অনুতপ্ত
গোলাম মোস্তাফা মুনু
___________________
জামিল শেখ জোহরের নামাজ না পড়েই শুয়ে যায়। আজ তার মন ভালো করছে না। মনের মধ্যে যেন তার অশান্তি। সে লজ্জায় কাউকে কিছু বলতেও পারছে না। শুয়ে শুয়েই তার নানির কথা মনে পড়ে যায়। নানি জামিলের মাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘জামিলকে মাদ্রাসাতে রেখে চলে আয়। তুই তো তিনবেলা ওদেরকে ভাল করে খেতে দিতেও পারছিস না। না খেয়ে খেয়ে আর কতদিন থাকবে! যদি ওকে মাদ্রাসায় ভর্তি করে চলে আসিস, তাহলে মাদ্রাসার শিক্ষক ওর খাবারের ব্যবস্থা করে দেবে। ওরা লোকের বাড়িতে ছাত্রকে জায়গির রেখে খাওয়ায়। শিক্ষাটাও পাবে আর লোকের বাড়ি বাড়ি ভাল-মন্দ খাবারও খেতে পাবে।’
নানির এমন পরামর্শ শুনে জামিলকেও খুব ভাল লেগেছিল। মাদ্রাসায় যাওয়ার জন্য সে মাকে কয়েক বার তাগাদাও দিয়েছে। মা-ও বিশেষ করে ছেলের পেটের ক্ষুধার কথা মাথায় রেখে জামিলের নানির পরামর্শ সমর্থন করে। তার কয়েকদিন পরেই জামিলকে মাদ্রাসায় রেখে চলে আসে। ছেলের বয়স এগারো বছর হয়ে গেছে, তবুও সে প্রতিদিন রাতে মায়ের গলা ধরে ঘুমাতো। মাকে ছাড়া কোথাও এক রাতও তার কাটেনি। এমন স্মরণ করে মা খুব কেঁদেছিল। কাঁন্না ছাড়া তার আর কিছুই করার ছিল না। স্বামীর রোজগারে তাদের সংসার চলতো। স্বামী বেঁচে থাকা অবস্থায় সংসারে তেমন অভাব দেখা দেয়নি। স্বামীর গত হওয়া চার মাস হল। শোকে এবং দুশ্চিন্তায় এ চার মাসের মধ্যে জামিলের মা বত্রিশ বছর বয়সেই যেন বুড়ি হয়ে গেল।
এ দিন মায়ের অসহায় মুখখানিও জামিলের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। জামিলের মনের কষ্ট যেন কিছুটা লাঘব হয়। মুহূর্তের মধ্যেই আবার মনে পড়ে যায় রাস্তার ধারে চায়ের দোকানে বসে থাকা অতীতের সুদখোর মোড়ল আসিমুদ্দিনের কথা। কয়েকদিন পূর্বে আসিমুদ্দিনকে সামনে পেয়েও জামিল তাকে সালাম দেয়নি। তাই চায়ের দোকানে জামিলকে ডেকে সে বলে, ‘বড় মানুষকে সালাম করতে হয়, তা জানো না? তোমরা মাদ্রাসায় কী শিখেছো? ভালো করে শিক্ষা অর্জন করছো, না বাড়ি বাড়ি ভালো-মন্দ খেয়েই বেড়াচ্ছো?’ আসিমুদ্দিনের কথাগুলো শুনে সেদিন জামিল খুব লজ্জা পেয়েছিল। মনে দুঃখও পেয়েছিল। কথাগুলো মনে করে আজও তার খুব দুঃখ হলো।
মাসখানেক ক্লাস করাতে জামিলের শিক্ষা হয়েছে, মুসলমানের সাথে সাক্ষাত হলে সালাম দিতে হয়। শিক্ষকদের কাছে সে এও শুনেছে যে, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাস্তা ধরে চলতে চলতে ছোট ছোট শিশুদেরও সালাম দিতেন। ‘তার মানে বোঝা গেল, বড়রা ছোটদেরও সালাম দেবে। তাহলে আসিমুদ্দিন মোড়ল আমাদেরকে একদিনও আগে বেড়ে সালাম দেয় না কেন!’ জামিল এসব ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। পেটেও যেন ব্যথা শুরু হয়ে যায় তার। এমন সময় শিক্ষক এসে ক্রুদ্ধস্বরে বলেন, ‘জোহরের নামাজ আদায় না করে শুয়ে আছো কেন? তুমি নামাজই কখন আদায় করবে, আর পড়াশোনাই বা কখন শুরু করবে?’
জামিল শিক্ষকের ধমকেও যখন বিছানা ছেড়ে উঠে না তখন শিক্ষক তার কাছে গিয়ে, কান ধরে, তাকে দু’চড় মেরে পূর্বের ন্যায় সুরে বলেন, ‘এখানে পড়াশোনা করতে এসেছো, না বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভালো-মন্দ খেয়ে শরীর পুষতে এসেছো? পড়ার নাম করে খেয়ে বেড়ালে খাবার হালাল হবে না, বুঝলে! যাও, নামাজ আদায় করে পড়াশোনা শুরু করো!’
জামিল অজু করার জন্য ঘর থেকে বের হবে এমন সময় শিক্ষক জিজ্ঞাসা করেন, ‘দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করেছো?’
জামিল শিক্ষকের দিকে ফিরে মৃদুস্বরে বলে, ‘না হুজুর।’
শিক্ষক বিস্ময়ের সুরে বলেন, ‘যে বাড়িতে জায়গির থেকে খাচ্ছো, সেই বাড়ি খাবার খেতে যাওনি কেন?’
একই রকম সুরে জামিল বলে, ‘ওরা বাড়িতে নেই। ওদের নাকি কে মারা গেছে, তাই সবাই মরার বাড়িতে চলে গেছে।’
‘পাশের বাড়িতে বলোনি কেন?’
‘পাশের বাড়িতেও সকালে গিয়েছিলাম। ওদের নাকি রান্নার গ্যাস শেষ হয়ে গেছে। আজকে তারা সময়মতো রান্না করতে পারবে না। তাই ওরা অন্য বাড়ি যেতে বলেছিলো।’
‘গিয়েছিলে?’
‘হ্যাঁ হুজুর। গিয়েছিলাম। ওরা নাকি সবাই দরগায় নিমন্ত্রণ খেতে যাবে আজ।’ এ বলে জামিল খানিক নীরব থাকে। নীরব থাকে শিক্ষকও। খানিক নীরবতার পর জামিল আবার বলতে শুরু করে, ‘লজ্জায় আর অন্য বাড়ি যাইনি হুজুর!’ এ বলে সে মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকেন শিক্ষকও। তিনি জামিলকে চড় মারার জন্য এবং বকাবকি করার জন্য অনুতপ্ত। জামিলকে কী বলবেন তিনি ভেবে পান না। মুহুর্তের মধ্যে কী যেন ভেবে নিয়ে, তিনি কোনো বাক্য ব্যয় না করে, পাঞ্জাবির বুক পকেটে হাত দিয়ে দ্রুতগতিতে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। আর জামিল ধীরে ধীরে নলকূপের দিকে যায় অযু করার উদ্দেশ্যে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct