পাশারুল আলম, আপনজন: আজকাল রাহুল গান্ধী একটি কথা বার বার বলে চলেছেন। তা হল, হিংসাকে প্রেম দিয়ে জয় করা। এই কথার মধ্যে কতটা যুক্তি ও আদর্শ রয়েছে? তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়। সমাজে হিংসার প্রভাব সর্বদা নেতিবাচক। হিংসা মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে, সম্পর্ক ভাঙে, এবং অস্থিরতা সৃষ্টি করে। যদিও হিংসার ক্ষতি অনেক সময় সাময়িক বলে মনে হয়, আবার এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব সমাজ ও ব্যক্তিগত জীবনে গভীরভাবে প্রোথিত হতে পারে। হিংসা শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। তবে এর সমাধান সম্ভব—আর তা আসে প্রেমের মাধ্যমে। বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রেমের ভূমিকা অপরিসীম।
আসলে প্রেম হিংসাকে দূর করার জন্য একটি শক্তিশালী অস্ত্র। প্রেম শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সম্পর্কেই নয়, বরং সমগ্র সমাজের মধ্যে শান্তি, সমঝোতা, এবং সহানুভূতির বীজ বপন করতে সক্ষম। যখন মানুষ প্রেমের মাধ্যমে তাদের চিন্তা-ভাবনা পরিচালিত করে, তখন তারা হিংসার প্রতি প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে সংযম ও সহানুভূতি প্রদর্শন করে। মননে ও চেতনায় প্রেমের উদয় হলে মানব মনে ধৈর্য্য ধারণ করার ক্ষমতা, সংযম ও সহানুভূতি বৃদ্ধি পায়। এই সংযম এবং সহানুভূতিই সমাজের শান্তি স্থাপনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
হিংসা মনের ভিতরে একাধিক উপায়ে প্রোথিত হতে পারে। যেমন সম্প্রদায়িক চিন্তা ভাবনা, অসহিষ্ণুতা, পারিবারিক জীবনে বঞ্চনা, অভিব্যক্তি প্রকাশে বাধা প্রদান। এই সমস্ত বিষয় মানুষকে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু থেকে বিভ্রান্ত করে। এমতবস্থায় প্রেম হিংসাকে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। একজন মানুষ যখন অপরের প্রতি সহানুভূতি ও ভালোবাসা প্রকাশ করে, তখন সেই সম্পর্ক বন্ধুত্ব ও বিশ্বাসের মাধ্যমে গড়ে ওঠে। এতে করে সমাজের মধ্যে যে হিংসার বীজ, তা নষ্ট হয়ে যায়। এই বন্ধন শুধু দুই ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং তা পরিবারের, সমাজের এবং সমগ্র জাতির ওপর প্রভাব ফেলে।
মানুষের মধ্যে নানাবিধ বন্ধন সৃষ্টি করে। যেমন পারিবারিক বন্ধন, আত্মীয়তার বন্ধন সামাজিক বন্ধন, সর্বপরি দেশপ্রেম। প্রেমের মধ্য দিয়ে যে সহানুভূতি এবং বন্ধন সৃষ্টি হয়, তা অন্যান্য বন্ধন থেকে অনেক বেশি আন্তরিক ও সুদৃঢ়। এই প্রেম মানুষকে হিংসা থেকে দূরে রাখে। একটি সমাজ যখন সহানুভূতি এবং সহযোগিতার মাধ্যমে পরিচালিত হয়, তখন হিংসা ও বিদ্বেষের জন্য সেখানে কোন স্থান থাকে না। প্রেম আমাদের মানসিক ও নৈতিক দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে এবং অন্যের কষ্টের প্রতি আমাদের সংবেদনশীল করে তোলে। এই সংবেদনশীলতাই মানুষের মধ্যে সহানুভূতির সৃষ্টি করে, যা সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
সমাজে হিংসা ছিল, হিংসা আছে, হয়তো আগামী দিনেও থাকবে। কিন্তু যখন একটি ক্ষমতা সম্পূর্ণ ব্যক্তি, একটি বিশেষ শক্তি, একটি বিশেষ আদর্শ, একটি বিশেষ গোষ্ঠী হিংসা সমাজে হিংসা ছড়ানোর প্রয়াস করে তখন সেই হিংসাকে প্রতিহত করার এক অমূল্য অস্ত্র হল প্রেমভাব। আসলে এই হিংসার
মূলে রয়েছে আক্রোশ, অহংকার, এবং ক্ষমতার লোভ। কিন্তু প্রেম সবসময় নির্ভর করে সহযোগিতা, শান্তি, এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার উপর। প্রেমের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি নিজেকে হিংসার থেকে মুক্ত রাখতে পারে এবং অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল ও সহায়ক হতে পারে। সমাজের বিশিষ্ট সমাজ সেবকরা যখন সমাজকল্যাণের জন্য নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করে, তখন তাদের মধ্যে এই ক্রিয়াটি ব্যাপক আকারে কাজ করে। এই মানবিক ক্রিয়ার ফলে তার মধ্যে একটি শক্তির উদয় হয়। এটি এমন শক্তি যা সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রভাব ফেলে। সমাজের নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত, প্রত্যেকেই প্রেমের মাধ্যমে হিংসাকে প্রতিহত করতে পারে। যখন সমাজের প্রতিটি সদস্য প্রেমের চর্চা করে এবং অন্যের কল্যাণের জন্য কাজ করে, তখন সেই সমাজে হিংসা দূর হয়ে যায়। তাই প্রেমের বিকল্প আর কিছু নেই।
প্রেমের মাধ্যমে হিংসা জয় করা সম্ভব। প্রেম শুধু সম্পর্কের উন্নতি করে না, এটি সমাজের মধ্যে ঐক্য, শান্তি, এবং সহযোগিতা ও সম্প্রীতি সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রেমের শক্তি আমাদের একে অপরের প্রতি দায়বদ্ধতা অনুভব করতে সাহায্য করে এবং আমাদের ভিতরের হিংসাকে দমন করে। একটি প্রেমময় সমাজের মাধ্যমে আমরা হিংসার সকল রূপকে পরাজিত করতে পারি এবং একটি সুখী ও শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গড়তে পারি। এই মানবিক চেতনা প্রস্ফুটিত করার জন্য সামাজিক ক্ষেত্রে এক ব্যাপক জন - আন্দোলনের প্রয়োজন। শিক্ষা ক্ষেত্রে, রাজনীতির ক্ষেত্রে, সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রেমকেই প্রচারিত ও প্রসারিত করতে হবে। শৈশব মনে প্রেম, সহানুভূতি ও ভালোবাসা বিস্তার ঘটানোর জন্য এমন এক সিলেবাস প্রণয়ন করতে হবে যেখানে শৈশব থেকেই শিশু মনে প্রেমের উদয় হয়। শৈশবে যাদের মধ্যে প্রেম, সহানুভূতি, ভালবাসা, আন্তরিকতা, সততা ও নিষ্ঠা ছিল, তারাই ভবিষ্যতে মহামানব হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। এই সত্যকে সামনে রেখে আমরা যদি সমাজ গড়ার কাজে নিয়োজিত হই তাহলে হিংসা পরাজিত হবে। এখনো আমাদের হাতে যথেষ্ট সময় আছে। এই দিকে মনোনিবেশ করলে আমরা আমাদের সমাজকে হিংসামুক্ত করতে সক্ষম হব।
পরিশেষে বলা যায়, প্রেমের মাধ্যমে হিংসা জয় করার গুরুত্ব অপরিসীম। এটি ব্যক্তির হৃদয়ে শান্তি ও সহানুভূতি সৃষ্টি করে, যা সমগ্র সমাজকে প্রভাবিত করে। যখন সমাজে প্রেমের চর্চা বৃদ্ধি পায়, তখন হিংসার স্থান ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসে। তাই, একটি উন্নত, শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ার জন্য আমাদের প্রত্যেককে প্রেমের শক্তি দিয়ে হিংসার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।
**মতামত লেখকের নিজস্ব
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct