মনিরুদ্দিন খান: (গতকালের পর) সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, পূর্বোক্তনামগুলির কোনোটির ক্ষেত্রেই ‘ইসলাম’, ‘হক’, ‘আহমেদ’, ‘খাতুন’ - এর কোনোটিই পদবি নয়। বর্তমানে নাম লেখার ক্ষেত্রে আমাদের সরকারী নানা অফিস-আদালতে অনুসৃত ইংরেজি রীতি অনুযায়ী এগুলিকে ‘মিডিল নেম’ বলা যেতে পারে। কিন্তু সম্প্রতি প্রায় সর্বত্র কম্পিউটার ব্যবহার হওয়ায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে টাইটেল অথবা ‘লাস্ট নেম’ পূরণ না করলে কম্পিউটার নাম লেখার প্রক্রিয়াটি অসম্পূর্ণ হিসাবে দেখায় এবং উদ্দিষ্ট কাজটি সম্পূর্ণ করা যায় না। তখন ‘মিডিল নেম’টিকে টাইটেলের ঘরে লিখে দিলে প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হয়। তার মানে এই নয় যে ওটা তাদের টাইটেল বা পদবি। তাদের নামের শেষে বা ব্যতিক্রম হিসাবে নামের প্রথমে সেখ, সৈয়দ, খাঁ, মন্ডল, বিশ্বাস, সরকার বা আরো অন্য কিছু পদবি থাকতে পারত। কিন্তু তা এখানে লেখা হয়নি। বাংলার মুসলমানরা যেহেতু সিংহভাগই হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত তাই এখানে বহু মুসলমানের নামে হিন্দু পদবি দেখা যায়। এমনকি মুসলমানদের মধ্যে ‘ঠাকুর’ পদবিও আছে। যতদূর মনে পড়ছে, বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের হত্যাকাণ্ডে যাদের নামে অভিযোগ ছিল বা আছে, তাদের মধ্যে একজনের পদবি ‘ঠাকুর’, যদিও ধর্মে মুসলমান। এছাড়া, দেশের পূর্ববর্তী মুঘল ও ব্রিটিশ সরকার দ্বারা দেওয়া পদমর্যাদাসুচক ‘চৌধুরী’, ‘মজুমদার’, ‘দেওয়ান’, ‘দফাদার’ ইত্যাদি নানা পদবি হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে আজও বংশ পরম্পরায় ব্যবহৃত হয়।
যাই হোক, মুসলিম পুরুষের নামের আগে মহম্মদ বা সংক্ষেপে মহঃ (ইংরেজিতে Md.) ও মুসলিম বিবাহিতা মহিলাদের নামের সঙ্গে ‘বিবি’ উল্লেখ করাটা বোধহয় সম্পূর্ণরূপে ভারতীয় উপমহাদেশে অনুসৃত একটি রীতি। পুরুষের ক্ষেত্রে নবী মহম্মদের প্রতি ভক্তিবশত বা তাঁর অনুসারী হিসাবে প্রচার করতে নিজের নামের সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে নেওয়ার প্রথা হয়ত শুরু হয়েছিল - যা এখন বুঝে বা না বুঝেই ব্যবহৃত হয়। আর মহিলাদের ক্ষেত্রে ‘বিবি’ কথাটি ‘বিবাহিত’ বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। ‘বেগম’ কথাটির অর্থও ‘স্ত্রী’। অনেকে এটিও ব্যবহার করেন। আবার অনেক মেয়েদের অভিভাবকেরা ‘বেগম’ -এর অর্থ না জানায় তাদের অবিবাহিতা মেয়েদের নামেও ‘বেগম’ যোগ করে নাম রাখেন।
সমস্যার বিষয় হল, শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা মুসলিমরা যেমন নিজেদের নামের বিষয়ে অজ্ঞতা ও অযত্নের ফলে তিন জায়গায় তিন রকম নাম লিখে রাখে, তেমনি স্কুল-কলেজে ও বহু সরকারী অফিসে এই আরবী /উর্দু নামগুলির বিষয়ে এতটাই অশ্রদ্ধা ও অসূয়া পোষণ করা হয় যে সহজে উচ্চারিত নামের বানানেও নানা ভুলভ্রান্তি করা হয়ে থাকে। তার ফলে ভুল বানান যার নামে তাকে অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হয়। নামের সেই ভুল বানান সংশোধনের জন্য নানা জায়গায় ছুটাছুটি ও তদবীর করার মতো বিদ্যা ও অর্থের সামর্থ্য অনেকেরই নেই। আবার শিক্ষিত ও আর্থিক সামর্থ্য সম্পন্ন মানুষও নানা নথিতে নামের নানা ভুল নিয়ে বছরের পর বছর এ অফিস সে অফিসে ঘুরে ভেড়াচ্ছেন - সে উদাহরণও চোখের সামনেই দেখা যায়।
(সমাপ্ত)
লেখক বিশিষ্ট সমাজ বিশ্লেষক
আরও পড়ুন: