তুর্কি নির্বাচন নাটকীয় মোড় নিয়েছে। ক্ষমতাসীন পিপলস জোটের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী এরদোগানের প্রতিপক্ষ কামাল কিরিচদারুগলু কুর্দি দল এইচডিপির সাথে তাদের নিজস্ব প্রার্থী না দেয়ার ব্যাপারে সমঝোতায় এসে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার কৌশল নিয়েছেন। এই কৌশলের প্রতিবাদ এসেছে তার জোটের জাতীয়তাবাদীদের পক্ষ থেকে। ইউরোপ আমেরিকান প্রভাবশালী জোটের সাথে বিরোধী প্রার্থীর একাত্ম হওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এরদোগানের জনপ্রিয়তার পাল্লা আবার ভারী হতে শুরু করেছে। তুরস্ক নিয়ে লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ প্রথম কিস্তি।
তুর্কি নির্বাচনের প্রচার প্রচারণা নাটকীয় মোড় নিয়েছে। ক্ষমতাসীন পিপলস জোটের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী রজব তাইয়্যেপ এরদোগানের প্রতিপক্ষ কামাল কিরিচদারুগলু কুর্দি দল এইচডিপির সাথে তাদের নিজস্ব প্রার্থী না দেয়ার ব্যাপারে সমঝোতায় এসে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার কৌশল নিয়েছেন। এই কৌশলের প্রতিবাদ এসেছে তার জোটের জাতীয়তাবাদীদের পক্ষ থেকে। বিরোধী নেশন জোটের দ্বিতীয় প্রধান শরিক দল গুড পার্টির গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেতা বিরোধী জোট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারেন বলে ধারণা করছেন অনেক বিশ্লেষক। এর প্রভাব আর সে সাথে শাসক দলের প্রার্থীকে হারাতে ইউরোপ আমেরিকান প্রভাবশালী জোটের সাথে বিরোধী প্রার্থীর একাত্ম হওয়াটাকে তুর্কি জনগণ কিভাবে নেন তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে বেশ খানিকটা পিছিয়ে রয়েছেন বলে মনে করা এরদোগানের জনপ্রিয়তার পাল্লা আবার ভারী হতে শুরু করেছে। প্রশ্ন হলো, শেষ পর্যন্ত তুর্কি প্রজাতন্ত্রের শত বর্ষ উত্তর নতুন পর্বে কি নেতৃত্ব দিতে পারবেন এরদোগান? ঘরে-বাইরে এরদোগান বিরোধীদের জোট
গত ২০০ বছর ধরে বৈশ্বিক জোটের পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো একটি দেশের রাজনীতিকে রূপ দেয়ার লক্ষ্য নিলে প্রায়ই তাদের কার্যক্রম সফল হতে দেখা যায়। গোয়েন্দা সংস্থা, মিডিয়া আউটলেট, আন্তর্জাতিক প্রেশার গ্রুপ এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক উপায়ের মতো তাদের টুলসের সাহায্যে পশ্চিমারা রাষ্ট্রগুলোকে ধ্বংস করেছে অথবা তারা যখন ইচ্ছা দেশগুলোর রাজনীতির পরিবর্তন এবং ডিজাইন করেছে। এমনটি দেখা গেছে সাম্প্রতিক বছরগুলো পর্যন্ত।তবে একবারে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী গেম সেটিংয়ে বড় রাষ্ট্রগুলোর আগের অবস্থা আর নেই; আর যেসব দেশকে বড় দেশগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে চায় এখন তারাও আর এত ছোট বা শক্তিহীন নেই। আজকের তুরস্ক, ইরান, পাকিস্তান, মিসর, মেক্সিকো ও ব্রাজিল আর এমন দেশ নয় যে, পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো চাইলেই তাদের নীতি বা শাসন রাতারাতি পরিবর্তন করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান রাজনীতিক তুরস্কে এরদোগান বিরোধী জোটকে সমর্থন করছে। মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে, এক দিকে, গ্রিস এরদোগানের রাষ্ট্রপতিত্ব নিয়ে অস্বস্তির মধ্যে রয়েছে। অন্য দিকে, ইরান, ইসরাইল, মিসর, আর্মেনিয়া, বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশির ভাগ রাষ্ট্র মনে করে, তুর্কি রাষ্ট্রপতির উপস্থিতি দেশটিতে তাদের স্বার্থকে বিপন্ন করছে। আর আজ, প্রায় সব ঔপনিবেশিক দেশই তুর্কিয়েকে একটি স্যাটেলাইট রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। দেশের অভ্যন্তরে এরদোগানের বিরোধিতাকারী সব দল, ২০ বছর ধরে তুরস্কে তাদের মরিয়া কৌশল নিয়ে একত্র হয়েছে এবং একটি একক দলের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সংগ্রামে নেমেছে। তুরস্কের এরদোগানবিরোধী অভ্যন্তরীণ শক্তি বহিরাগতদের বিশ্বাস করে এবং বহিরাগতরা অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিদের ওপর নির্ভর করে। তবে প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে একা পরাজিত করার ক্ষমতা কোনো পক্ষেরই নেই। ছয়টি দলের সমন্বয়ে গঠিত বিরোধী ব্লক নেশন অ্যালায়েন্স এরদোগানকে পরাজিত করার জন্য দুই বছর ধরে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, অবশেষে পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এইচডিপি) সমর্থন গ্রহণ করেছে। ওয়াইপিজি নামে পিকেকের সহযোগী সংগঠন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে সিরিয়ায় হিটম্যান হিসেবে একটি স্যাটেলাইট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে। যখন এটি স্পষ্ট যে, নেশন অ্যালায়েন্স এরদোগানকে পরাজিত করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী নয়, তখন এইচডিপি বিরোধী ব্লকের নবাগত হিসেবে ‘ছয়ের টেবিলে’ যোগ দেয়।
এইচডিপি যখন জোটে অংশ নেয়, তখন নেশন অ্যালায়েন্সের একটি বড় অংশ বিদ্রোহ করে। শুধু গুড পার্টি (আইপি) চেয়ার মেরাল আকসেনার এইচডিপির উপস্থিতি দেখে বিরক্ত হয়েছেন এমন নয়, একই সাথে আইপির জাতীয়তাবাদী অংশের প্রতিনিধিত্বকারী ইয়াভুজ আগিরালিওলু এই বোঝাপড়ার সমালোচনা করে একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতাও দিয়েছেন এক সপ্তাহের আগে। আগিরালিওলু বলেছেন, তারা সন্ত্রাসবাদের ছায়ায় থাকবেন না। তুরস্কের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারদের মতো, আইপি রাজনীতিবিদ ভেবেছিলেন যে এইচডিপিকে সন্ত্রাসবাদ থেকে আলাদা করা সম্ভব হয় কি না। কিন্তু এইচডিপি সরাসরি সন্ত্রাসবাদের নিন্দা করার আহ্বানে এখন পর্যন্ত সাড়া দেয়নি। অধিকন্তু এইচডিপি কখনো সন্ত্রাসী সংগঠন পিকেকের নিন্দা করেনি বা তাদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করেনি; বরং মনে হচ্ছে তাদের ব্যাপারে প্রকৃত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হলেন উত্তর ইরাকের সেই পর্বত যেখানে পিকেকের সদর দফতর কান্দিলের অবস্থান। এইচডিপি শুধু কান্দিলের নীতিই বাস্তবায়ন করছে। অনেক দেশ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মানবিক মর্যাদার পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে, মানবাধিকারকে সমর্থন করে এবং অনেক দল এতে তুরস্কের এইচডিপির কাজ উপেক্ষা করে। যদিও এটি অনেকের কাছে স্পষ্ট যে, এইচডিপি এবং পিকেকে মূলত একই কেন্দ্রের নেতৃত্বে চালিত অভিন্ন সংগঠন। পিকেকের চাপিয়ে দেয়া চাপ এবং স্বয়ংক্রিয়-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এইচডিপি থেকে একটি নতুন স্বাধীন নীতির উদ্ভব হতে দেয়নি। যখন কেউ এই প্রেক্ষাপটে বিরোধীদের বিশ্লেষণ করে, তখন এটি স্পষ্ট হয় যে, অনেক দেশ একটি দুর্বল ও ভেঙে পড়া তুর্কিয়ের স্বপ্ন দেখে যাদের সাথে আছে গুলেনবাদী গ্রুপ এবং পিকেকে। এদের সবাই মনেপ্রাণে এরদোগানকে বিদায় করতে চায়। দেশের বাইরে ও ভেতরে এরদোগানের বিরোধিতায় রয়েছে, বড় দলগুলোর সমর্থক যারা ২০ বছর ধরে ছোট প্রান্তিক গোষ্ঠী এবং নতুন প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর কাছে হেরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। লক্ষণীয় যে, বিরোধী দলগুলো গণতান্ত্রিকভাবে এরদোগানের মোকাবেলা করতে পারছে না এবং বিশ্বব্যাপী গেমসেটাররা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুর্কিয়ের কূটনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষমতা এবং কঠোর শক্তির মোকাবেলা করতে পারছে না। এখন সব পক্ষ সম্মিলিতভাবে এরদোগানের পতন ঘটাতে চাইছে। এটি কোনো গোপন বিষয় নয় যে, পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এইচডিপি) নিজস্ব রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী না দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তে কিরিচদারুগলুকে স্পষ্টভাবে সমর্থন রয়েছে। যেহেতু ঊর্ধ্বতন এইচডিপি সদস্যরা বারবার এরদোগানকে সমর্থন করাকে ‘কুর্দিদের প্রতি শত্রুতা’ সমতুল্য বলে মনে করেছেন, তাই তাদের আসলে বাইরে এসে জনগণকে ক্ষমতাসীনদের প্রতিপক্ষকে ভোট দিতে বলার দরকার নেই। তারা বলে যে, ‘কে গণতান্ত্রিক প্রার্থী আমাদের জনগণ তা জানে,’ তারা কিরিচদারুগলুর হাতে খেলার চেষ্টাই করে এবং নেশন অ্যালায়েন্সের মধ্যে জাতীয়তাবাদীদের অস্থির করা থেকে বিরত থাকার জন্য প্রকাশ্যে কথা বলে না। পিকেকে ন্যাশনাল অ্যালায়েন্সের সিনিয়র অপারেটিভদের ইতিবাচক বিবৃতিও সেই সত্যের প্রমাণ দেয়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct