তবে ছোট হওয়াই ভালো
এরসাদ মির্জা
বিকেল তখন পাঁচটা বেজে পাঁচ মিনিট। বহরমপুর কোর্ট রেলস্টেশন যথারীতি গমগম করছে। এক ও দুই নম্বর প্ল্যাটফর্ম জুড়ে থিকথিক করছে মানুষের ভিড়। বালি-পাথর-সিমেন্টে গড়া বেঞ্চে বসে কেউ কেউ মোবাইল ঘাঁটছে, কেউ কেউ কাঁধে ব্যাগ ও হাতে ছোট-বড় ট্রলি ধরে দল বেঁধে গল্প করছে আর কেউ কেউ বা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ডানে বামে ঘনঘন নজর ফিরিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে ট্রেন আসার আভাস। প্রায় একই সাথে এক ও দুই নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে ভিড়বে বিপরীত অভিমুখী দুটি ট্রেন। পাঁচটা পনেরই আপ শিয়ালদা-লালগোলা প্যাসেঞ্জার। সে ছেড়ে যাওয়ার পাঁচ মিনিটের মাথায় দুই নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে পৌঁছাবে ডাউন লালগোলা-কলকাতা হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেস। শহর হতে মানুষদের ঘরে ফিরিয়ে আনবে একটা ট্রেন আর অপরটা শহরে নিয়ে গিয়ে ছাড়বে! বরাবরের মতো আজকের স্টেশনের চিত্রটাও কোনরূপ ভিন্ন ছিল না। প্ল্যাটফর্ম জুড়ে বিরাজ করছে মানুষ আর মানুষ। আমিও প্রতিবারের মতো একা একা হেঁটে এসে, মানুষের ভিড় ভেদ করে, স্কেলেটর চড়ে ওভারব্রিজে উঠলাম এবং সিঁড়ি বেয়ে দুই নম্বর প্ল্যাটফর্মে গিয়ে নামলাম। তারপর ডিসপ্লে বোর্ডে নজর ফিরিয়ে ডি-৩ বগির অবস্থান লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলাম সেখানে। আশেপাশের সিটগুলো সব অধিকৃত। বহু মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমিও নীরবে শামিল হয়ে গেলাম তাদের দলে। কেউ টেরই পেল না আমার উপস্থিতি! অপেক্ষা করতে থাকলাম ট্রেন আসার। যেহেতু আমি একা ছিলাম, তাই গল্প করে সময় কাটানোর কোনো উপায় আমার ছিল না। বিধায় নজর ফিরিয়ে দেখতে থাকলাম চারপাশের মানুষদের- তাদের ভিন্ন ভিন্ন ড্রেস-কোড, ভিন্ন রকম অ্যাক্টিভিটিজ ও কথা বলার ভিন্ন ভিন্ন ধরন প্রভৃতি। শেষে নজর এসে ঠেকল আমার একদম ডানপাশে দণ্ডায়মান এক ‘ইয়ং কাপল্’ এর উপর। বছর ছাব্বিশের শ্যামবর্ণ ছেলেটির মুখে হালকা ট্রিম্ড দাড়ি, পরনে ইন-করা সাদা শার্ট ও নেভি ব্লু ট্রাউজার, আর পাশে হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে তার স্ত্রী। মেয়েটির আপাদমস্তক কালো বোরকায় ঢাকা, শুধু স্বামীর হাত ধরা তার মেহেন্দি মাখা হাতের লম্বা সরু সরু আঙুলগুলি ও বাঁকা ভ্রুয় সজ্জিত ফালাফালা চোখদুটি বোরকা ফেড়ে বাইরে উঁকি মেরে দেখছে। জানান দিচ্ছে তার দুধে আলতা গায়ের রঙ ও অসম্ভবরকম রূপ-সৌন্দর্য্যের!
এদিক ওদিক আর চোখ মেলে দেখার প্রয়োজন বোধ করলাম না। নজর স্থির করলাম ওই ‘ইয়ং কাপল্’ এর উপর। দেখি, ছেলেটি ফিসফিস করে কিছু বলছে মেয়েটির কানে আর মেয়েটি গা কাঁপিয়ে চাপা হাসি হাসছে আর দিঘল দিঘল চোখ দিয়ে অদ্ভুত রিয়াক্ট করছে। ওহ্! কী সুন্দর কথা বলে মেয়েটির চোখদুটি! বিনিময়ে ছেলেটিও মুচকি হেসে উঠছে আর শক্ত করে ধরছে হাতের বাঁধন। আহ্! কী অমায়িক কেমেস্ট্রি তাদের! কী অদ্ভুত ভালবাসা তাদের মাঝে! অন্যমনস্ক হয়ে পড়লাম আমি। শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম তাদের পানে আর ভাবতে লাগলাম- ‘কবে আসবে এই দিন! পাশে থাকবে এমন একটা মেয়ে, এমনভাবেই হাতে হাত রেখে! বয়স তো হয়ে গেল।’ হ্যাঁ, এই প্রথম মনে হল, ‘কেউ আসুক আমার জীবনে, আমার কাউকে দরকার, আমি বড় হয়ে গেছি।’ হঠাৎ চেতন ফিরল। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে কানে ভেসে এলো- ‘সা’দ, ওদিকে দেখ!’ দেখলাম, বোরকা পরা মেয়েটি ছেলেটিকে হাতের ইশারায় বাঁদিকে কিছু দেখাচ্ছে। সেদিকে নজর ফেরালাম। লক্ষ্য করলাম, অদূরে মাঝবয়সী একজন মানুষ ‘দাদা-দিদিগো... ভগবানের নামে আমাকে একটু সাহায্য করো গো!’ বলে ব্যথাতুর কণ্ঠে, চোখের পানি ঝরিয়ে সবার কাছে হাত পেতে ভিক্ষা করতে করতে এগিয়ে আসছে। বাঁ পায়ে তার বেশ বড় একটা কাটা দাগ, পাশে পাশে থকথকে ঘা স্পষ্ট দেখা দেখাচ্ছে। ব্যথিত হলাম তার করুণ অবস্থা দেখে। যার কাছেই সে এগিয়ে আসছে, সেই পিঠ ফিরে দাঁড়াচ্ছে। বহু মানুষের পাশ ঘেঁষে ঘেঁষে সে এলো কিন্তু কেউ তার সাহায্যে এগিয়ে এলো না। আমি ভাবুক হয়ে চেয়ে থাকলাম তার দিকেই। হঠাৎ কানে এলো- ‘উফ্! লোকটার কি কষ্ট, তাই না, সুফিয়া?’ ছেলেটি বোরকায় আচ্ছাদিত তার স্ত্রীকে বলল।
এতক্ষণ আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আমার সামনের এই আকর্ষণীয় ‘ইয়ং কাপল্’কে অর্থাৎ সা’দ ও সুফিয়া জুড়িকে। কী মিল তাদের! নামে মিল মনেও মিল! নজর দিলাম সুফিয়ার খোলা চোখদুটির দিকে। দেখলাম, অপলকে সে চেয়ে আছে লোকটার পানে। তার চোখে নেই আর আগের মতো ঝলক। নিমেষে কেমন নিষ্প্রভ হয়ে গেছে, সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। ‘কেউ ওকে টাকা দিচ্ছে না কেন, সা’দ?’ ব্যথাভরা কণ্ঠে শুধাল সুফিয়া। চোখ তার ছলছল করে উঠল। হৃদয়টা আমারও কেমন হয়ে গেল। ফিরে দেখলাম লোকটার দিকে। এক পায়ে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে সে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকেই, সবার কাছে হাত পাততে পাততে। ‘ওর পায়ের অবস্থা দেখে সবাই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, টাকা দিবে কী করে!’ উত্তর দিল সা’দ। ‘এতোটাই কি বীভৎস দেখাচ্ছে? এতোটাই কি অরুচিকর মনে হচ্ছে যে, তার দিকে ফিরে দু’চার টাকা দেওয়াও যাবে না?’ ক্ষোভ প্রকাশ পেল সুফিয়ার গলায়। ‘বিষয়টা হয়ত তেমন না, কিন্তু যে-ই তাকে আগে টাকা দিবে, সমস্ত চোখ তার উপর পড়বে, সবাই হয়ত তাকে একটু রুচিহীন মনের ভাববে, এই ভয়েই হয়ত কেউ আগে বাড়ছে না!’ মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ করল সা’দ। বিষয়টি আমাকেও একটুখানি ভাবাল। নিজের মনের ভেতর ঝেঁকে দেখলাম, বিষয়টি ভুল বলেনি সা’দ। আমার মনেও তেমনই কিছু চলছিল- ‘লোকে কী ভাববে!’।
লোকটা হাত পাতছে সবার কাছে। সবাই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। সে এগিয়ে যাচ্ছে অন্যজনের দিকে, সবাই তখন পেছন থেকে ফিরে দেখছে তাকে। ‘তুমি ঠিকই বলেছ, সা’দ। “লোকে কী ভাববে” ভেবেই কেউ তাকে টাকা দিচ্ছে না। নাতো দেখ সবাই কেমন তাকে ফিরে ফিরে দেখছে।’ বলল সুফিয়া। তারপর উদ্বিগ্ন কণ্ঠে আবার বলল, ‘কিন্তু এমনই যদি হয়, তবে তো লোকটার কোনো লাভই হবে না!’ ঠিক তখনই কানে এলো লোকটা জোরে জোরে কারো জন্য মঙ্গল কামনা করছে। ফিরে দেখি, আমাদের পাশের আসনে বসা টুপি-পাঞ্জাবী পরা এক মৌলভি সাহেবের বছর পাঁচ-ছয়ের ছোট্ট এক বেটা হাতে একটি দশ টাকার নোট নিয়ে লোকটার দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। মনে মনে বললাম, ‘যাক, কেউ তো দিল!’ তখনই পাশ থেকে সা’দের কণ্ঠে শুনতে পেলাম, ‘ছোট্ট ছেলে তো! একটু বড় হলে ওরও দ্বিধাবোধ করত, দিত না!’ ফিরে দেখলাম তার দিকে। তখনই নজরে পড়ল, চোখদুটোকে বেশ বড় বড় করে সুফিয়া তাকে বলছে, ‘তবে তো ছোট হওয়াই ভালো!’ দিয়ে একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, ‘কিন্তু তুমিই বা আবার কত বড়, হ্যাঁ?’ বলে হাত দিয়ে সা’দের দৈহিক উচ্চতার দিকে ইশারা করল। তারপর বলল, ‘তুমিও ছোটই আছো, লোকটাকে দু’চার টাকা দিতেই পারো...’ বলে দুষ্টু হাসি হেসে উঠল। তার স্বামীর হাতে পেঁচানো বাঁধনটা শক্ত করল। তার খিলখিল হাসির আওয়াজ আমার কানে এসে বিঁধল। দেহ-মন উথলা করে তুলল। মনে হল, এমন কাউকে জীবনে পাওয়ার জন্য আমি এখন বড় হয়েছি, বেশ বড়! তখনই দেখলাম, সা’দ বিশ টাকার একটা নোট হাসিমুখে লোকটাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর পেছনে সুফিয়ার চোখেমুখে আবার সেই পুরানো ঝলক, খুশি ও উৎফুল্লাতার ছাপ স্পষ্ট! তখনই বোধ হল নিজের উচ্চতার কথাও। চোখ মেলে একবার নিজেকে দেখলাম। সা’দের মতোই উচ্চতা, ছোটখাটো। পকেটে হাত ভরে একটা নোট বের করলাম। বাড়িয়ে দিলাম লোকটার দিকে। সে মুখ উচু করে আমার জন্য মঙ্গল কামনা করতে লাগল। আর আমি পাশের ছোট্ট ছেলেটির দিকে আবেগভরা নয়নে ফিরে দেখলাম। আর নিজের অজান্তে মুখ থেকে অস্ফুটে উচ্চারণ হল- ‘তবে ছোট হওয়াই ভালো!’।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct