ্রূপে যোগ দিল দ্বীপ, জামাল, তন্ময়, ফাহাদ্দেস, চেতন, মনিরুল, ওদুদ, প্রেমজিত, কাজেম, প্রসেনজিৎ, আজাদরা। কথা বলতে বলতেই সেই পুরাতন আবার ধরা দিল নতুন করে।
কিন্তু পুরাতন কি নতুন করে আবার ধরা দেয়! চেষ্টা করা হয় মাত্র। পিকনিক হল, গল্প হল, আড্ডা হল। অতীতের স্মৃতিচারণ করা হল। কিছু সময়ের জন্য ওদের মনটা ভেসে গেল সেই অতীতে। কিন্তু কেন এমন আয়োজন? সামসুল হক বলছিলেন, শুরুটা হয়েছিল ফেসবুক থেকে। সেখান থেকে এক এক করে সবার নম্বর নিয়ে খোলা হয় হোয়াটসআপ গ্রূপ। প্রথমদিন যেদিন আমি সকল বন্ধুদের একসাথে হোয়াটসআপ গ্রূপে পায় সেই রাতে তো আমার আর ঘুমই হয়নি। রাত দুটো বাজে। চ্যাটের পর চ্যাট। আনন্দে মনের আবেগ আর সামলাতে পারছিলাম না। তারপরই ঠিক করি আমরা একসাথে মিলিত হব। আর সেই জন্যই এই পিকনিকের আয়োজন করে একাত্ম হয়েছি আমরা।
পেশায় সৈনিক থানারপাড়ার তন্ময় ঘোষ বলছিলেন, হোয়াটসআপেই আমাদের আলোচনা হল। ফের আড্ডা দেওয়া হোক। ফিরে পাওয়া যায় কি অতীত চেষ্টা করা হোক। যেমন কথা তেমন কাজ। হয়ে গেল পিকনিক।
ওরা হারিয়েছে ক্লাসের ফার্স্ট বয় মেধাবী ইয়াসিন বিশ্বাসকে। বিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথম ২০০২ সালে মাধ্যমিকে স্টার নিয়ে আল-আমিন এ একাদশে ভর্তি হয়েছিল ইয়াসিন বিশ্বাস। কিন্তু পড়াশোনা আর শেষ হয়নি ওর। মস্তিষ্কে মেনিনজাইটিসের কারণে অকালে বিদায় নেয় বাল্যবন্ধু। এদিন পিকনিক শেষে সকল বন্ধু মিলে ছুটে যায় হারানো বন্ধুর বাড়ি। কিন্তু সেখানে নেই ইয়াসিন। ওরা দেখা করে ইয়াসিনের মা বাবার সাথে। ডুকরে কেঁদে উঠেন মা। আঁচলের কোনে চোখের জল মুছতে মুছতে মা বলে উঠলেন, ইয়াসিন আজ বেঁচে থাকলে তোমাদের মতোই বড় হত। চাকরি করতো। আমাদের এই দৈন্য দশা আর থাকত না। চোখ টলমল করে উঠে বন্ধুদেরও। সান্ত্বনা জানিয়ে মায়ের হাতে কিছু উপহারও তুলে দেয় তারা। শুধু তাই নয়, বন্ধুরা মিলে মাসিক একটা ভাতারও ব্যবস্থা করেছে ইয়াসিনের মা বাবার জন্য।
অতীত বন্ধুদের মহামিলনের এই ছবি কেউ কেউ পোস্ট করেছে সোশ্যাল মিডিয়াতেও। আর তা দেখে মুগ্ধ হয়ে তাদের বন্ধুত্বের বন্ধনের আরও মুজবুতি কামনা করে কমেন্ট করেছেন স্কুলের শিক্ষক থেকে এলাকার শিক্ষানুরাগীরাও।
তবে সেই পুরাতন বন্ধুরা আজ অনেক বড় হয়েছে। অনেকেই এখন বিবাহিত জীবনের পূর্ণ দায়িত্বশীল। বিভিন্ন পেশায় জড়িয়ে আছেন তারা। কেউ করেন শিক্ষকতা, কেউ দেশের বীর জওয়ান। কেউ ব্যবসায়ী কেউ বা দেশের অন্নদাতা। রয়েছে পূর্ণ ব্যস্ততা। কিন্তু হাজারও ঝামেলা মিটিয়ে বন্ধুত্বের মিলন মেলায় হাজির হয়েছে সকলেই। ওরা মিলিত হয়েছে সেই স্কুল মাঠে যেখানে ওদের বেড়ে উঠেছে শৈশব-কৈশোর। ফেলে আসা স্মৃতিগুলি ভেসে উঠছে একে একে। গল্পগুজব হইহুল্লোড় আর আড্ডা।
আড্ডার মাঝেই গিয়াসউদ্দিন আবেগ ভরা কণ্ঠে বলে উঠলেন, একদিনের এই অনাবিল আনন্দের কোন ভাগ হবে না। এভাবেই একদিন বার্ধক্যে পৌছাবো আমরা। কিন্তু ক্লাস সিক্সের সেই বান্ধবীটার কথা কি মনে আছে? যার সঙ্গে রোজ টিফিন কেড়ে খাওয়া নিয়ে আড্ডা হত! তার চেহারাটা এখন কেমন? কোথায় তার বিয়ে হয়েছে? এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই শেষ হল নতিডাঙা অমিয় স্মৃতি বিদ্যালয়ের প্রাক্তনীদের পিকনিক।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct