মোহাঃ মোজাম্মেল হক: রবিন্দ্রানাথ ঠাকুর তাঁর ‘শিক্ষার মিলন’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন- ‘বর্তমান যুগের সাধনার সঙ্গেই বর্তমান যুগের শিক্ষার সংগতি হওয়া দরকার’। বর্তমান যুগে আদৌ কি সেই লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়? গুরুদেব এখানে সাধনার কথা বলেছেন। সাধনা হল সর্বোচ্চ সক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ। বর্তমান যান্ত্রিক যুগের প্রযুক্তি এতই উন্নত যে, ইন্টারনেটের কল্যাণে যে কোন তথ্য সংগ্রহ ও প্রেরণ সহজলভ্য। ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত একটি স্মার্টফোন যেন একটি গ্রন্থাগার। কিন্তু প্রশ্ন হল এই ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করা তথ্যকে প্রক্রিয়াজাত করে জ্ঞানে রূপান্তরের এবং জ্ঞানকে প্রক্রিয়াজাত করে প্রজ্ঞার স্তরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য যে সাধনার প্রয়োজন আমাদের অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা শিশু-কিশোর বা এই প্রজন্মকে কি তার প্রতি উৎসাহিত করে?
বর্তমানে স্মার্টফোন শিশু-কিশোরদের জীবনের সিংহভাগ সময়কে দখল করে নিয়েছে। করোনার অতিমারিতে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার প্রতি তাদের সাধনা ও সঠিক মূল্যবোধ তৈরির বীজ অঙ্কুরেই বিনষ্ট হচ্ছে। অনলাইন ক্লাসের অজুহাতে স্মার্টফোন, ট্যাব, টেলিভিশন, ও বিভিন্ন ডিভাইস সহ ইউটিউব ও টিভিতে তারা সময় কাটাচ্ছে। ফলে অনলাইন গেম ও বিভিন্ন ধরনের ভিডিও গেমের মারণব্যাধি তাদের চিন্তা চেতনা ও মনকে আচ্ছন্ন করেছে। এই সমস্যা বিশ্বজুড়ে। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৮ সালেই শিশু-কিশোরদের মোবাইল আসক্তি নিয়ে এক বিশেষ গবেষণার পর ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজের ১১তম সংস্করণে ‘গেমিং এডিকশন’ হিসাবে একে মনোস্বাস্থ্য সমস্যা বলে আক্ষায়িত করেছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন শিশু কিশোরদের হাতে স্মার্টফোন দেওয়ার অর্থ হল তাদের হাতে এক বোতল মদ কিংবা এক গ্রাম কোকেন দেওয়া। কারণ স্মার্টফোনের আসক্তি মাদকাসক্তির মতই বিপজ্জনক। এই স্মার্ট ডিভাইসের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার তাদের মস্তিস্কে হাইপার অ্যাক্টিভিটি সৃষ্টি করে। যা দীর্ঘ সময় ধরে তাদের মস্তিষ্কে বিরাজ করে। যার কূফল স্বরূপ শিশু-কিশোরদের স্নায়ু দুর্বুল হয়। নিদ্রাহীনতায় তাদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। রক্তের চাপ বাড়ে ও দেহ-মন নিস্তেজ হয়ে পড়ে। মোবাইলফোনের সুইচ সেন্টার, বেইস স্টেশন ও স্ক্রীন রেডিয়েশন তাদের মস্তিষ্কের বিকাশকে ব্যহত করে। এ প্রসঙ্গে সানি’স স্কুল অব পাপলিক হেলথের ডিন ডেভিড কার্পেন্টার বলেন, খুব শিঘ্রই আমরা হয়তো একটি মহামারি রোগের শিকার হতে পারি এবং সেটি হবে মস্তিষ্কের ক্যান্সার। গবেষণায় এও জানা যায় যে মোবাইল ব্যবহার শিশুদের শ্রবণ ক্ষমতাও হ্রাস করে দেয়। প্রখ্যাত রেডিয়েশন গবেষক কোরি ক্রফটন বলেন, ১৮ বছরের কম বয়সীদের মোবাইলফোন ব্যবাহার করা উচিত নয়। কারন মোবাইলফোনের রেডিয়েশন একটি ক্রনিক পদ্ধতি যা শিশু-কিশোরসহ সমস্ত ব্যবহারকারীর মস্তিষ্ককে কুরে কুরে খায়। মনে রাখতে হবে এই উন্নতমানের প্রযুক্তির আবিষ্কার আমাদের জীবনযাত্রাকে সহজ করার জন্য। এর ব্যবহারের নির্দিষ্ট একটি মাত্রাও আছে। কিন্তু এর উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা শিশু-কিশোরদের জীবনকে জটিল না করে তার প্রতিও খেয়াল রাখতে হবে।
বর্তমানে প্রত্যেক পরিবারের অভিভাবক তাদের শিশুদের শান্ত রাখার জন্য হাতে হাতে বিভিন্ন ধরনের স্মার্টফোন ও ট্যাব ধরিয়ে দেন। গান, কার্টুন বা মজার ভিডিও চালিয়ে দিয়ে শান্ত করেন। স্মার্টফোনের কল্যাণে শিশুদের শান্ত রাখা খাওয়ানো এমনকি বর্ণমালা ও ছড়া শেখানোর কাজটিও অনেক সহজ হয়। যার ফলে মোবাইল গেম ও ইউটিউবের প্রতি শিশুর আসক্তি বাড়ে। এই আসক্তি ধীরে ধীরে তার কচি মনকে আচ্ছাদিত করে। ফলে তার লেখাপড়াও ব্যহত হয়।
শিশুরদের শারীরীক, মানুষিক, সামাজিক, নৈতিক, মানবিক, নান্দনিক, আধ্যাত্মিক ও আবেগের বিকাশ সাধন এবং তাদের দেশাত্মবোধ, বিজ্ঞানমনস্কতায় ও সৃজনশীলতায় ও উন্নত জীবনের স্বপ্নদর্শনে উদ্বুদ্ধ করার দায়িত্ব যেমন শিক্ষকের তেমনি মাতাপিতারও। তাদের সার্বিক উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য পিতামাতা কে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। এই যান্ত্রিক যুগে বিভিন্ন ডিভাইস সহ স্মার্টফোনের সুফল ও কুফল সম্পর্কে অনুশাসনের সুরে তাদেরকে সাবধান করতে হবে। অনলাইন লেখাপড়ায় ট্যাব, ল্যাপটপ, স্মার্ট ফোনের ব্যবহার পিতামাতার সামনেই করতে হবে। এর জন্য নির্দিষ্ট সময় করে দিতে হবে। অপব্যবহারের যেন কোন সুযোগ না থাকে তা সুনিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া এই সব ডিভাইেরস অতিরিক্ত ব্যবহার থেকে বিরত থকার উপায় হল বাড়িতে তাদের বেশি বেশি সময় দেওয়া, তাদের লেখা পড়ার মান নির্ণয়ে ঘরোয়া অনুষ্ঠান করে তাদের পুরস্কৃত করা। তাদের সাথে খওয়া দাওয়া ও বিভিন্ন শিক্ষামূলক গল্প করা, খেলা ধূলার প্রতি তাদের উৎসাহিত করা। খোলা মাঠ অথবা নয়নাভিরাম জায়গার দর্শন করানো।
শিশুরা ফোন চায়লে বা শখ করে পিতামাতা কর্মব্যস্ততার দোহায় দিয়ে তাদের হাতে ফোন দিলে তারা ইচ্ছামত ব্যবহার করবে। অনেকেই শিশুর বায়না পূরণে স্মার্টফোন কিনে দেন। এটা কোন স্মার্টনেস নয়। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলিতে ইন্টারনেট ব্যবহারের দৈনিক সময়সীমা নির্ধারিত করা আছে। এছাড়া ব্যবহারকারীদের উপর নিয়মিত নজরদারি করা হয়। আমাদের দেশে এসবের কোন বালাই নেই। সন্তান আপনার। আপনাকেই সাবধান হতে হবে। বিভিন্ন ওষুধের মোড়োকে লেখা থাকে ‘শিশুদের নাগালের বাইরে রাখুন’ ঠিক একই ভাবে পিতামাতার মনে লিখে নিতে হবে ‘শিশুদের ফোন থেকে দূরে রাখুন’। কীভাবে দূরে রাখতে হবে তা সবার জানা। মনে রাখতে হবে স্মার্টফোন থাকলেই স্মার্ট হওয়া যায়না, প্রযুক্তির অভিষাপ থেকে নিজে ও পরিবারকে সুরক্ষিত রাখাই হল প্রকৃত স্মার্ট।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct