ড. মুহাম্মদ ইসমাইল, আপনজন: ভারতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে দেশের সংখ্যালঘুরা তাদের নিজস্বতা ও পছন্দ মত মতাধিকার থেকে ধীরে ধীরে বঞ্চিত হচ্ছে সংসদীয় রাজনীতি থেকে। কারণ ২০১৪ সালের পর কেন্দ্রে বিজেপি আসার পর থেকে ভারতবর্ষ জুড়ে মুসলমানদের মধ্যে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে সর্বত্র। তবে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে ঘটে চলা নানা প্রকার ঘটনা সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে। দেশের নানা প্রান্তে সামান্য অজুহাতে যেভাবে সংখ্যালঘুদের হেনস্তা করা হচ্ছে তা নিয়ে পৃথিবী ব্যাপী নানা সংগঠন উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তেমন ভাবে ভারতীয় সংখ্যালঘুরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। আর্থ-সামাজিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে থেকে সংখ্যালঘুদের আড়াল করে রাখা হয়েছিল পরোক্ষভাবে নানা অনিয়মের মধ্য দিয়ে ও সংবিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। তাই সংখ্যালঘুরা বরাবর বঞ্চিত সকল সরকারি পরিষেবা থেকে। কোন রাজনৈতিক দল সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেনি যদিও তারা নানাভাবে সংখ্যালঘুদের ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। যদি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি কবজা থেকে শুরু করে নানা ক্ষেত্রে বঞ্চনা নতুন ঘটনা নয়। তবুও বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের শাসনে সরাসরি যেভাবে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ ও বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করা হচ্ছে তা ভারতীয় সংবিধানের মূলধারার পরিপন্থি। সামাজিক ক্ষেত্রে ঘৃণা ছড়ানো থেকে ভারতীয় সভ্যতায় মুসলমান সভ্যতার সংস্কৃতির প্রভাব কীভাবে মুছে ফেলা যায় তার পরিকল্পনা দ্রুত রূপায়ণ করা হচ্ছে। একদিকে বিভিন্ন ভাবে মুসলমানদের নামের নামকরণ পরিবর্তন করে হিন্দু নানা দেব দেবীর নামকরণ হচ্ছে অন্যদিকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুসলমানদের সরানো হচ্ছে ও বিকৃত ইতিহাস পাঠ্য পুস্তকে আনা হচ্ছে। বাবরি মসজিদ থেকে শুরু করে দেশের নানা মসজিদ, ইমারত প্রভৃতিকে টার্গেট করে একের পর এক ধর্মস্থান দখল করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন দেশের বিচারব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে। বর্তমানে দেশের গণতন্ত্র আক্রান্ত ও আক্রান্ত আমাদের সংবিধান যার উপর নির্ভর করে ১৪০ কোটি মানুষের সুশৃংখলভাবে বসবাস। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সংখ্যালঘু জনগণ আক্রান্ত হচ্ছে বিজেপি সমর্থিত নানা শাখা সংগঠনের দ্বারা। আফ্রাজুলের মত শ্রমিককে রাজস্থানে যেমন জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া হচ্ছে অন্যদিকে আখলাকের মতো মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে সন্দেহজনকভাবে বাড়িতে গোমাংস আছে বলে। রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে অফিস কর্মক্ষেত্র সর্বত্র সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হচ্ছে ও বাক্যবানের কথা বাদ দিলেও। দেশে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে তাদের সমর্থক কট্টরপন্থী হিন্দুরা মনে করছেন দেশ তাদের এবং মুসলমানদের এই দেশে থাকার অধিকার নেই। তার ফলে বিজেপি ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নানা উসকানিমূলক কাজকর্মের জন্য সংখ্যালঘুদের কাজের পরিসর সংকুচিত হয়েছে। বিভিন্ন প্রাইভেট,বেসরকারি সংস্থা, মালিকানাধীন কোম্পানি থেকে শুরু করে নানা জায়গায় সংখ্যালঘুদের এক দিকে ছাঁটাই করা হচ্ছে। অন্যদিকে নতুন ভাবে তাদের নিয়োগ দিতে ভয় পাচ্ছে বিভিন্ন সংস্থার এবং হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর চোখ রাঙানোর ও বয়কটের জন্য। শুধু তাই নয়, জমাটোর মত বহু প্রসিদ্ধ খাদ্য সরবরাহকারী সংস্কার ডেলিভারি বয় মুসলমান বলে বহু লোক খাদ্য গ্রহণ করছেন না। তাই তারা সংখ্যালঘুদের নিয়োগ করতে পিছু পা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, দেশকে ধর্মীয় উত্তেজনার মধ্য দিয়ে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে কয়েক বছরের শাসনে। ফলে ও উভয় ধর্মীয় গোষ্ঠীর মানুষেরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে। শুধু অশিক্ষিতরা নয়, শিক্ষিত জনসাধারণ ও ধর্মীয়উস্কানি মূলক বক্তব্যে সাড়া দিচ্ছে। গত ২০২৩ সালে ৬৯৮উস্কানিমূলক বক্তব্য পেশ করা হয়েছে। মুসলমান মেয়েদের সাথে জোর করে বিয়ে করার ফরমান জারি করা হচ্ছে কখনো মৃত্যু নারীকে কবর থেকে তুলে রেপ করার কথা বলা হচ্ছে, কখনো ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করার কথা বলা হচ্ছে, আবার কখনো মুসলমান হকার ও বিক্রেতা থেকে কোন জিনিসপত্র না-কেনার নিধান দেওয়া হচ্ছে। আবার কখনো মুসলিম বিক্রেতাকে হিন্দু মহল্লায় ঢুকতে বাধা দেয়া হচ্ছে। এমন বহু ঘটনা দেশজুড়ে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে বহুল প্রচলিত। অন্যদিকে মুসলমানদের ঘর ভাড়া, তাদের কাছে জমি বিক্রি না করা, হিন্দু এলাকায় বসতি স্থাপন, নতুন ফ্ল্যাট কিনা প্রভৃতিতে নানাভাবে বাধা দেওয়া হচ্ছে। তবে অধিকাংশ ঘটনা বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে বেশি হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ধর্মীয় বিভাজনের উপর ভিত্তি করে নাগরিক আইন সংশোধন করেছেন যার ফলে সংবিধানের মূলধারা আঘাতপ্রাপ্ত। মুসলমানদের নানা ধর্মীয় বিধানের উপর হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে যেমনি তিন তালাক, বহুবিবাহ থেকে শুরু করে নানা বিষয় নিয়ে বিতর্ক করা হচ্ছে ও আইন পাস করা হয়েছে। অথচ এই দেশে অযৌক্তিকভাবে মাটির পুতুল বানিয়ে কোটি কোটি টাকা খরচ করে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পূজা পার্বণ চলছে। এছাড়া সম্পত্তির অধিকার ও মুসলমান আইন বিলোপ করে ইউনিয়ন সিভিল কোড আনা হচ্ছে যা ভারতের বহুত্ববাদ ও বৈচিত্র্য কে ধ্বংস করার পরিকল্পনা। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতীয় মুসলমানেরা উন্নয়ন চিন্তাধারা থেকে বহুদূরে। তারা আতঙ্কিত নিজেদের অধিকার ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে। তাই তারা বাঁচার তাগিদে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের গোলামে পরিণত হতে চলেছে। ভোট আসলে এখন মুসলমানদের তেমন কেউ কদর করে না বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও প্রার্থী কে পছন্দের মত ভোট দেওয়ার মতো পরিস্থিতিতেও নেই। কাজের পর্যালোচনা করে ভোট দান করার কথা চিন্তাভাবনা করতে পারছে না ও তাদের এলাকার সমস্যা সমাধানের কথা মুখে আনতে পারছে না। বিভিন্ন রাজনীতি দলগুলো তাদের সতর্ক করছে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট প্রদান করতে যদি কোন রাজনৈতিক দল মুসলমানদের বঞ্চনা ও আতঙ্ক দুরি কারণে কোন অগ্রিম প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে না। মুসলমানদের কাছে বহু রাজনৈতিক দল ৃ ভোট চাইতেও আসছে না কারণ তাদের কাছে পরিষ্কার বিজেপিকে প্রতি রোধ করতে মুসলমানেরা একত্রিত হয়ে আমাদের ভোটদান করবেন। এতটাই আতঙ্কিত যে নানা মুসলমান সংগঠন বিজেপিকে প্রতিহত করতে বিজেপি বিরোধী নানা রাজনৈতিক দলের শক্তিশালী ও সম্ভাবনা ময় প্রার্থীদের ভোটদান করার পক্ষে প্রচারপ্রসার করছেন। যদিও সেই দলের নেতাকর্মীরা জানে না, তাদের হয়ে প্রচার ও প্রসার হচ্ছে এবং তারা জানেও না বর্তমান পরিস্থিতিতে মুসলমানদের বেঁচে থাকতে হলে তারাই আমাদের পায়ের তলায় আশ্রয় নেবে। তাই মুসলমানদের ভোট সহজেই যাচ্ছে কোনো রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও বাধ্যবাধকতা ছাড়া। ইসরাইলের মত আক্রমণকে বিজেপির কিছু নেতা ভারতবর্ষে চৌদ্দশ বছর পূর্বে এমন হিন্দুদের উপর আক্রমণ হয়েছিল বলে ধর্মীয় উত্তেজনা বৃদ্ধি করছে। তা নিয়ে কোনো বিচার বিভাগীয় তদন্ত হয় না। তাই ২০২৪ সালের নির্বাচনে সংখ্যালঘুরা আতঙ্কিত, এবার বিজেপি ক্ষমতায় আসলে তাদের নাগরিকত্ব থাকবে তো? দেশে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান কতটা সুরক্ষিত থাকবে? জনগণ ও সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষিত হবে তো? ভারতের বৈচিত্র্য, নানা জাত, নানা পরিধান, ধর্ম প্রভৃতির উপর হস্তক্ষেপ হবে না তো? সমস্ত বিষয় নিয়ে সংখ্যালঘু মুসলমানেরা চরম উদ্যোগে রয়েছে। তাই তারা কোনো কিছু বাঁচ বিচার না করে বিরোধীদের কোলে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছে। যদিও বিরোধীরা তেমন ভাবে মুসলমানদের ভোটার ও নেতা-নেত্রীদের খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তারা মনে করছেন মুসলমানদের উন্নয়ন ও গুরুত্ব দিলে তাদের হিন্দু ভোট বিজেপিতে চলে যাবে। যতদিন যাচ্ছে, ততই মুসলমানদের রাজনৈতিক পছন্দের জায়গা সংকুচিত হচ্ছে এবং বাঁচ বিচার করে চোর গুন্ডা মস্তান তোলাবাজ থেকে শুরু করে সকলের কাছে আশ্রয় নিচ্ছে কেবলমাত্র বিজেপি থেকে রক্ষা পেতে।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct