মালয়েশিয়ায় হঠাৎ করেই নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. নাজিব রাজাককে দুর্নীতির মামলায় জেলে পাঠানোর পর শাসক দল আমনুর পক্ষ থেকে তীব্র চাপ সৃষ্টি হয়েছে দ্রুত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য। তা না হলে আমনুর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল সাবরি ইয়াকুবকে বরখাস্ত করার হুমকিও দেয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বিরোধী পাকাতান হারাপান জোটের প্রধান আনোয়ার ইব্রাহিম নির্বাচনে যেতে প্রস্তুত বলে ঘোষণা করেছেন। এ নিয়ে লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ দ্বিতীয় কিস্তি।
মাহাথির আমনু থেকে পদত্যাগ করেন এবং শেষ পর্যন্ত পিকেআর প্রধান আনোয়ার ইব্রাহিমের সাথে বোঝাপড়ায় গিয়ে পাকাতান হারাপান নামে একটি বিরোধী ফ্রন্ট গঠন করেন। মাহাথিরের নবগঠিত দল বারসাতু বিরোধী জোটের অন্যতম প্রধান শরিক দল হয়। আর বিরোধী দলগুলোর মধ্যে এ মর্মে সমঝোতা হয় যে বিরোধী জোট জয়ী হলে মাহাথির দুই বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রী হবেন আর আনোয়ার ইব্রাহিমকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত মাহাথিরের নেতৃত্বে বিরোধী জোট জয়লাভ করে। আনোয়ার ইব্রাহিমের পিকেআর জোটে বৃহত্তম দলে পরিণত হয়। বারসাতু ১২টি আসন লাভ করে। কিন্তু মাহাথির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আনোয়ার ইব্রাহিমকে কারাগার থেকে মুক্ত করার ব্যাপারে বাধা না দিলেও এক দিকে আমনু থেকে এমপিদের নিজ দলে এনে বারসাতুকে শক্তিশালী করেন অন্য দিকে আনোয়ার ইব্রাহিমের দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা আজমিন আলীকে আনোয়ারের বিপরীতে সমর্থন দিয়ে সামনে নিয়ে আসেন। পিকেআর সভানেত্রী আনোয়ারের স্ত্রী ডা: আজিজাকে উপপ্রধানমন্ত্রী করা হলেও তাকে একেবারেই একটি অগুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় দেন মাহাথির। দলের মধ্যে আনোয়ারের অনুগত বলে পরিচিতদের তিনি উল্লেখযোগ্য কোনো মন্ত্রীর পদও দেননি। মাহাথিরের ক্ষমতা হস্তান্তরের দিন যতই ঘনিয়ে আসতে থাকে তার ক্ষমতা না ছাড়ার পরিকল্পনা ততই এগোতে থাকে। পিকেআর উপপ্রধানের পদে থেকেই আজমিন আলী দাবি করেন মাহাথির যেন পূর্ণ মেয়াদ প্রধানমন্ত্রী থাকেন। শেষ পর্যন্ত মাহাথিরের নেপথ্য পৃষ্ঠপোষকতায় পিকেআরে বিভক্তি সৃষ্টি হয় এবং আজমিন আলীর নেতৃত্বে একটি অংশ পিকেআর ছেড়ে বারসাতুতে যোগ দেয়। মাহাথির পদত্যাগ করে সর্বদলীয় প্রধানমন্ত্রী হবার ছক আঁটেন কিন্তু তার দলের মহিউদ্দিন ইয়াসিন তার আকাক্সক্ষার সামনে বিদ্রোহ করে বিরোধী দল আমনু ও পাসের সহযোগিতায় নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়ে সরকার গঠন করে ফেলেন। কোণঠাসা মাহাথির দলের একটি ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে আরেকটি নতুন দল গঠন করেন। আনোয়ারের এই সময়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রচেষ্টা শেষপর্যন্ত ডিপ স্টেটের সমর্থন না মেলায় সফল হয়নি।
নতুন সমীকরণ
মহিউদ্দিন ইয়াসিন ডা: মাহাথিরকে ডস দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ ভাগিয়ে নিলেও তিনি শান্তিতে থাকতে পারেননি। মহিউদ্দিন তার পুরনো প্রতিপক্ষ আমনুর সাবেক চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রী ড. নাজিব রাজাক ও বর্তমান চেয়ারম্যান ড. জাহিদ হামিদীর অনুগতদের কোণঠাসা করে পাল্টা গ্রুপকে মন্ত্রিত্ব ও অন্যবিধ সুবিধা দেন। এতে ড. নাজিব ও জাহিদ হামিদী সরকারের বাইরে থেকে ভেতরে ভেতরে কোয়ালিশনের বৃহত্তম দল হিসেবে আমনুর নেতৃত্বে সরকার গঠনের পরিকল্পনা আঁটতে থাকেন। আর মহিউদ্দিন ইয়াসিনের সরকারও তাদের বিরুদ্ধে আগের সরকারের সময় চলমান মামলা অব্যাহত রাখেন। মহিউদ্দিন আমনুর নেতাদের মধ্যে দলের সহসভাপতি ইসমাইল সাবরি ইয়াকুব ও অন্যতম নেতা খায়েরী জামালউদ্দিনকে সামনে নিয়ে আসেন। এভাবে আমনুর মধ্যে একটি অংশ সরকারের সুযোগ সুবিধা লাভ করে, আরেকটি অংশ বঞ্চিত হয়ে আদালতের বারান্দায় ঘুরতে থাকে। এই বিক্ষুব্ধ অংশই সংগঠিত হয়ে বিরোধী দলের সাথে গোপন যোগাযোগের মাধ্যমে মহিউদ্দিনকে অনাস্থা প্রস্তাবের মুখোমুখি করে। শেষ পর্যন্ত মহিউদ্দিন ইয়াসিন সিনিয়র মন্ত্রী ও আমনুর সহসভাপতি ইসমাইল সাবরির হাতে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ছেড়ে দেন। এর মধ্যে সরকারে শুরু হয় নতুন মেরুকরণ। ইসমাইল সাবরি ইয়াকুব বারসাতু এবং বিরোধী জোটের সাথে সমঝোতা করে স্থিতিশীলতার ফেরানোর প্রচেষ্টা নেন। তবে নাজিব রাজাক ও জাহিদ হামিদীর প্রভাব কমানো এবং দলের মধ্যে তাদের কোণঠাসা করার কাজও অব্যাহত রাখেন। এখন ড. নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে আদালতের চূড়ান্ত যে রায়টি হতে পেরেছে সেটি প্রধানমন্ত্রী ও তার অনুগত নেতা মন্ত্রীদের নীরব সম্মতিতেই হয়েছে। ড. নাজিব চেয়েছিলেন তার মামলাটি চলমান থাকা অবস্থায় নতুন নির্বাচনে জয়ী হয়ে আবারো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রচেষ্টা নেবেন। কিন্তু ইসমাইল সাবরি তার উচ্চাশাকে দ্রুত মামলা চূড়ান্ত করে ঠেকিয়ে দিয়েছেন। এখন ইসমাইল সাবরির সামনে দু’টি পরিকল্পনা রয়েছে। প্রথমটি হলো দ্রুততম সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমনুকে এককভাবে ক্ষমতায় নিয়ে আসা। এ লক্ষ্যে স্থিতিশীল পরিস্থিতির মাধ্যমে তিনি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের কাজটি অনেকাংশে সম্পন্ন করেছেন। গত দুই প্রান্তিকে উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি বেকারত্বের হার নিচে নেমে এসেছে। অভ্যন্তরীণ জনমত আবার আমনুর পক্ষে আসতে শুরু করেছে যার ফলে সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে আমনু ভালো ফল অর্জন করেছে। ইসমাইল সাবরির দ্বিতীয় লক্ষ্য হলো দলের প্রধানের দায়িত্ব পাওয়া। নাজিবের পতনের পর এবার দলের সভাপতি জাহিদ হামিদীর কর্তৃত্বকে বিদায় করতে হবে এ জন্য। এর মধ্যে আগের সরকারের সময় ড. জাহিদের বিরুদ্ধে চালু করা মামলা পরিণতির দিকে যাচ্ছে। এ মামলায় আমনু প্রধানের শাস্তি হলে ইসমাইল সাবরির দলের প্রধান হবার পথ খুলে যাবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct