রবীন্দ্র-ছোটগল্প ‘ছুটি’-র শেষ বাক্যে বলা হয়েছে ‘মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।’ যদিও ফটিক শহরের স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়িতেই ফিরতে চেয়েছিল। সেই ফেরা আর হয়নি। ফটিক চক্রবর্তী গ্ৰামের ছেলেদের দলের সর্দার। খেলার ছলে নানা রকম বালকোচিত দুষ্টুমি করে। অপরদিকে ‘সম্পত্তি সমর্পণ’ ছোট গল্পে সপুত্র গৃহছাড়া হন নিতাই পালের বাবা বৃন্দাবন কুণ্ডু। সেই দুই কিশোর কাহিনী নিয়ে লিখেছেন ড. শেখ কামাল উদ্দীন।
‘মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।’ কথাগুলি ফটিকের। পৌষ ১২৯৯ এর ‘সাধনা’ পত্রিকায় প্রকাশিত রবীন্দ্র-ছোটগল্প ‘ছুটি’-র শেষ বাক্য। এই ছুটি আপাত-সাধারণ কোন ছুটি নয়। যদিও ফটিক শহরের স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়িতেই ফিরতে চেয়েছিল। সেই ফেরা আর হয়নি। ফটিক চক্রবর্তী গ্ৰামের ছেলেদের দলের সর্দার। খেলার ছলে নানা রকম বালকোচিত দুষ্টুমি করে। গল্পের শুরুতেই দেখি, নদীর ধারে বেশ বড় একটা শালকাঠ পড়েছিল। সেটিকেই খেলার বস্তু ভেবে ঠেলে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়া স্থির হল। এমন সময় ফটিকের ছোটভাই মাখন সেই কাঠের উপর উঠে বসলে ভাইকে সহ ফটিকের নেতৃত্বে ছেলেরা কাঠ গড়াতে শুরু করে। মাখন উল্টে পড়ে। ফল যা হওয়ার তাই হল। কিছুক্ষণ পরে মায়ের ডাক পড়ল। ছোট ভাইকে ঠেলে ফেলে দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত ফটিককে তার মা ফটিকের পিঠে দু’ তিনটি চড় বসিয়ে দিলেন। ফটিকও মাকে ঠেলে দিল। এমন সময় ফটিকের শহুরে মামা সেখানে উপস্থিত হন। দাদা-বোনের পরামর্শে স্থির হল ফটিককে শহরের স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হবে। কথামতো কাজও হল। অন্তহীন উৎসাহ নিয়ে ফটিক শহরে এল। মামির সঙ্গে আলাপ হল। কিন্তু মামীর স্নেহ পেল না। স্কুলে ভর্তি হল। স্কুলেও তার মত ‘নির্বোধ এবং অমনোযোগী বালক আর ছিল না।’ ফটিক সর্বত্র বেমানান। শহরে বেড়ানোর মাঠ নেই। নদীতীর নেই। জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার কাটার মত নদী নেই। সমবয়সী ছেলেদের নিয়ে উপদ্রব করার জায়গা নেই। বড়কথা সেখানে তার মা নেই। গ্রামে মায়ের কাছে ফিরে আসার জন্য সে অস্থির হয়ে পড়ে। মামাকে জিজ্ঞাসা করলে, মামা বলেন, ‘স্কুলের ছুটি হোক।’ স্কুলের বই হারিয়ে ফেলে নতুন বই কিনে দেওয়ার কথা বললে মামীর কথায় ফটিকের মনে হতে লাগল, সে বোধ হয় পরের পয়সা নষ্ট করছে। মনের মধ্যে একটা হীনতা ও দীনতা কাজ করতে শুরু করে। সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পর তার মাথাব্যথা শুরু হয়, গা সিরসির করতে থাকে, জ্বর আসে। মামার বাড়ি থেকে লুকিয়ে চলেও আসতে চায় মায়ের কাছে। কিন্তু পুলিশে ধরা পড়ে ফিরে যেতে হয় মামার বাড়িতেই। জ্বর তীব্রতর হয়। ভুল বকতে শুরু করে ফটিক। ডাক্তার এসে জানান, ‘অবস্থা বড়োই খারাপ’। ফটিকের মাকে খবর দেওয়া হয়। মা এসে ফটিকের শয্যায় আছড়ে পড়লে ফটিক বলে, ‘মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।’ স্নেহাতুর বালক ফটিক অকালে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল কার দোষে? কি এমন বেশি চেয়েছিল সে! মামির ভালবাসা চাওয়া কি খুব অন্যায় ছিল! গ্রামের শিকড় ছিন্ন করে পাষাণী শহরের স্কুলে ফটিকের মত ছেলেকে ভর্তি করে দেওয়া কি ঠিক হয়েছিল তার মামার পক্ষে! এরকম অনেকগুলো প্রশ্ন মৃত্যুর সময় পাঠকের সামনে রেখে যায় ফটিক।
১২৯৮ এর ‘সাধনা’র পৌষ সংখ্যায় প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সম্পত্তি সমর্পণ’ ছোটগল্পটি বিচিত্র গল্প-১ এর অন্তর্গত। যঞ্জনাথ কুণ্ডুর মিতব্যায়িতা এমন জায়গায় পৌঁছায় যে ছেলে বৃন্দাবন কুণ্ডু পত্নী বিয়োগের পর সপুত্র গৃহছাড়া হয়। নিঃসঙ্গ যঞ্জনাথ একা থাকতে থাকতে ক্রমশ হাঁপিয়ে ওঠে। নাতি গোকুলচন্দ্রের অভাব, তার দুষ্টুমি টের পেতে শুরু করে। তাই সম্পূর্ণ অপরিচিত বালক নিতাই পালকে পেয়ে তিনি সগৃহে এনে তার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। গ্রামের লোকেরা যঞ্জনাথের এই আচরণে আশ্চর্য হয়ে গেলেন। তারা নিতাই পালের বাবার সন্ধানে উদগ্রীব হয়ে উঠলেন। এই উদ্বিগ্নতা নিতাইয়ের প্রতি তাদের ভালোবাসা বলে মনে হয় না বরং তারা ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠলেন এই ভেবে যে,
যঞ্জনাথ মৃত্যুর পর তার সমস্ত সম্পত্তি এই নিতাইকেই হস্তান্তর করে যাবে। যঞ্জনাথ খবর পেলেন নিতাইয়ের বাবা তার হারানো ছেলের খোঁজে তাদেরই গ্রামের দিকে আসছেন। ভয়ে যঞ্জনাথ বালক নিতাইকে এক মন্দিরের নিচে এক গর্তে তার গচ্ছিত সমস্ত ধন-সম্পত্তি সমেত লুকিয়ে রেখে উপরে উঠে মাটি চাপা দিয়ে দেন। তার আগে মন্ত্র উচ্চারণে যঞ্জনাথ নিতাইয়ের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করে নেন যে, যঞ্জনাথের পুত্র বৃন্দাবন, বৃন্দাবনের পুত্র গোকুল চন্দ্র কিংবা তাদের কোন উত্তরাধিকারী এলে নিতাই সেই সম্পত্তি সেই উত্তরাধিকারীর উপর সমর্পণ করতে বাধ্য থাকবে। নিতাইকে মন্দিরের নিচের রুদ্ধ ঘরে রেখে উপরে ওঠার সময় যঞ্জনাথ শুনতে পায়, নিতাই বলছে, ‘দাদা, আমি বাবার কাছে যাব।’ যঞ্জনাথ উপরে উঠে মই তুলে নিয়ে ছিদ্রমুখে পাথর চাপা দেওয়ার সময়
রুদ্ধকন্ঠে নিতাইয়ের শেষ ‘বাবা’ ডাক শুনতে পেলেন। উপরে উঠেও পিছন থেকে শুনতে পেলেন কেউ যেন ‘বাবা’ বলে ডাকছে। পিছনে তাকিয়ে দেখেন, তার পুত্র বৃন্দাবন কুণ্ডু তাকে ‘বাবা’ বলে ডাকছে। আরও জানতে পারেন, বাবার কিপটেমির ফলে সে নিজে তার নাম বৃন্দাবন কুণ্ডু পাল্টে দামোদর পাল আর তার পুত্র, যঞ্জনাথের নাতি গোকুলের নাম পাল্টে নিতাই পাল রাখে। মুহূর্তেই যঞ্জনাথের কাছে পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়। যঞ্জনাথের কৃতকর্মের ফলে অকালে প্রাণ হারায় কিশোর নিতাই পাল ওরফে গোকুলচন্দ্র কুণ্ডু। গোকুলের মৃত্যু এই প্রশ্ন তুলে দিয়ে যায়, পিতামহের কিপটেমির ফলে কেন একজন কিশোরের অকাল মৃত্যু হবে? প্রশ্ন রেখে যায় সম্পত্তি বড়, নাকি মানুষ বড়! সম্পত্তির জন্য মানুষ নাকি মানুষের জন্য সম্পত্তি! এখনও খবরের কাগজ কিংবা টিভির সংবাদে দেখি, সম্পত্তির লোভে কখনও পুত্র-পুত্রবধূ শ্বশুর-শাশুড়িকে গৃহহীন করছে, ভাই ভাইকে মারছে! বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেই কতকাল আগে বলে গিয়েছিলেন, ‘অর্থই অনর্থের মূল’। তাই-ই যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সম্পত্তি সমর্পণ’ গল্পের মধ্যে দিয়ে একালে এসে উপস্থিত হয়েছে, আর এখানেই গল্পটি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
ফটিক ও গোকুল ওরফে নিতাই– এই দুই কিশোর চরিত্রের মধ্যে প্রচুর সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। দুজনেই গ্রাম্য বালক। দুষ্টুমি নিত্য সঙ্গী।
গ্রামের বালকদের সর্দার ফটিক নদীর ধারে একটি বড় শাল কাঠ পড়ে আছে দেখে সেটিকে সকলে মিলে গড়িয়ে নিয়ে যাবে বলে স্থির করল। ফটিকের ভাই মাখনলাল এসে সেই শাল কাঠের উপর বসলে তারা দ্বিগুণ উৎসাহে ‘মারো ঠেলা হেঁইয়ো, সাবাস জোয়ান হেঁইয়ো’ বলে মাখনলাল সমেত শালকাঠটিকে ঠেলতে শুরু করল। শাল কাঠটি এক পা ঘুরতে না ঘুরতেই মাখন ‘ভূমিসাৎ হইয়া গেল’। ফটিক মাটি থেকে উঠে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি চলে গেল। মাখনলালের আঘাত সম্পর্কে উদাসীন ‘ফটিক গোটাকতক কাশ উৎপাটন করিয়া লইয়া একটা অর্ধনিমগ্ন নৌকার গোলুইয়ের উপরে চড়িয়া বসিয়া চুপচাপ করিয়া কাশের গোড়া চিবাইতে লাগিল।’ আবার কখনও ফটিক প্রকাণ্ড একটা ঢাউস ঘুড়ি নিয়ে উন্মুক্ত মাঠে দৌঁড়ে বেড়াচ্ছে, নদীতে যখন তখন
ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার কাটছে। এমনকি দলবল নিয়ে নানা রকম উপদ্রব করে বেড়াচ্ছে। এই যদি হয় ফটিক এবার তা’হলেয়দেখে নেওয়া যাক, গোকুল ওরফে নিতাইকে। গোকুল নিতাই নাম নিয়ে গ্রামে ফিরে অনতিবিলম্বে বালকদের সর্দার হয়ে উঠল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায়, ‘একজন অপরিচিত বালক গ্রামের ছেলেদের সর্দার হইয়া
উঠিয়া একটা সম্পূর্ণ নতুন উপদ্রবের পন্থা নির্দেশ করিতেছে। অন্যান্য বালকেরা তাহার চরিত্রের বল এবং কল্পনার নতুনত্বে অভিভূত হইয়া কায়মনে তাহার বয়স মানিয়েছে।’ অর্থাৎ দুই কিশোরই নিজগুণে দলনেতা হিসেবে অল্প বয়সেই নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। দুষ্টুমিতে গোকুল কম যায় না! কখনও অপরিচিত যঞ্জনাথের গায়ের কাছে গিয়ে চাদর ঝাড়া দেওয়ায় বন্ধন মুক্ত হয়ে একটা গিরগিটি তাঁর গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, কখনও বা যঞ্জনাথে কাঁধ থেকে গামছাটি খুলে নিয়ে নিজের মাথায় পাগড়ির মতো করে বাঁধে। পড়াশোনাতেও দু’জনেই সমান পারদর্শী! কেন নিতাই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এল, যঞ্জনাথ জিজ্ঞাসা করলে নিতাই উত্তরে বলে, ‘আমার বাপ আমাকে পাঠশালায় দিতে চায়।’ ফটিকের পড়াশোনা সম্পর্কে তার মা দাদাকে ফটিকের ‘পাঠে অমনোযোগ’ সম্পর্কে জানায়। মামার সঙ্গে কলকাতায় গিয়ে স্কুলে ভর্তি হলেও ফটিকের ‘একে তো সহজেই পড়া তৈরি হয় না,’ অন্যদিকে ‘মাস্টার প্রতিদিন তাহাকে অত্যন্ত মারধোর অপমান করিতে আরম্ভ করিলেন।’
অন্যদিকে তাদের দু’জনেরই মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। তাদের অকাল প্রয়াণে ফটিক বা গোকুল ওরফে নিতাই-এর নিজেদের কোন দায় ছিল না। ফটিক পিতৃহারা আর গোকুল বা নিতাই মাতৃহারা। দু’জনেই ছেলেবেলায় সংসারে পিতা-মাতার স্বাভাবিক স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়। মৃত্যুর সময় ফটিক খোঁজে তার মাকে আর নিতাই বা গোকুল খোঁজে তার বাবাকে। মা-কে কাছে না পেয়ে বিকারগ্রস্ত ফটিক বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ‘মা, আমাকে মারিস নে মা। সত্যি বলছি, আমি কোনো দোষ করিনি।’ আর অন্তিম মুহূর্তে ফটিক মৃদুস্বরে বলে, ‘মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।’
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct