ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর ঈদুল আজহা
ড. মোঃ আবু তাহের
ঈদুল আজহা মুসলমানদের সবচেয়ে বড় দুটি ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে একটি, যা জিলহজ্ব মাসে পালন করা হয়। এ মাসেই মুসলমানরা পবিত্র হজ্বও পালন করে থাকে। ঈদের পরিসীমা যার কাছে যাই হোক না কেন অন্তত ঈদের দিনটি ধনী-গরীব সবার কাছেই অত্যন্ত আনন্দের। ঈদ সমাজের সব ভেদাভেদ ও সীমানা মুছে দিয়ে মানুষে মানুষে মহামিলন ঘটায়। ধনী-গরীব, উঁচু-নিচু নির্বিশেষে সব মানুষকে এক কাতারে দাঁড় করায় ঈদ। ঈদের দিনে প্রত্যেক মুসলমান নর-নারী আনন্দকে একত্রে উপভোগ করেন। ঈদ আনন্দের মধ্যে দিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ মর্মবাণী সকলের কাছে প্রতিধ্বনিত হয় ‘সকলের তরে সকলে আমরা’ এ মর্মবাণী সকল অন্যায় অবিচার ও অসাম্যকে অতিক্রম করে এক ভ্রাতৃত্ববোধের প্রেরণা জোগায়। এ প্রেরণায় উদ্দীপ্ত সমাজের হতদরিদ্র অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া মুসলমান হিসাবে আমাদের সকলের দায়িত্ব। জিলহজ্ব মাসের ৮ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত সময়ে সামর্থ্যবান মুসলমান হজব্রত পালন করে থাকে। হজ্ব একান্তই একটি ব্যক্তিগত আমল। ব্যক্তিগত জীবনে আল্লাহ্ তা’আলার নৈকট্য লাভ ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যেই হজব্রত পালন করা হয়। ইসলাম শুধু আনুষ্ঠানিক ধর্ম নয়, কর্ম নির্ভর ধর্ম। যার কর্ম শুদ্ধ নয়, তার ধর্মও শুদ্ধ নয়। ঈমান পাকাপোক্ত হয় সৎকর্মের মাধ্যমে। সৎকর্মে যারা আজীবন নিবিষ্ট থাকে তারাই সৃষ্টির সেরা। (সুরা বাইয়্যেনাহ ৭)। প্রবৃত্তির দাস কখনও আল্লাহ্র দাসে পরিণত হতে পারে না। ষড়রিপুর প্রভাবমুক্ত হয়ে মানবতার সেবা এমনভাবে করতে হবে যেভাবে আল্লাহ্ আমাদের অনুগ্রহ করেন। (কাসাস ৭৭)। শেখ সাদী (র.) বলেন, ‘তব তসবিহ এবং সিজদা দেখে খোদ এলাহী ভুলবে না, মানবসেবার কুঞ্জি ছাড়া স্বর্গ দুয়ার খুলবে না।’
হজ ফরজ হওয়ার মূলে অপরিসীম আধ্যাত্মিক ও জাগতিক গুরুত্ব নিহিত রয়েছে যা অনুধাবন ছাড়া হজ করতে যাওয়া নিছক আনুষ্ঠানিকতা ভিন্ন অন্য কিছু নয়। পবিত্র কোরআনে এর মূল্যবোধের বিষয়ে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিমের দিকে মুখ ফেরানোর মধ্যে নেই কোনো কল্যাণ, কল্যাণ নিহিত রয়েছে যে ঈমান আনে আল্লাহর উপর, পরকালে, ফেরেশতাগণ, সব কিতাবে, নবীদের ওপর এবং আল্লাহ্র মহব্বতে দান খয়রাত করে প্রতিবেশীদের জন্য, এতিম, মিশকিন, মুসাফির ও ইবাদতকারীদের জন্য গোলামমুক্ত করার জন্য এবং সালাত কায়েম করে, জাকাত প্রদান করে, অঙ্গীকার করে তা রক্ষা করে, ধৈর্য্যধারণ করে বিপদের সময়, দুঃখ কষ্ট ও যুদ্ধের সময়, তারাই সত্য পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং তারাই প্রকৃত মুত্তাকি। (সুরা বাকারা ১৭৭)। পবিত্র এ আয়াতের মাধ্যমে এ কথা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, আনুষঙ্গিক অন্য দায়িত্ব তথা হক্কুল ইবাদ বা আর্তমানবতার প্রতি অর্পিত দায়িত্বগুলো যথাযথ পালন ব্যতিরেকে শুধু কেবালামুখী হয়ে, আনুষ্ঠানিক ইবাদত অসম্পূর্ণ। হক্কুল ইবাদ তথা মানবতার হক আদায় ব্যতীত হক্কুুল্লাহ্ বা আল্লাহ্র হক আদায় হয় না। ঈদ আমাদের শিক্ষা দেয়, কারও সঙ্গে কারও ভেদাভেদ নয়। ত্যাগের মহিমায় ক্ষুদ্রতা ভুলে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনের সুযোগ করে দেয় ঈদুল আজহা। আমাদের উচিত ঈদুল আজহার ত্যাগের মহিমা, ত্যাগের আদর্শ অনুসরণ করা, উপলব্ধি করা। ঈদের শিক্ষা হলো মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াবে, মানুষ মানুষকে বুকে টেনে নেবে।
ঈদ মুসলমানদের একান্ত নিজস্ব সংস্কৃতিরই একটা অংশ। ঈদের আনন্দ অন্তর থেকে উপলদ্ধি করতে পারে একমাত্র মুসলমানরাই। ঈদুল আজহায় আল্লাহ্-তায়ালার প্রতি হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর সবচেয়ে প্রিয় জিনিস উৎসর্গ করার যে আনন্দ তাও মুসলমানদেরই একান্ত ও নিজস্ব। ঈদুল আজহা কুরবানি বা ত্যাগের ঈদ। কুরবানী মানে শুধু পশুহত্যা নয়, মনের পশু হত্যা করার। চার হাজার বছরেরও বেশী আগে হযরত ইব্রাহীম (আ.) মহান আল্লাহ্-তায়ালার নির্দেশে নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস অর্থাৎ প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.) কে কুরবানি করতে উদ্যত হন। কিন্তু মহান আল্লাহ্-তায়ালার অপার কুদরত ও মহিমায় হযরত ইসমাইল (আ.) এর পরিবর্তে দুম্বা কুরবানি হয়ে যায়। সেই থেকেই চালু হয় কুরবানিতে পশু জবাই করার বিধান। হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর সেই ত্যাগের মহিমা স্মরণ করে মুসলমানরা ঈদুল আজহার দিনে আল্লাহর অনুগ্রহ কামনা করে পশু কুরবানি করে। সামর্থ্যবান মুসলমানদের জন্য কোরবানি করা ফরজ। ঈদের পরের দুই দিনও পশু কুরবানি করা যায়। ঈদ নামায শেষে করতে হয়। কুরবানির মাংস তিন ভাগে ভাগ করে একভাগ নিজের জন্যে, আত্মীয় স্বজনদের জন্যে এক ভাগ এবং গরিব মানুষদের মধ্যে একভাগ বণ্টন করে দেয়া উত্তম। ইসলাম শব্দের অর্থের সাথে কুরবানির অর্থের মিল খুজে পাওয়া যায়। ইসলাম অর্থই হচ্ছে আত্মসমর্পণ এবং আত্মসমর্পণ এর অর্থ হচ্ছে আত্মবিসর্জন, আর আত্মবিসর্জন মানেই কুরবানি। ঈদুল আজহার দিনে পশু কুরবনির মাধ্যমে প্রকৃত ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল হোক আমাদের জীবন। তা না হলে সামর্থ্যবান মুসলমানদের কুরবানি কোনো সার্থকতা বয়ে আনবে না। কুরবানি শুধুমাত্র একটি ইবাদতই নয় বরং কুরবানির মধ্যে রয়েছে ত্যাগ, উৎসর্গ ও আনুগত্যের এক মহান দৃষ্টান্ত।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct