মালয়েশিয়ায় হঠাৎ করেই নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. নাজিব রাজাককে দুর্নীতির মামলায় জেলে পাঠানোর পর শাসক দল আমনুর পক্ষ থেকে তীব্র চাপ সৃষ্টি হয়েছে দ্রুত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য। তা না হলে আমনুর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল সাবরি ইয়াকুবকে বরখাস্ত করার হুমকিও দেয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বিরোধী পাকাতান হারাপান জোটের প্রধান আনোয়ার ইব্রাহিম নির্বাচনে যেতে প্রস্তুত বলে ঘোষণা করেছেন। এ নিয়ে লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ প্রথম কিস্তি।
মালয়েশিয়ায় হঠাৎ করেই নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. নাজিব রাজাককে দুর্নীতির মামলায় জেলে পাঠানোর পর শাসক দল আমনুর পক্ষ থেকে তীব্র চাপ সৃষ্টি হয়েছে দ্রুত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য। তা না হলে আমনুর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল সাবরি ইয়াকুবকে বরখাস্ত করার হুমকিও দেয়া হয়েছে। নির্বাচনী হাওয়ার আকস্মিক এই উত্থানে বিরোধী পাকাতান হারাপান জোটের প্রধান আনোয়ার ইব্রাহিম এক মাসের মধ্যেই নির্বাচনে যেতে প্রস্তুত বলে ঘোষণা করেছেন। অন্য দিকে শাসক জোটের অংশীদার পেরিকাতান ন্যাশনাল মহিউদ্দিন ইয়াসিনকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর শতায়ু ছুঁই ছুঁই সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ রোগশয্যা থেকে উঠে অল মালয় পার্টির জোট গঠনের উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন। তিনি নিজে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথাও জানিয়েছেন। যদিও তিনি বলেছেন, ২০২২ সালে নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে প্রতিদিনই নতুন নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছে। সব দলই ক্ষমতায় যেতে মরিয়া। তবে পেছন থেকে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছেন দেশটির গভীর ক্ষমতা বলয়। যে বলয়ে রয়েছে দেশটির মালয় সুলতানরা, প্রতিরক্ষা বাহিনী, নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলো ও অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক কিছু ব্যক্তি। দেশটির ৬০ শতাংশের বেশি মালয় ও ভূমিপুত্র জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য এই গভীর ক্ষমতা বলয় বিশেষ ভূমিকা পালন করে।নির্বাচনী হাওয়া শুরুর পর থেকে মূলত তিনটি প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য ধারা তৈরি হয়েছে। একটি হলো আমনুর নেতৃত্বাধীন বারিসান ন্যাশনাল, দ্বিতীয়তটি বারসাতু, পাস ও বর্নিও মালয়েশিয়ার কয়েকটি দলের সমন্বয়ে গঠিত পেরিকাতান ন্যাশনাল। এ দু’টি জোট এখন সরকারে রয়েছে। এর বাইরে রয়েছে বিরোধী জোট পাকাতান হারাপান। এই জোটের নেতা হিসেবে ডা: মাহাথির মোহাম্মদ ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। প্রতিশ্রুতি অনুসারে আনোয়ার ইব্রাহিমকে ক্ষমতা না দিয়ে নিজের প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ বাড়াতে গিয়ে ক্ষমতার লাইন থেকে ছিটকে পড়েন তিনি। তার সহযোগী মহিউদ্দিন ইয়াসিন ‘শেরাটন অভ্যুত্থান’ নামে খ্যাত এক নাটকীয় ঘটনায় বিরোধীদের সাথে হাত মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়ে যান।
এরপর মাহাথির শাসক জোট এবং বিরোধী পক্ষ দুই জায়গা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এখন তিনি মালয় দলগুলো নিয়ে একটি জোট গঠনের কাজ করছেন। দু’টি লক্ষ্য নিয়ে তিনি এগোতে চাইছেন। প্রথমত, বৃহত্তর আমনু গঠন করে এই শাসক দল থেকে ছিটকে পড়া সবাইকে আবার ঐক্যবদ্ধ করা। মহিউদ্দিন ইয়াসিনও তা সমর্থন করছেন। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ড. নাজিবকে নির্বাচনের আগেই জেলে পাঠানো হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু এ পথে বাধা হয়ে আছেন আমনুর বর্তমান নেতৃত্ব। দ্বিতীয়ত, বৃহত্তর আমনু গঠনের উদ্যোগ সফল না হলে অন্য সব মালয়ভিত্তিক দল নিয়ে একটি জোট তৈরি করে নির্বাচন করা। এ ব্যাপারে মাহাথিরের গোপন সহযোগী আজমিন আলী নেপথ্যে কাজ করছেন। বারিসান আর পেরিকাতান ন্যাশনালের মধ্যে সমঝোতা না হলে মহিউদ্দিন ইয়াসিনও এই ধারায় মিলতে পারেন বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এ ধরনের রাজনৈতিক মেরুকরণ হলে তিনটি প্রধান ধারার মধ্যে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে। একপক্ষে থাকবে বারিসান ন্যাশনাল আর এক বিপরীতে পাকাতান হারাপান জোট ও পেরিকাতান ন্যাশনাল জোট। এভাবে নির্বাচন হলে ফলাফল কেমন হবে তা নিশ্চিত করে বলার সময় এখনো আসেনি। ঠিক কবে নির্বাচন হবে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মেরুকরণ কী দাঁড়াবে, গভীর ক্ষমতা বলয় কী চাইছে, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোর ভূমিকা কী দাঁড়াবে এসব কিছু নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে।
নতুন পরিস্থিতি
মালয়েশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এমন একটি দেশ যেখানকার রাজনীতির গতিপ্রকৃতি ও কূটকৌশল সম্পর্কে পূর্বাভাস দেয়া কঠিন। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. নাজিব রাজাককে ১২ বছরের কারাদণ্ড দিয়ে তার দলের শাসনামলেই জেলে পাঠানো হয়েছে। এতে যে কেউ মনে করতে পারেন দেশটির বিচার বিভাগ এতটাই স্বাধীন যে একজন সাবেক দাপুটে প্রধানমন্ত্রীকে তার দলের শাসন চলাকালেই দুর্নীতির দায়ে জেলে যেতে হলো। আসলেই মালয়েশিয়ার বিচার বিভাগ সম্পর্কে ‘আদালত সম্পূর্ণ স্বাধীন, কেবল রাজনৈতিক ইস্যু ছাড়া’ মর্মে যে কথা চালু আছে তা এখনো বহাল আছে। ড. নাজিব রাজাক প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন মাহাথির মোহাম্মদের সমর্থনে। মাহাথির প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিলেও তার কথামতো পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কাজ করবেন এবং তার নীতি ও প্রকল্পগুলো বজায় রাখবেন বলে প্রত্যাশা করতেন। কিন্তু মাহাথিরের ইস্তফার পর আব্দুল্লাহ বাদাবি নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়ে নিজের মতো করেই দেশ চালাতে চেষ্টা করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে মাহাথির উপ-প্রধানমন্ত্রী ড. নাজিব রাজাককে সমর্থন দিতে শুরু করেন। তিনি এমন পরিস্থিতি তৈরি করেন যাতে বাদাবি বিদায় নিতে বাধ্য হন। মাহাথিরের প্রচেষ্টা সফল হয়, নাজিব রাজাক প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু নাজিবও মাহাথিরের কথামতো চলতে অস্বীকৃতি জানান এবং নিজের মতো করে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ শুরু করেন। এতে মাহাথির আবারো ক্ষুব্ধ হন। কিন্তু ততদিনে ক্ষমতাসীন আমনুর ওপর মাহাথিরের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে যায়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct