দিলীপ মজুমদার: আমাদের পাড়ার কমরেড কচি লালপার্টির একনিষ্ঠ কর্মী। নেতাদের কথা তিনি বেদবাক্য বলে মনে করেন। প্রতিটি মিছিল, মির্টিং-এ যোগ দেন। করোনার সময়ে রেড ভলেন্টি্যার্সের তালিকাতেও আছেন তিনি। এবার বিধানসভা ভোটের আগে কমরেড কচিকে বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। একদিন তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘কী কমরেড, কী বুঝছেন?’ কমরেড কচি বলেছিলেন, ‘এবার আমরা অনেক নতুন মুখকে প্রার্থী করেছি। এই তরুণ ব্রিগেড আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে অনেকদূর, দেখবেন। ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের সভায় জনসমাগম দেখেছেন?’
আমি বললাম, ‘ব্রিগেডের ভিড় দেখে খুব কিছু আশা করবেন না।’
কচি অবাক হয়ে বললেন, ‘বলেন কী? মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততা দেখছেন না?’
আমি বললাম, ‘২০১৬ সালেও আপনারা এসব বলেছিলেন। ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে এসে মঞ্চের তলায় দাঁড়িয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কী বলেছিলেন মনে আছে? বলেছিলেন, এত মানুষ আমাদের ভোট দিলে জয় নিশ্চিত, কিন্তু এঁরা সবাই ভোট দেবেন কী।’
-‘কিন্তু ২০২১এ পরিস্থিতি আলাদা।’
আমি বললাম, ‘ তা ঠিক। এবার প্রধান বিরোধী পক্ষ বিজেপি।’
-‘ তাই আমাদের লড়াই তৃণমূল আর বিজেপির বিরুদ্ধে। দুজনেই প্রধান শত্রু। দুই দলই সাম্প্রদায়িক। একদল এক সম্প্রদায়কে তোষণ করে, অন্যদল ভিন্ন সম্প্রদায়কে তোষণ করে।’
কমরেডকে একটু রাগিয়ে দেবার জন্য বলি, ‘কিন্তু ভোটের আগে আপনাদের সভাটভায় যেসব বক্তৃতা করতেন নেতারা, তাতে তৃণমূলকে বেশি আক্রমণ করা হত। বিজেমূল বলে একটা শব্দও আপনারা আবিষ্কার করেছিলেন। তৃণমূল বা বিশেষ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর আপনাদের এত রাগ কেন বলুন তো? আমার তো মনে হয়, সে রাগ যতটা রাজনৈতিক, তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যক্তিগত। একা এক নারী ২০১১ সালে আপনাদের মৌরুসি পাট্টা উপড়ে ফেলেছিলেন বলেই আপনাদের অহংএ বড্ড লেগেছে। আপনারা সে ক্ষতকে ভুলতে পারছেন না।’
কমরেড কচি আমার বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছিলেন। তারপরে ২রা মে ফল গণনা হল। তৃণমূলের জয়জয়কার। বিজেপি প্রধান বিরোধী দল। বাম আর কংগ্রেস শূন্য। তাঁদের জোটের আব্বাস সিদ্দিকির দল পেয়েছে মাত্র একটি আসন। দিনকয় পরে বাজারে যাবার পথে দেখা হল কমরেড কচির সঙ্গে। দেখা হতেই তিনি বললেন, ‘বিজেমূল? সব ভুল, সব ভুল।’
বললাম, ‘স্বীকার করছেন তাহলে?’
-‘উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে ছিলাম, বুঝলেন। এভাবে তো ঝড় ঠেকানো যায় না। বুঝেছি ভ্রান্তিবিলাস সাজে না দুর্বিপাকে। ফাটা ডিমে আর তা দিয়ে কী হবে?’
সমবেদনার সুরে তাঁকে বলি, ‘কিন্তু ভাই, দোষটা আপনাদের মতো কর্মীদের নয়। নেতাদের। এঁরাই আপনাদের চোখে ঠুলি পরিয়ে রেখেছেন। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা একটা ছেলেভোলানো কথা। নেতারাই সব সিদ্ধান্ত নেন। ক্যাসাবিয়াঙ্কাসদৃশ কর্মীদের তা মানতে হয়।’
কমরেড কচি বললেন, “এসব বোঝার জন্য ‘চোখে আঙুল দাদার’ দরকার ছিল। তন্ময়দা আর কান্তিদা সেই চোখে আঙুলদাদা হয়ে উঠলেন। পরমাণু চুক্তিকে নিয়ে ইউ পি এ ত্যাগ, জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হতে না দেওয়া, সোমনাথ চ্যাটার্জীকে অপমান করা, এ রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট, আব্বাস সিদ্দিকিদের জোটে ভেড়ানো, এসব নেতাদের সিদ্ধান্ত, সাধারণ কর্মীদের মতামতের তোয়াক্কা করেননি নেতারা।’
বললাম, ‘তাহলে কী করবেন এখন? দল ছাড়বেন?’
কমরেড কচি বললেন, ‘সেটা সম্ভব নয়। তবে এটাও বুঝতে পারছি যে আন্তঃপার্টি সংগ্রামও এ মুহূর্তে সম্ভব নয়। সংসদীয় গণতন্ত্র আর সমাজবিপ্লবের মাঝে আমাদের দোল খেয়ে যেতে হবে।’
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct