উত্তরণ
রবীন বসু
_________________
রোজকার মত বিকেলে ইস্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল শোভন। একটু আগে বোধহয় একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। রাস্তা ধুয়ে ঝকঝকে কালো। আকাশ গাঢ় নীল। মাঝে মাঝে সাদা মেঘ। এবছর বেশ দেরিতে বর্ষা নেমেছে। এখন আগস্টের শেষ। পুজো এসে গেল বলে। সেদিন বন্ধুদের সাথে রেললাইনের ধারে বেড়াতে গিয়েছিল। দেখে, কাশ ফুটেছে অনেক। লাইনের দু’ধার সাদা হয়ে আছে। গত বছর তাদের ইস্কুলে সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী সিনেমাটা দেখানো হয়েছিল। সেখানে অপু-দুর্গা ট্রেন দেখার জন্য কাশবনের ভিতর দিয়ে দৌড়চ্ছে। সেই দৃশ্যটা তখন তার মনে পড়ছিল।
শোভন এবছর মাধ্যমিক পাশ করে সবে ক্লাস ইলেভেনে ভর্তি হয়েছে। বাড়ির কাছেই ইস্কুল। হেঁটেই বাড়ি ফেরে। চৌরাস্তা পেরিয়ে মিউনিসিপ্যাল গ্রাউন্ড বাঁপাশে রেখে তাদের পাড়ার রাস্তা ধরতে হয়। যেহেতু তাদের এটা মফসসল শহর, তাই এখনো অনেক পুকুর বা জলাশয় আছে। শোভনের আগ্রহী চোখ সেই স্থির জলের উপর ঘোরে। কোথাও জলমাকড়সা খেলা করে। কোথাও আবার কচুরিপানার উপর নানা রঙের ঝিঁঝিঁ বসে থাকে। তাদের ডানাগুলো তির তির করে কাঁপে। ছোট ছোট মাছগুলো পাড়ের ধারে এসে মুখ উঁচু করে দম নেয়। খিদে পেলেও শোভন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব দেখে। তার ভালো লাগে। নিজেকে কেমন অপু অপু মনে হয়।
আজ কিন্তু পাড়াতে ঢুকেই সে অবাক হয়ে গেল। কেমন যেন থমথমে ভাব। পলাশদার রকমারি দোকান বন্ধ। পাড়ার ইস্তিরিওলার গাড়ি আছে সে নেই। পুকুরের জল দেখা আজ আর হল না শোভনের। সে দ্রুত পা চালাল। দূর থেকে একটা আওয়াজ ভেসে আসছে। বলা যায় হল্লা। কিছুটা এগুনোর পর দেখল, পুবপাড়ার দিক থেকে একদল লোক চিৎকার করতে করতে এগিয়ে আসছে।… ডাইন… ডাইন ধরেছে….ডাইন…
ভিড়টা তাকে ধাক্কা দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলল। শোভনও তাদের পিছু নিয়ে দৌড়তে লাগল। তাদের বাড়ি পেছনে ফেলে ভিড়টা মাস্টার পাড়ায় ঢুকল। আরে! এতো সরলা পিসির বাড়ি। বাড়ির সামনে লোকে লোকারণ্য। পাঁচিলেও লোক উঠেছে। সবাই চিৎকার করছে, ডাইন … ডাইন…
সরলা পিসিকে সে ভালোভাবেই চেনে। তাদের খেলার বল কিনে দেন। বিশ্বকর্মা পুজোর সময় ঘুড়ি। এই তো পনেরই আগস্ট স্বাধীনতা দিবসের দিন তাদের নিয়ে প্রভাতফেরি করেছেন। ওদের সব লজেন্স কেক আর কলা খেতে দিয়েছেন। বিধবা অসহায় মহিলাদের সাহায্য করার জন্য একটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা করেছেন। একসময় তাদের এলাকার মানদাসুন্দরী বালিকা বিদ্যালয়ের হেড দিদিমনি ছিলেন। এখন অবসর নিয়েছেন। ওনার স্বামী সরকারি উচ্চপদে ছিলেন। একটা দুর্ঘটনায় মারা যান। একমাত্র ছেলে আমেরিকার নাসাতে জুনিয়র বিজ্ঞানী।
সরলাপিসি একাই থাকেন। তবে সব সময়ের একজন সাহায্যকারিণী আছে। প্রায় তিন কাঠার উপর একতলা বাড়ি। পিছনে বাগান। অনেক রকম ফলের গাছ। আর কত রকম যে পাখি আসে সেই সব গাছে। তারা বাসা বাঁধে। কিচির মিচির ডাকে। এক এক পাখির এক এক রকম ডাক। সেই ডাক শোনার জন্য আর ফলের লোভে তারা পাড়ার ছেলেরা ছুটির দিনে গ্রীষ্মের দুপুরগুলোতে সব হাজির হত সরলাপিসির বাড়ির বাগানে। তাদের বিজ্ঞানের শিক্ষক বিমলবাবু প্রায়ই ক্লাসে বলেন, এমন বড় বাগান আর জলাশয় যত বেশি থাকবে আমাদের ইকো সিস্টেম ততই প্রাণ পাবে। সজীব থাকবে। একে রক্ষা করা উচিত আমাদের বেঁচে থাকার স্বার্থে।
কিন্তু এত লোক পিসির বাড়ি ঘিরেছে কেন? ডাইন… ডাইন বলে চিৎকারই বা করছে কেন? শোভন ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢোকে। দেখে পিসিকে কারা নতুন গামছা দিয়ে পিছমোড়া করে উঠোনে একটা আমগাছের গায়ে বেঁধেছে। দু’জন লাল কাপড় পরা, কপালে লাল তিলক আঁকা ষণ্ডামার্কা লোক অদ্ভুত উচ্চারণে কীসব মন্ত্র বলছে আর জ্বলন্ত ধুনো পিসির গায়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে। কাস্তে গরম করে ছ্যাঁকা দিচ্ছে। কখনও বা ঝাটা দিয়ে মারছে। একটা অবরুদ্ধ আক্রোশ যেন ফেটে পড়ছে। এক মহিলা ছুটে গিয়ে পিসির চুল অনেকটা কাঁচি দিয়ে কেটে নিল। পিসি প্রাণপণ চিৎকার করে বলছে, আমি ডাইন নই--- মানুষ ডাইন হয় না, তোমরা আমাকে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছ। হেনস্থা করছ।
ভিড়ও চিৎকার করে উঠল, হ্যাঁ, তুই ডাইন… ডাইন… না হলি তোর এনজিওতে কাজ করা রিক্সাওলা নেতায়ের বউ রাতারাতি রক্তশূন্য হল কী করে। তোদের বাগানে কাজ করতে আসা জোয়ান মরদ রাখাল একরাত্তিরের ভেদবমিতে মারা গেল কেন? তোর নজর খারাপ। নজরে বিষ আছে। তুই ডাইন…
শোভন দেখল, সরমাপিসির বাড়িতে সবসময় থাকে যে মেয়েটি কুসুম, সে ভিড়ের উদ্দেশ্যে হাতজোড়ো করে বলছে, তোমরা বিশ্বাস কর, দিদি ডাইন না। দিদির নজরে বিষ নাই। তাহলে তো আমিই আগে মরতুম। তোমাদের পায়ে ধরি দিদিকে ছেড়ে দাও… অদ্দেক গা পুড়ে গ্যাছে। এবার মারা যাবে মানুষটি…
---তাই যাক্… ডাইন মারা যাক্… আমাদের এলাকার মানুষ বেঁচে যাক্। চোখে কালো চশমা প্যান্ট-শার্ট পরা বেঁটেখাটো লোকটা এবার ভিড়ের উদ্দেশ্যে বলে, তোমরা সবাই কী চাও? ডাইনের বিষনজরে পুড়ে মরতে চাও, না বাঁচতে চাও?
ভিড় চিৎকার করে উঠল, আমরা ডাইনের হাত থেকে বাঁচতে চাই।
শোভন ভিড় ঠেলে পিসির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দু’হাত আগলে বলল, না তোমাদের সবাইকে ভুল বোঝাচ্ছে। মানুষ ডাইন হয় না। আমাদের ইস্কুলের বিজ্ঞানের স্যার বিমলবাবু বলেছেন, এসব কুসংস্কার। মানুষ রোগে মারা যায়। ডাইনের কুনজরে নয়। ভূতপ্রেত বলেও কিচ্ছু নেই। যার গায়ে রক্ত নেই তার নিশ্চয়ই জন্ডিস হয়েছে। এক্ষুনি ডাক্তার দেখাতে হবে। আর জনমজুর রাখাল মারা গেছে ফুড পয়েজিংয়ে। তোমরা মিথ্যে মিথ্যে পিসিকে দোষ দিয়ে ডাইন বানাচ্ছ। উনি কত শিক্ষিত। আমাদের কত ভালোবাসেন। কত অসহায় মেয়েকে বাঁচার রাস্তা করে দিয়েছেন। উনি কি ডাইন হতে পারেন? খুলে দাও ওনাকে।
আবার জমায়েতের মধ্যে থেকে গর্জন উঠল, না না। ডাইনের সব লক্ষণ ওর মধ্যে। স্বামীকে খেয়েছেন। ছেলে মুখ দেখে না। ওর ছায়ায় যে আসছে সে মরছে। ডাইন নয়তো কী!
শোভন দেখল সবই প্রায় তার চেনা লোক। বড়বাগান
বস্তি, পুবপাড়া, মণ্ডলপাড়া এমনকি এই মাস্টার পাড়ার লোকও আছে অনেকে। যারা সরমাপিসিকে ভালো ভাবে চেনে। যাদের মেয়েদের উনি পড়িয়েছেন এক সময় সেই মায়েরা। একটা ভিত্তিহীন অন্ধ কুসংস্কারের বশে তারা এক নির্দোষ বয়স্কা মহিলাকে হেনস্থা করছে। এতদিন শুনে এসেছে জঙ্গল মহলে, পুরুলিয়া বাঁকুড়ার মত অনুন্নত জেলার প্রান্তিক সীমান্তে ব্যক্তিগত স্বার্থে বা সম্পত্তির দখল নেবার জন্য সুস্থ মানুষকে ডাইন বানানো হয়। তাকে হয় অত্যাচারে অত্যাচারে মেরে ফেলা হয়, না হলে প্রাণের ভয়ে সে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু শহর কলকাতার এত কাছে, তাদের এই মফসসল শহরেও যে ডাইনি প্রথা মাথাচাড়া দেবে তা সে ভাবতে পারছে না।
শোভন উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছিল। একটু দম নিয়ে সে ঘুরে দাঁড়াল। পিসির কাছে গিয়ে তাঁর বাঁধন খোলার চেষ্টা করল। পিসি কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। এমন সময় সেই কালো চশমা লোকটা তাকে জোরে এক ধাক্কা দিলে। সে ছিটকে গিয়ে উঠোনের কল তলায় পড়ল। কপালের একপাশ কেটে গেল। এবার লোকটি কাদের উদ্দেশ্যে যেন বলল, বাইরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে আয়।
তিন চারজন ক্লাবের ছেলে তাকে চ্যাঙদোলা করে বাড়ির বাইরে রাস্তায় ফেলে দিয়ে গেল। শাঁখ ঘন্টা বেজে উঠল। ওঝা আর গুনিনদের মন্ত্রপড়া আরও জোর হল। শোভন বুঝতে পারল না সে পিসিকে কীভাবে বাঁচাবে! একবার ভাবল বাড়ি যায়। কিন্তু বাবা তো এখন অফিসে। ফিরবেন সেই রাত আটটা। ততক্ষণে তো পিসিকে ওরা নির্যাতন করে মেরে ফেলবে।একমাত্র বাঁচাতে পারে তাদের বিজ্ঞান স্যার বিমলবাবু। উনি কুসংস্কার বিরোধী বিজ্ঞান মঞ্চের সদস্যও। স্যার কিছু একটা ব্যবস্থা করতে পারবেন ঠিক। শোভন জানে স্যার এখন কোথায় আছে। নিজের হাতে গড়ে তোলা পাড়ার লাইব্রেরিতে।ওখানে গেলেই দেখা হবে। কপালের যে পাশটা কেটে গেছে সেখানে চেপে ধরে শোভন ছুটল বিমল স্যারের উদ্দেশ্যে।
স্যার ওকে দেখেই হতচকিত। ---কিরে, হাঁপাচ্ছিস কেন? মাথা কাটল কীভাবে?
শোভন সংক্ষেপে যা ঘটনা ঘটেছে বা দেখে এসেছে সব বলল স্যারকে। বলেই কেঁদে ফেলল। ---স্যার, আপনি বাঁচান সরমা পিসিকে।
---দাঁড়া, দাঁড়া। কাঁদিস না। শুধু আমি গেলে হবে না। থানায় যেতে হবে। অত লোকের ভিড়, পুলিশ ছাড়া বিরত করতে পারবে না। আর আমাদের বিজ্ঞান মঞ্চের কয়েক জনকে ডাকি।
বিমলবাবু ফোন করতে করতে শোভনকে বললেন, আমার সঙ্গে আয়।
থানার অফিসার খুব সিনসিয়ার। শোনা মাত্রই ফোর্স রেডি করতে বললেন। কালো গাড়ি ভর্তি পুলিশ, জিপে অফিসারের সঙ্গে বিমলস্যার সহ শোভনরা যখন সরমা পিসির বাড়িতে পৌঁছল তখন বাইরে থেকে চিৎকার শুনতে পেল, আগুন ধরাও… ডাইনকে পুড়িয়ে মারো… ধোঁয়ায় ভরে গেছে চারপাশ। অফিসার নেমেই লাঠি চার্জের অর্ডার দিলেন। মুহূর্তে সব মেয়ে পুরুষ পালিয়ে গেল। যারা পালাতে পারেনি আর ওঝা দুটোকে পুলিশ আটক করল।
শোভন দেখল পিসির সারা শরীরে পোড়া দাগ। ভিজে কাপড়ে অজ্ঞান হয়ে গেছেন। অফিসার তাড়াতাড়ি বাঁধন খুলে নিজেই পিসিকে কোলে তুলে নিয়ে জিপের পেছনে শোওয়ালেন। বাড়ির কাউকে জলের বোতল নিয়ে আসতে বললেন।
কেউ তো নেই কে যাবে। কুসুমমাসি তাড়াতাড়ি একটা জলের বোতল নিয়ে গাড়িতে উঠল। অফিসার বাড়ির সামনে পুলিশ পোস্টিং রেখে জিপে উঠে বিমলবাবুর উদ্দেশ্যে বললেন, আমি এনাকে নিয়ে ব্লক হাসপাতালে যাচ্ছি। আপনি ছেলেটাকে ওর বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে অন্য গাড়িটাতে আসুন। অ্যাডমিট করাতে আপনার সই লাগবে।
তিনদিন কেটে গেছে। যমে মানুষে টানাটানি। আজ আইসিইউ থেকে পিসিকে জেনারেল বেডে দিয়েছে। শরীর অনেকটা সুস্থ। তবে আরও কয়েক দিন থাকতে হবে হাসপাতালে।
ছুটির পর শোভন বিমল স্যারের সঙ্গে হাসপাতালে এসেছে পিসিকে দেখতে। এসে দেখে সেখানে আগে থেকেই থানার অফিসার বসে আছেন। পিসির সঙ্গে কীসব জরুরি বিষয়ে আলোচনা সারছেন। তাকে দেখে কাছে ডাকলেন। তারপর পিসির দিকে তাকিয়ে বললেন, একে চেনেন দিদিমনি? আপনার পাড়ার ছেলে।
---চিনব না কেন! ওতো শোভন। খুব ভালো ছেলে।
পিসি ম্লান হাসলেন।
অফিসার এবার বললেন, হ্যাঁ, এই ভালো ছেলেটা না থাকলে আমরা কিন্তু সেদিন অত তাড়াতাড়ি আপনাকে রেসকিউ করতে পারতাম না। ও যদি বুদ্ধি করে বিমল বাবুর সাথে যোগাযোগ না করত, তাহলে অঘটন একটা কিছু ঘটে যেতে পারত। কেননা আমাদের কাছে কোন ইনফরমেশন ছিল না।
বিমলবাবু অফিসারের কাছে জানতে চাইলেন, তদন্ত করলেন স্যার? কিছু বের হল?
---হ্যাঁ, সবটাই পরিস্কার হয়েছে। যে ওঝা দুটোকে আটক করেছিলাম, তারাই স্বীকারোক্তি দিয়েছে। পুরো ঘটনার পেছনে আছে ছোটোখাটো চেহারার বদ প্রোমোটার সদাশিব পাল। অনেক দিন ধরে তার লক্ষ্য ছিল সরমাদেবীর এই বাগান ঘেরা বড় বাড়িটা। এখন সরমাদেবী বললেন, দু’ একবার সে প্রস্তাব নিয়ে তাঁর বাড়িতে এসেছিল। উনি রাজি হননি। তাই স্থানীয় ক্লাবের ছেলেদের টাকা খাইয়ে মানুষের মধ্যে ডাইনি অপবাদ ছড়িয়ে বাঁকা পথে বাড়ি দখল করতে চেয়েছিল। দুই ওঝাকে সে-ই ভাড়া করেছিল। আমরা সদাশিবকে অ্যারেস্ট করেছি। ওর বিরুদ্ধে প্রতারণা, মানুষকে উত্তেজিত করা, জোর করে বাড়ি দখল ও হত্যার ষড়যন্ত্রের মামলা দিয়েছি। কঠিন শাস্তি হবে ওর।
অফিসার থামলেন। সরমাদেবী শোভনকে ইশারায় বেডের পাশে ডাকলেন। শোভন যেতে তার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললেন, বড় হয়ে এমনি ভাবে “সমাজে কুসংস্কারের কুফল” থেকে মানুষকে বাঁচিও।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct