দুর্নীতি রক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে সুচিন্তিত প্রকল্প ‘দিদির রক্ষা কবচ’ প্রকল্পের অন্তৰ্গত একটা দিদির দলীয় দূত-বাহিনী বঙ্গের ঘরে ঘরে দশ কোটি জনগের কাছে পোঁছানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর এই পরিদর্শনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘দুয়ারে সরকার প্রকল্পে’র অধীনস্থ প্রায় পনেরোটি সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে কি না তার খতিয়ে দেখা। আগামী “দিদির দলীয় দূত-বাহিনী” দিদির সন্দেশ নিয়ে রাজ্যবাসীর দরজায় হানা দেবে। যারাই দুর্নীতির শীর্ষে অবস্থান করছে, তারাই কি আবার ঘরে ঘরে আসছে দেখতে? এ নিয়ে লিখেছেন মোঃ সাহিদুল ইসলাম।
দুর্নীতি, কেলেঙ্কারি, প্রতারণা এই সব বিষয়গুলো বেশ কয়েক দিন ধরে খুব দৃঢ়ভাবে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী মহলে সাড়া ফেলেছে। একটি সৃজনশীল সমাজ ব্যবস্থার শিরদাঁড়া সম যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্যসুরক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রের প্রকল্পে দুর্নীতি একটা স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। যদিও “সরকার ও দুর্নীতি” বহু প্রাচীন কাল থেকেই অঙ্গাঙ্গী ভাবেই জড়িত কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সামাজিক ভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আমাদের বঙ্গে সরকারের বহু প্রচেষ্টার পরেও কোথাও যেন সাধারণ মানুষ ‘দুর্নীতির’ ঘোর থেকে বেরোতে পারছে না অর্থাৎ সরকারি কোনো কাজ প্রাকৃতিক নিয়মে বা নিয়মবিধি অনুসারে হবে সেটা যেন অসাধ্য মনে হচ্ছে। দুর্নীতি রক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে সুচিন্তিত প্রকল্প ‘দিদির রক্ষা কবচ’ প্রকল্পের অন্তৰ্গত একটা দিদির দলীয় দূত-বাহিনী বঙ্গের ঘরে ঘরে দশ কোটি জনগের কাছে পোঁছানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর এই পরিদর্শনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘দুয়ারে সরকার প্রকল্পে’র অধীনস্থ প্রায় পনেরোটি সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে কি না তার খতিয়ে দেখা। এটা যে একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ সেটা নিয়ে আপাতদৃষ্টিতে সন্দেহাতীত কিন্তু মুখ্য যেটা হচ্ছে নিন্দুক সহ বুদ্ধিজীবীরা প্রশ্ন করছেন ‘এই প্রচেষ্টা, তুমি কার হিতে ?’ কেননা পূর্বে আসা অনেক প্রকল্প ও প্রচেষ্টা যেমন ‘দিদিকে বলো’ মানুষের বিশ্বাসকে জয় করতে পারেনি, এক কোথায় কার্যকরী হয়নি এবং সম্পূর্ণরূপে ‘সরকারিত্বের’ একটা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সেই একই সূত্রে, আগামী ১১ই জানুয়ারি ২০২৩ থেকে “দিদির দলীয় দূত-বাহিনী” সরাসরি দিদির সন্দেশ নিয়ে রাজ্যবাসীর দরজায় হানা দেবে। যারাই দুর্নীতির শীর্ষে অবস্থান করছে, তারাই কি আবার ঘরে ঘরে আসছে দেখতে ? কেননা দলীয় কর্মীকে দায়িত্বভার দেওয়া হচ্ছে। যাইহোক, এই প্রচেষ্টা বা প্রকল্পের যেটি নেতিবাচক দিক হিসেবে, আমরা বলতে পারি যে, ১) সরকার কি আগে থেকেই অনুমান করে নিয়েছে যে ‘দুয়ারে সরকার’ দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছায়নি ? যদি এটাই হয়, তাহলে কেনো ? ২) সরকারি প্রকল্পের পর্যবেক্ষণ করবে শুধু মাত্র দলীয়-দূত, কেনো ? ৩) জগৎ বিখ্যাত দার্শনিক ‘মাইকেল ফুঁকো’র গভর্নমেন্টালিটি তত্ব অনুসারে, আমরা কি আঁচ করতে পারি যে দলীয় রাজনৈতিক আদর্শের দ্বারা সর্বস্তরে সঙ্গবদ্ধভাবে সাধারণ নাগরিকের মন-মানসিকতা সহ তাদের আচার-বিচার কে আয়ত্ব করে সরকারিত্ব জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়ার উপক্রম চলছে। ৪) খুব প্রসঙ্গত, আমরা কি বর্তমান পরিস্থিতে সাধারণ নাগরিক ও জনগণ কে অবহেলা করছি এবং তাদের দ্বারা, তাদের জন্যে, তাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠান যেমন পঞ্চায়েত ব্যবস্থা কে অবমাননা করছি ?
ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থার একটি হলো গ্রাম পঞ্চায়েত গ্রামীণ স্তরে, এবং ওপর দুটি হল পঞ্চায়েত সমিতি ব্লক স্তরে ও জিলা পরিষদ জেলা স্তরে। এই পঞ্চায়েত ব্যবস্থার আরেকটা নাম হচ্ছে ‘স্বশাসিত-সরকার’ (Local Self-Government )। সুতরাং এটা বলা হয় যে, একটা পঞ্চায়েত তার অধীনস্থ সমস্ত গ্রামের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতির ভাগ্য রেখা রচনা করবে সে নিজেই। জাতির জনক গান্ধীজি সহ অন্যান্য উন্নয়ের কান্ডারিগণ এই মত পোষণ করে থাকেন যে, একটি পঞ্চায়েত, — পাড়া বা মহল্লা ভিত্তিক এলাকাবাসীর সক্রিয় অংশগ্রহণে — ক্ষুদ্র ও মাঝারি উন্নতির পরিকল্পনা করবে এবং বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক সহায়তায় উন্নতির শিখরে উঠতে থাকবে। অন্যার্থে, ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের প্রধান ইউনিট হিসেবে পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে দেখা হয় যেখানে সরাসরি সাধারণ নাগরিক এবং সরকারের একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। এই সম্পর্কের সূত্রে ভিন্ন প্রকল্প ও সরকারি সুবিধা মানুষের কাছে আসবে এবং তার ভালোমন্দ নিয়ে আলাপালোচনা করবে গ্রাম সভার মাধ্যমে, কিন্তু সেই গ্রাম সভা হয়তো শুধু মাত্র পঞ্চায়েত অফিসের টেবিলে বসেই সম্পন্ন হয়ে যায়। একজন সামাজিক গবেষক হিসেবে, এটা পর্যবেক্ষণ করা গেছে যে , খুব কম সংখ্যক যুব সম্প্রদায়ের কাছে ‘গ্রাম সভার’ ধারণা সুস্পষ্ট, এমন কি অনেককেই কোনো দিন শোনেই নি। বর্তমান সময়ে, একটা পঞ্চায়েত যেমন দুর্নীতিপরায়ণ ও অকেঁজো হয়ে পড়েছে ঠিক তেমনি একটা মানুষের সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অবহেলিত হচ্ছে। নোবেল পুরস্কৃত সর্ব প্রথম মহিলা অর্থনীতিবিদ ইলিনোর অস্ট্রোম দেখিয়েছেন যে কোনো সরকারি প্রকল্প ও উন্নয়নের মান্নোয়ন বৃদ্ধিতে সাধারণ নাগরিকের সক্রিয় অংশগ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। সুতরাং, পঞ্চায়েত সহ অন্যন্য নাগরিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে উপেক্ষা করে ‘দলীয় দূত বা বাহিনী’ তৈরি করে উন্নয়নের কান্ডারি হওয়া কতোটা যুক্তিযুক্ত সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অন্ত নেই এবং এই বাহিনীর কার্যক্ষমতা নিয়েও মানুষের মনে অগণিত চিন্তা ভাবনা বাঁসা বাঁধতে পারে যেটি হয়তো সুদূরপ্রসারিতে ফলপ্রুসু না ও হতে পারে।এই সরকারি প্রচেষ্টার ফলে এটা কি আমরা ভাবতে চলেছি যে, এইসব লোক দেখানো দৃষ্টি আকর্ষণ মূলক অপ্রয়োজনীয় নিরর্থক প্রচেষ্টা মাত্র। সাধারণ নাগরিক হিসেবে কিছু মৌলিক প্রশ্ন আমাদের মনে আসা একান্ত কাম্য: কার জন্যে কে প্রকল্প বানাচ্ছে এবং কিসের নিরিখে ? কে কাকে নিয়ন্ত্রণ বা পর্যবেক্ষণ করছে ? কে কার কাছে দায়বদ্ধ থাকছে ? কিভাবে এবং কি উদ্দেশ্যে প্রকল্প শুরু হচ্ছে ? অন্যথা কে রক্ষক আর কে ভক্ষক সাধারণ নাগরিক গুলিয়ে ফেলছে। সর্বোপরি এটা বলা বাহুল্য যে, যেকোনো প্রকল্পই নাগরিকের হিতে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি দুদিকই নজরে রেখে স্থায়িত্বশীল ভাবে রচনা ও পরিচালনা করা উচিত।
লেখক গবেষক, ইনস্টিটিউট অফ রুরাল ম্যানেজমেন্ট আনন্দ, গুজরাত
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct