প্রাক-স্বাধীনতা কিংবা স্বাধীনতা পরবর্তীতে সংখ্যালঘুদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বেশ কিছু উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি সময়োপযোগী আধুনিক শিক্ষাদানের মাধ্যমে এক নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করে চলেছে। ধর্মীয় শিক্ষার ঐতিহ্যপরস্পরায় উপমহাদেশ জুড়ে যে ইসলামি বিচ্ছুরণ, তার পাশে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে আধুনিক শিক্ষার পীঠস্থান হিসেবে গড়ে ওঠা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি। ইসলামি জীবন পদ্ধতি এবং আধুনিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে সমন্বয়সাধন জ্ঞানার্জনের পথকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। ধর্মীয় এবং দুনিয়াদারির জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার সঙ্গে বৃত্তিমূলক শিক্ষারও প্রবর্তন করা হয়েছে বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। উচ্চ শিক্ষার্জনে আত্মনির্ভর হয়ে ওঠা সেই অত্যুজ্জ্বল ও মহত্তম বিষয়টির উপর আলোকপাত করলেন এই বঙ্গের মেধা আর মননের অন্যতম বিশিষ্ট প্রতিনিধি খাজিম আহমেদ।
দারুল উলুম দেওবন্দ, উত্তরপ্রদেশ
এই উপমহাদেশের অর্থাৎ সাবেক হিন্দুস্তানের মুসলমান ‘আহল-ই-কলম’ (বুদ্ধিজীবী শ্রেণি) দ্বারা; ঐহিক আর পারত্রিক প্রয়োজনে পরিচালিত যে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভারতে ক্রিয়াশীল— সেগুলোর মধ্যে সব পয়লা যে নামটি উচ্চারিত হওয়া জরুরি এবং অপিরহার্য সেটি হচ্ছে— ‘দারুল উলুম দেওবন্দ’, উত্তরপ্রদেশ। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৫৭ সাল তক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আর সম্প্রসারণবাদী শক্তি এই উপমহাদেশের মুসলমান জনজীবনকে বিপন্ন করে তোলে। বস্তুত ইসলামি ভাবাশ্রয়ী হুকুমতকে নানা স্তরে, নানা অর্থে ধ্বস্ত করে দেয়। এই উপমহদেশের শ্রেষ্ঠতম ঐতিহাসিকদের মধ্যে অগ্রগণ্য ড. ইশতিয়াক হুসেন কুরেশি মন্তব্য করেছেন যে, বহির্শত্রুর দ্বারা যেমন নির্যাতিত হয়েছে তেমনি অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও এতদ্দেশীয় মুসলমানরা ‘পরাভব চেতনায়’ জর্জরিত হয়েছে। ড. কুরেশির অনুভব: ‘মুসলমান সম্প্রদায়ে বহু আগাছার জন্ম হয়েছিল, ধর্মের স্থান দখল করেছিল কুসংস্কার; সাম্প্রদায়িক এবং ধর্মীয় আনুগত্য স্বার্থপরতার নিকট আত্মসমর্পণ করে।’ [‘দ্য মুসলিম কম্যুনিটি অব দ্য ইন্দো-পাকিস্তান সাব কন্টিনেন্ট’, পৃষ্ঠা ১২২]। ‘ঊনবিংশ শতাব্দীর মুসলমান সমাজে অজ্ঞতা এবং কুসংস্কার জাঁকিয়ে কসেছিল।’ [ড. রফিউদ্দিন আহমেদ, ‘দ্য বেঙ্গল মুসলিমস, ১৮৭১-১৯০৬: আ কোয়েস্ট ফর আইডেন্টিটি’, পৃষ্ঠা: ২৩, ৩৩, ৩৫]। ‘বাঙালি মুসলমানদের ধর্মীয় ও নৈতিক জীবনেও চূড়ান্ত অনাচার প্রবেশ করেছিল।’ [ ড. ওয়াকিল আহমদ, ‘উনিশ শতকে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাচেতনার ধারা’, পৃ: ৫২-৫৬ (দ্বিতীয় খণ্ড)]। ইসলামি ‘তাহজীব-তামদ্দুন (ধর্ম ও সংস্কৃতি) সাধারণ শিক্ষা (General Knowledge), জ্ঞান বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে চলতে থাকে পরিকল্পিত সাংস্কৃতিক হামলা। এই বিপজ্জনক এবং হতাশাচ্ছন্ন পরিস্থিতিতে মুসলিম ‘উম্মাহ’কে ‘ডিগনিটির’ স্তরে টেনে তোলার জন্য হাজি মুহাম্মদ আবিদ হুসেনের আগ্রহে এবং মাওলানা মোহাম্মদ কাশেম ননৌতাভির অধিনায়কত্বে মুসলিম বিদ্বৎসমাজ একটি সর্বার্থে আদর্শ এবং সময়কালের প্রেক্ষিত আর বিবেচনীয় অতি প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি বৌদ্ধিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। এমনবিধ ‘কোশেশ’-এর ফল হল, দারুল উলুম দেওবন্দ।’ জেলা, শাহারানপুর।১৮৬৬-৬৭ সালে এই মহতী প্রতিষ্ঠানের সূচনাকাল এবং স্থাপনা। বিশ শতকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো চরিত্র ও মাহাত্ম্যসহ সারা দুনিয়ায় ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান হিসেবে মান্যতা পেয়েছে। ইজিপ্টের ‘আল্-আজহার’ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই ‘দারুল উলুম দেওবন্দ’-এর আন্তর্জাতিক মর্যাদা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। উনিশ শতকের শেষে মর্যাদাশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে সারা মুসলিম বিশ্বে বিশিষ্ট হয়ে ওঠে। স্মর্তব্য এটি একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। নিখিল বিশ্বের তিনটি মহাদেশ থেকে বস্তুত এখানে শিক্ষার্থীরা শিক্ষার্জনের ‘মকসদে’ আসেন। ইসলামি সভ্যতা, গ্রন্থাগারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। ‘দারুল উলুম দেওবন্দ’ বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজারে হাজারে গ্রন্থাবলী (আরবি, ফার্সি, উর্দু ভাষা) জ্ঞানচর্চার জন্য সযত্নে রক্ষিত— তা যথার্থই বিস্ময়কর। গবেষণাকর্ম এবং বহুবিধ পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিরে শিরোপা পরিয়ে রেখেছে। ইসলামি সভ্যতার ওপরে চর্চিত ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত গ্রন্থরাজিও সহজেই লভ্য। ঔপনিবেশিক ভারতে কিংবা স্বাধীন ভারতে শাসক গোষ্ঠীর কোনও দয়া-দাক্ষিণ্যের পরোয়া করেন না — এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক গোষ্ঠী। দেওবন্দের উলেমা শ্রেণি স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম সারিতেই ছিলেন। তাঁরা তথাকথিত জাতীয়তাবাদী ছিলেন না। ছিলেন তাঁরা ‘স্বদেশপ্রেমিক’, কেননা তাঁরা বিশ্বাস করতেন / করেন– ‘হুব্বুল ওয়াতানে মিনাল ইমান।’ অর্থাৎ ‘স্বদেশ প্রেম ইমানের অঙ্গ।’ একজন মুসলমান কখনও দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন না। এই বিশ্ববিদ্যালয় এবং উলামা শ্রেণি অতি প্রভাবশীল ‘জমিয়ত-ই উলামায়ে হিন্দ’-এর সঙ্গে সখ্যতার সম্পর্ক রেখে চলেন। [সূত্র: Faruqi, ‘The Deoband School’ নামক গ্রন্থখানি দেখুন]
নদওয়াতুল উলামা, লখনউ
উত্তরপ্রদেশের অভিজাত লখনউ শহরে ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল উপরোক্ত মর্যাদাপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। এই ইসলামি সংস্থাটির উদ্দেশ্য ছিল পূর্ণ ইসলামি জীবন পদ্ধতি এবং আধুনিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে সমন্বয়সাধন। ধর্মীয় এবং দুনিয়াদারির জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার [উলুম-ই-আকলিয়াহ’ অর্থাৎ ‘বৌদ্ধিক জ্ঞান’, সূত্র আসগর আলি ইঞ্জিনিয়ার-এর একটি ইংরেজি প্রবন্ধ থেকে।] সঙ্গে বৃত্তিমূলক শিক্ষারও প্রবর্তন করা হয়। এমনবিধ স্বয়ংসম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ডিরেক্টর ছিলেন সৈয়দ মুহাম্মদ আলি মুঙ্গেরি। আধুনিক ‘হিন্দুস্তান’-এর সর্বোত্তম ইসলামবেত্তা এবং ‘ভারততত্ত্ববিদ’ আল্লামা শিবলি নোমানি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পাদক হিসেবে প্রতিষ্ঠানের মর্যাদার বার্তা বিশ্ব দরবারে পৌঁছেছেন। তিনি এই দায়িত্ব নিয়েছিলেন ১৯০৪ সালে। আল্লামা শিবলি নোমানি বিশ্ববিদ্যালয়ের আমূল পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে প্রাণপাত পরিশ্রম করেছিলেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের আধুনিক গবেষণা, পর্যালোচনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সমালোচনামূলক এবং তুলনামূলক শিক্ষা পদ্ধতির প্রচলন করেছিলেন। বস্তুত এই বিশ্ববিদ্যালয়কে মাওলানা নোমানির নেতৃত্বে তৎকালীন উলেমা শ্রেণি দেওবন্দ আর স্যার সৈয়দ আহমেদ খানের আলিগড় কেন্দ্রিক চিন্তাধারার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন। স্যার সৈয়দ আহমদ খান (১৮১৭-১৮৯৮), অধ্যক্ষ আর্চিবল্ড, অধ্যাপক মরিসন, অধ্যাপক বেক-এর পরামর্শে আলিগড় চিন্তাধারাকে ইসলামি আর আধুনিক ইউরোপীয় চিন্তা-চর্চার সংশ্লেষণ করেছিলেন। মাওলানা শিবলি নোমানি এই বাস্তবোচিত বিষয়টিতে মান্যতা দেন এবং ‘নদওয়াতুল উলামা’ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে (পাঠ্যসূচি) তা গ্রহণ করেন। আল্ কুরআনের অনুবাদ, ব্যাখ্যা, মূল্যায়ণ আর মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর জীবনী ‘সিরাত-উন-নবী’ তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠতম বৌদ্ধিক ফসল। আরও এক ভারততত্ত্ববিদ (Indologist), ইসলামবেত্তা সাইয়েদ সুলায়মান নদভি ‘নদওয়াতুল উলামা’-র অসাধারণ ধী-শক্তিসম্পন্ন ছাত্র ছিলেন। আজতক তিনিই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোত্তম ছাত্র। আন্তর্জাতিক স্তরে ব্যাপক খ্যাতিসম্পন্ন এবং পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত, বহুল মুদ্রিত ও বহুল পঠিত, বহু গ্রন্থ প্রণেতা সাইয়েদ আবুল হাসান আলি নাদভি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক, প্রধান পরিচালক ছিলেন মৃত্যুর আগে পর্যন্ত (২০০০)’ [দেখুন, ‘ইসলামী বিশ্বকোষ’, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ, ১৩শ খণ্ড, পৃ: ২৮৭]। বিশ্ব সভ্যতার মহান নেতা হযরত মুহাম্মদ সা. দেশপ্রেম আর গণতান্ত্রিক ঐক্য, সাম্য এবং ভ্রাতৃত্ববোধের যে তালিম দিয়ে গেছেন, তা তাঁর মতো আলোকবাহী ব্যক্তিত্বের পক্ষেই সম্ভব হয়ে উঠেছিল। স্বভাবতই এই শ্রেণির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বেরিয়েছিল বহু তেজোদৃপ্ত স্বাধীনতা সংগ্রামী। নানা মত, নানা ধর্মীয় নাগরিকবর্গের সঙ্গে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জানপাত লড়াই করেছিলেন। তাঁদের মহৎ উদ্দেশ্য ছিল হর হিন্দুস্তানি আপন মর্যাদা আর ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে সাদিয়োঁকাল থেকে যে সৌভ্রাতৃত্বের সঙ্গে বসবাস করে আসছে— সেই ট্র্যাডিশন জারি থাকবে।
স্বাধনিতা সংগ্রামে অগণন ছাত্র প্রত্যক্ষ অংশ নিয়েছেন। ‘শুধুমাত্র দিল্লিতেই ৭০ হাজারেরও বেশি আলেমকে নিধন করে।’ (স্বাধনিতা সংগ্রামে ইসলামি মাদরাসায় ছাত্রদের ভূমিকা, সাইয়েদ হুসাইন আহমদ শামসী, ইসলামি সংস্কৃতি, ৫ম সংখ্যা, পৃ: ২৬)। মাওলানা, মৌলবি, আলেম-উলামা— এককথায় ইসলামাশ্রয়ী ‘আহল-ই-কলম’ (বুদ্ধিজীবী বর্গ) আযাদি সংগ্রামে যে গৌরবময় ভূমিকা পালন করেছেন তার যথার্থ মূল্যায়ণ আজও হল না। বিশিষ্ট কয়েকজনের নাম শ্রদ্ধা সহকারে উল্লেখ করা হল: মাওলানা মাহমুদুল হাসান, মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি, মাওলানা হিফজুর রহমান, মৌলানা আবুল কালাম আযাদ, মাওলানা ফজুলুল হক খয়রাবাদি, মাওলানা হেদায়েত রাসূল কাদরি, মওলানা মুহাম্মদ আলি গওহর, মাওলানা হসরত আলি মোহানি, মাওলানা আহমদুল্লাহ শাহ, মাওলানা আহমদ সয়ীদ, মাওলানা ইসমাইল মিরাজ, মাওলানা আবদুর রহিম, মাওলানা রশিদ আহমদ গঙ্গোহি, মুফতি এনায়েত আহমদ কাকোরি এবং কোটি কোটি জনবন্দিত মাওলানা মুহাম্মদ কাশেম নানাতোভি। স্পষ্ট করে বলা দরকার, বেশুমার ‘ওলামায়ে হিন্দ’ আযাদি সংগ্রামে নিজেদের ‘জান’ বাজি লাগিয়ে দিয়েছিলেন। [সূত্র: প্রাগুক্ত এবং অমলেন্দু দে, ‘ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুসলিম সমাজ’, চতুরঙ্গ, বর্ষ ৪৮, সংখ্যা-৭, নভেম্বর ১৯৮৭।] ‘নদওয়াতুল উলামা লখনউ’-এর পরেই উল্লেখ করতে হবে, ‘মযহার উল উলম’ নামক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। এটি শাহরানপুরে অবস্থিত। ‘দারুল উলুম দেওবন্দ’-এর সঙ্গে শিক্ষা পদ্ধতির প্রকৃতিগত এবং গুণগত সামঞ্জস্য রয়েছে। ‘হিন্দুস্তানি’ মুসলমানদের চিন্তা-চেতনা উন্মেষ আর উজ্জীবনে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব ও অবদান অনস্বীকার্য। এমনবিধ বৃহৎ আর মহৎ প্রতিষ্ঠান ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আরও অনেক সরকারি এবং বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মাদ্রাসা, ধর্মীয় আর ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্যায়তন এবং ইসলামি আদর্শে পরিচালিত সংস্থা রয়েছে বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক। এগুলোর মধ্যে ‘মাদ্রাসা-ই-আলিয়া’ (কলকাতা), ‘মাদ্রাসা-ই-আলিয়া শামসুল হুদা’ (পাটনা), ‘মাদ্রাসা-ই-আজিজিয়া’ (বিহার শরীফ), ‘মাদ্রাসা-ই-নিজামিয়া’ (হায়দরাবাদ), ‘মাদরাসা-উর-উজেম’ (লখনউ) এবং ‘মাদ্রাসা-ই-নিজামিয়া’ (লখনউ) বিশেষভাবে মর্যাদাসম্পন্ন আর গুরুত্বপূর্ণ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আযাদি লাভের পর কেরালা-য় অসংখ্য আরবি ভাষা ভিত্তিক মাদ্রাসা স্থাপিত হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্র সমাজ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের প্রান্তে প্রান্তে চাকুরিতে নিয়োজিত। মনে রাখতে হবে, আরবি বিশ্ব-জাহানের ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা। আল কুরআন আরবি ভাষাতেই ‘নাজেল’ হয়েছে। নাগিব মাহফুজ আরবি ভাষায় সাহিত্য নির্মাণ করে ‘নোবেল লরিয়েত’-এর স্বীকৃতি আর মর্যাদা অর্জন করেছেন। কবি আলি আহমদ সায়ীদ-এর নামও নোবেল বিজয়ীদের সম্ভাব্য তালিকায় ছিল। তিনি সিরিয়া আর লেবাননে অশেষ সম্মানিত। আরবি ভাষার ফিলিস্তিনি কবি মাহমুদ দরবেশের কবিতার সঙ্গে বাঙালি পাঠকবর্গ সবিশেষ পরিচিত।
উপরোক্ত ধর্মাশ্রয়ী প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যতিরেকে অনেক উচ্চ গুণমানসম্পন্ন আধুনিক শিক্ষাকেন্দ্র জনকল্যাণকামী মুসলমান উদ্যোগীবর্গের দ্বারা স্থাপিত হয়েছে। এইগুলোর মধ্যে আজমগড়ের ‘দারুল মুসান্নিফিন’ সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। এই ‘তালিমি’ প্রতিষ্ঠানটির স্থাপনার পিছনে আবারও শিবলি নোমানির অবদান পরম শ্রদ্ধা ভরে স্বীকার্য। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী মাওলানা শিবলি নোমানি এই প্রতিষ্ঠানটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। জন অভ্যন্তরে জ্ঞানচর্চার এই বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠানটি ‘শিবলি অ্যাকাডেমি’ নামে পরিচিত। ১৯৬৪-তে ভারত সরকার প্রভূত অর্থ সাহায্য করেছিল। প্রতিষ্ঠানটির প্রতি জওহরলাল নেহরুর নেক নজর ছিল। শত শত অতীব মূল্যবান গবেষণা গ্রন্থ ‘শিবলি অ্যাকাডেমি’-র মর্যাদা আর উঁচু অভিজাত রুচির সঙ্গে প্রকাশ করেছে, করছে।হায়দরাবাদের ‘দাইরাত-উল-মারিক’-এর নাম এই প্রসঙ্গে অবশ্য আলোচ্য। ‘দাইরাতুল’ ইসলামি শিক্ষা সংস্কৃতি, ইতিহাস, অংকশাস্ত্র আর দর্শনের উপর ব্যাপক মূল্যবান আর বৃহদাকার গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। নিরত সেই গবেষণায় প্রতিষ্ঠানটি নিয়তই। ‘নদওয়াতুল মুসান্নিফিন’ (দিল্লি) প্রায় আট দশক ধরে অজস্র গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। মূলত ইতিহাস, ধর্ম-সংস্কৃতি, সাহিত্য আর সর্ববিধ ইসলামি বিষয় সমূহের উপরই গুরুত্ব আলোপ করেছে। ইসলামি ‘তাহজীব তামুদ্দুন’ চর্চার জন্য গত শতকের ছয়ের দশকে লখনউতে ‘মজলিশ-ই-তাহকিকৎ ওয়া শরিয়ত-ই-ইসলাম’ নামে একটি শক্তিশালী সংস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। লখনউ-এর আত্মমর্যাদা সচেতন মুসলমান বিদ্বৎসমাজ আন্তরিক যত্ন এবং সতর্কতার সঙ্গে সংস্তাটি পরিচালনা করে থাকেন। নওয়াব ওয়াজিদ আলি শাহ-র শহরে আরও বিস্তর মাদ্রাসা ইলম’ চর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আজও বহন করে চলেছে গভীর মনোযোগ সহকারে। বস্তুত জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা-সংস্কৃতি চর্চার এই সংস্থাগুলো হিন্দুস্তানি মুসলমানদের অতি গর্বের উত্তারিধকার। উদগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের হাত থেকে এই সংস্থাগুলোকে ‘চোখের মণি’-র মতো যত্নে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। মুসলমান ‘কওম’-এর সদস্যবর্গ দ্বারা পরিচালিত ‘আঞ্জুমান-ই-তারিকি উর্দু-এ-হিন্দ’ উন্নত শিক্ষা সভ্যতা চর্চার একটি সম্মাননীয় প্রতিষ্ঠান। এর উদ্দেশ্যে হচ্ছে, উর্দু ভাষার প্রগতি আর উন্নতি সাধন। উর্দু ভাষাকে ‘The Fourth Language of Islam’ বলা হয়ে থাকে। ‘আঞ্জুমান’ হরওয়াক্ত উচ্চমানের উর্দু গ্রন্থ প্রকাশ করে সুরুচি আর দক্ষতার পরিচয় রেখেছে। এই সংস্থাটি ভারত সরকার-এর আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করে। একথা সর্বজনবিদিত যে উর্দু ভাষায় ইসলামের উপর বিস্তর মূল্যবান ‘কিতাব’ রয়েছে। শিখ ধর্মের উপর নির্ভর করে উর্দু ভাষায় বহু গ্রন্থ রয়েছে। সেইসব পবিত্র গ্রন্থের বিষয় নিয়ে বহু সময় ‘মাভেরিক এডিটর’ লেখক-সাংবাদিক খুশবন্ত সিং ‘দ্য টেলিগ্রাফ’, ‘দ্য ইলাসট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া’ নামক সংবাদমাধ্যমে আলোচনা করেছেন। উত্তর আর উত্তর পশ্চিম ভারতের লক্ষ লক্ষ হিন্দুধর্মী অভিজাত শ্রেণি উর্দু ভাষায় কথা বলে স্বস্তি আর সম্মানিতবোধ করেন। প্রেমচন্দ (প্রেমচাঁদ) আর কৃষণচন্দর উর্দু সাহিত্যের জনপ্রিয় সৃষ্টিশীল লেখক। ড. আল্লামা মোহাম্মদ ইকবালের জীবনীকার হচ্ছেন ড. সচ্চিদানন্দ। এতদ সত্ত্বেও হাল আমলে উৎকট আর ভয়াবহ সাম্প্রদায়িকতাবাদী শাসক গোষ্ঠী উর্দু ভাষাকে উপেক্ষার নজরে রেখেছে। এতো জীবন্ত ভাষা মরে না। সে অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ। সে আলোচনার মওকা এখানে নেই। দরবেশ-বাদশাহ, পিউরিটান আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মাত্র পঞ্চাশ বছরের মধ্যে মুসলমানরা মহাদুর্যোগের সম্মুখীন হল। রাজনৈতিক, সমাজ-আর্থ এবং শিক্ষাগত দিক দিয়ে অন্যান্য ভারতীয়দের তুলনায় পিছিয়ে পড়েছিল তেমন সময়ে এই উপমহাদেশের মুসলমান জাগরণের ‘পায়ওনিয়ার’ স্যার সৈয়দ আহমদ খান স্থাপন করেছিলেন ‘মোহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ’ (১৮৭৫), বিজ্ঞান চর্চার উদ্দেশ্যে বিজ্ঞান পরিষদ (১৮৬৪), অধিকার আদায়ের জন্য আধুনিক উর্দু সংবাদপত্র ‘তাহজিব-উল-আখলাক’ (১৮৭০)। স্মর্তব্য, আধুনিকতা আর যুক্তিবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত কলেজটি ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ‘আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’-এ পরিণত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে কলেজটি গড়ে উঠেছিল ‘অক্সফোর্ড’, ‘কেমব্রিজ’-এর অনুকরণে। এই উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে উচ্চশিক্ষা, আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতা-সংস্কৃতির পরিচয় আর অগ্রগতির জন্য ‘আলিগড় আন্দোলন’-এর মাধ্যমে স্যার সৈয়দ আহমদ খান যা করেছিলেন তর তুলনা মেলে মহাত্মা, রামমোহন-এর কর্মাধারার মধ্যে। স্যার সৈয়দ অধ্যক্ষ থিয়োডর বেকের পরামর্শে মুসলমানদের স্বার্থরক্ষণের জন্য স্থাপন করেন ‘ইউনাইটেড ইন্ডিয়ান প্যাট্রিয়টিক অ্যাসোসিয়েশন’ এবং ‘মহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল ডিফেন্স অ্যাসোসিয়েশন অব আপার ইন্ডিয়া’ নামক দুটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। আধুনিক ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক ড. বিপনচন্দ্র মনে করেন যে, তিনি সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। স্যার সৈয়দ আহমদ খানের জীবনের একমাত্র ‘মটো’ ছিল যে কোন উপায়ে মুসলমান সমাজের উন্নয়ন-- শুধুমাত্র হিন্দুদের প্রতি বিদ্বেষপোষণ নয়। (দেখুন, ‘মডার্ন ইন্ডিয়া’, নিউ দিল্লি, ১৯৭১, উপরন্তু দেখুন, বিপনচন্দ্র, ‘ইন্ডিয়াজ স্ট্রাগল ফর ইন্ডিপেনডেন্স’, পেঙ্গুইন বুকস, পৃ: ৪১৪, এস. আবিদ হাসান, ‘দ্য ডেস্টিনি অব ইন্ডিয়ান মুসলিমস’, বোম্বে, ১৯৬৫, পৃ: ২৪, সৈয়দ আহমদ খান, ‘রাইটিংস অ্যান্ড স্পিচেস’, সম্পাদক : শান মোহাম্মদ, বোম্বে-১৯৭২)। নানাবিধ দুর্বলতায় আচ্ছন্ন স্বাধীনতা হাসিলের পর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে অনেক অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটেছে। বর্ণবাদী, মনুবাদী তথা উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা এই ঐতিহ্যপূর্ণ, মুসলমান আইডেন্টিটির প্রতীক বিশ্ববিদ্যালয়টির ‘মুসলমান প্রকৃতি’-কে অস্বীকার করতে চায়। অপপ্রচারেরও হদ্দমুদ্দ নেই। পাক-ভারত-বাংলাদেশ অর্থাৎ এই উপমহাদেশের মুসলমানদের রাজনৈতিক আর বৌদ্ধিক জীবনে ‘আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়’ কেন্দ্রিক আন্দোলন কি প্রভাব ফেলেছিল তা কল্পনাতীত।
‘জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া’
(দিল্লি)ও একটি ইসলামাশ্রয়ী-অত্যাধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৯২০ সালে মাওলানা মোহাম্মদ হাসান ‘জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মাওলানা মোহাম্মদ আলি. ডা. আনসারি, হাকিম আজমল কান এবং ড. জাকির হোসেন জামিয়ার প্রাণস্বরূপ ছিলেন। এঁদের ত্যাগ, অশেষ পরিশ্রম, প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত পরিকল্পনার ফলেই ‘জামিয়া’ আজ এতো বৃহৎ আর মর্যাদা ও গাম্ভীর্যপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘অ্যাকডেমিক ওয়ার্ল্ডে’ পরিচিত আর প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে। ‘নঈ তালিম’ শীর্ষক একটি শিক্ষা পদ্ধতি প্রাথমিক পর্যায়ে প্রয়োগ করা হয়েছিল। মহাত্মা গান্ধি, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, মহান নেতা নেহরু ‘জামিয়া মিলিয়া’র পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। ‘জামিয়া ওসমানিয়া’ বৃহত্তম আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। বিশেষভাবে এটি লক্ষ্যযোগ্য যে, ‘জামিয়া ওসমানিয়া’-য় উর্দু ভাষার মাধ্যমে আধুনিক সর্ববিধ শিক্ষা দেওয়া হত। বিশ্ব জাহানের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য বিষয়ের সঙ্গে ওসমানিয়া-র পঠন-পাঠনের সামঞ্জস্য বিস্ময়ের উদ্রেক করে। হাল আমলে ভাষারও কোনও প্রতিবন্ধকতা নেই। এই বিশ্ববিদ্যালয়টির সজীব অবস্থান সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের না-পসন্দ। সেখানে নানাবিধ সনাতনী শয়তানির প্যাঁচ-পয়জার বহু ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা গেছে। ওসমানিয়া কর্তৃপক্ষ সটান চলেছে তার ‘ইলম-এ-কাফেলা’ নিয়ে। পাটনার ‘খুদাবখশ লাইব্রেরি’ ভারতের মুসলমান সমাজের গর্বের প্রতিষ্ঠান। আরবি, ফারসি, উর্দু ভাষার বহু দুষ্প্রাপ্য পুঁথি এখানে সংরক্ষিত রয়েছে। পাণ্ডুলিপি, ইতিহাস বিষয়ক কাহন কাহন গ্রন্থ সংগ্রহ করে সযত্নে রক্ষিত। ভারত বিষয়ক গবেষণার জন্য সারা পৃথিবীর গবেষকবর্গ হাজির হন। দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থের সংরক্ষণ গ্রন্থাগারের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তুর্ক-আফগান এবং মোগল জমানার গ্রন্থরাজি ‘খুদাবখশ লাইব্রেরি’তে গবেষণার প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। স্যার যদুনাথ সরকার এবং অধ্যাপক জগদীশ নারায়ণ সরকার তাঁদের অতুচ্চ গবেষণা কর্মের জন্য এই লাইব্রেরির বহুল সাহায্য নিয়েছেন। ‘সরকার ভ্রাতৃদ্বয়’ ইসলামধর্মী শাসকবর্গের অধীনে হিন্দুস্তানের ইতিহাসের উপাদান বিপুলভাবে সংগ্রহ করেছেন। ড. জগদীশ নারায়ণ সরকারের ‘ইসলাম ইন বেঙ্গল’, কলকাতা (১৯৭২) গ্রন্থখানি তাঁর উজ্জ্বল উদাহরণ। [ভূমিকা দেুখুন]। ছয়ের দশকে ‘খুদা বখশ লাইব্রেরি’-কে জাতীয় সংস্থায় রূপান্তরিত করা হয়েছে।
দেশবিভাগের পর ‘ইসলামিয়া কলেজ’
বর্তমানে ‘মৌলানা আজাদ কলেজ’ নামে পরিচিত। একদা পূর্ব বাংলার অভিজাত মুসলমান পরিবারের তরুণবর্গ এই ইসলামিয়া কলেজেই ‘লেখাপড়া এবং শোনা’ (প্রচুর সেমিনার, অ্যাকাডেমিক ডিসকোর্স, ‘মুসলিম রেনেসাঁ সোসাইটির অধিবেশন, বিতর্ক সভা লেগেই থাকত) আর বিতর্কে অংশগ্রহণ করে নেতৃত্বদানের যোগ্য হয়ে উঠতেন। প্রাক স্বাধীনতাপর্বে শুধুমাত্র মুসলমান তরুণবর্গই এখানে লেখাপড়ার সুযোগ পেতেন। স্বাধীনতার পর সব ধর্ম সম্প্রদায়ের পড়ুয়ারা সুুযোগ পান। উল্লেখ্য, স্বাধীন গণতন্ত্রী-প্রজাতন্ত্রী ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেইখ মুজিবুর রহমান এই ‘ইসলামিয়া কলেজ’-এরই ছাত্র ছিলেন। তিনি কলেজের, ৮ স্মিথ লেন, কলকাতা ১৩-তে অবস্থিত ‘বেকার গভঃ হোস্টেল’-এ থাকতেন। কলা এবং বিজ্ঞান বিভাগ সমন্বিত কলেজ। প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি- আরবি, ফার্সি, উর্দু ভাষা ও সাহিত্যে সাম্মানিক সহ স্নাতক হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ‘Islamic History & Culture’ বিষয়ে অনার্স সহ গ্রাজুয়েট স্তরের পড়াশানার মান উঁচু স্তরের দক্ষ গ্রন্থাগারিক আরবি, ফার্সি, উর্দু, বাংলা, সর্বোপরি আন্তর্জাতিক স্তরে মান্যতাপ্রাপ্ত গ্রন্থরাজির (ইংরেজি ভাষায়) অশেষ সংগ্রহ সমীহ যোগ্য। বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পাঁচটি ভাষায় প্রকাশিত অসাধারণ গুণমানসম্পন্ন পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন নিয়মিতভাবে পড়ার সুযোগ পান পড়ুয়ারা। বিভাগ পরবর্তী সময়কালে মুসলমান ছাত্রের সংখ্যা বিস্ময়করভাবে হ্রাস পায়। হাল আমলে আবারও লক্ষ্যযোগ্য। মুসলমান ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে। মেধার প্রশ্নটি বিবেচ্য; স্বভাবতই সুবিধাভোগী পরিবার থেকে তরুণ-তরুণীরাই বেশি সুযোগ পাচ্ছেন। গত শতকের শেষের দশক থেকে মৌলানা আজাদ কলেজ সহপাঠক্রমিক। অবিভক্ত বাংলার ‘প্রিমিয়ার শের-এ বঙ্গাল’ এ কে ফজলুল হক (১৮৭৩-১৯৬২) এবং খান বাহাদুর আহসানুল্লাহ ‘ইসলামিয়া কলেজ’ প্রতিষ্ঠায় মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন। স্বাধীনতার পর কলেজটির নাম দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে পাল্টে দেওয়া হয়। ‘সেন্ট্রাল ক্যালকাটা গভ’ কলেজ’ নামে পরিচিত হয়। আজাদ হিন্দুস্তান-এর প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদ-এর ইন্তেকালের পর গত শতকের পাঁচের দশকের মাঝামাঝি সময়ে মৌলানা আজাদ কলেজ নামে চিহ্নিত হয়েছে। কৌতূহলোদ্দীপক একটি তথ্য পেশ করি: ‘সাহিত্য সমিতি’-র তত্ত্বাবধানে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলন’-এর সপ্তম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৮ এবং ৯ মে তারিখে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে। উদ্বোধক ছিলেন অখণ্ড বাংলার মুসলমানদের ‘রেনেসাঁ পুরুষ’ মাওলানা আকরম খাঁ। এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আবু সয়ীদ আইউব। অধ্যাপক পণ্ডিত-প্রবর হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং রবীন্দ্রোত্তর সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আধুনিক কবি বিষ্ণু দে (১৯০৯-১৯৮২) এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। [তথ্যসূত্র: খোন্দকার সিরাজুল হক, ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’, সমাজচিন্তা ও সাহিত্য কর্ম, পৃ. ১০১।] মুসলমান মেয়েদের শিক্ষার জন্য প্রাক স্বাধীনতাকালে সাবেক বাংলার বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছিল। সেই সমস্ত প্রতিষ্ঠানে মুসলমান নারী শিক্ষা বিশেষভাবে উৎসাহিত হয়েছিল। দেশ বিভাগ পরবর্তী পশ্চিমবাংলায় সেই বিষয়টি জটিল হয়ে পড়ে। সাধারণ মুসলমান পরিবারের মেয়েরা খুবই সীমিত সুযোগ পেতে থাকে। অজস্র নজির দেওয়া যেতে পারে, এখানে উদাহরণ হিসেবে, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ, সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল-এর প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হল মাত্র। উচ্চবিত্ত কিছু সংখ্যক মুসলিম ছাত্রী ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান মাত্র। এই প্রসঙ্গটি, ১৯৭০-এর শুরুতে লেখিকা-সমাজকর্মী গৌরী আইউব তুলেছিলেন। হাল আমলে পরিবির্তিত পরিস্থিতিতে অল্প সংখ্যক হলেও বাঙালি মুসলমান মেয়েরা সুযোগ পাচ্ছেন। সঙ্গত কারণেই উল্লেখ্য লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ আর সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যথাক্রমে এ কে ফজলুল হক এবং বাঙালি মুসলমান নারী জাগরণের অগ্রনায়িকা রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। হুগলির মহসীন কলেজ বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে একদা আধুনিক শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটিয়েছিল। এখনও আধুনিক শিক্ষার অন্যতম বিশিষ্ট কেন্দ্র। উনিশ শতকের তিনের দশকে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান ছাত্র একই সঙ্গে পাঠচর্চা করেছেন। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দ তক বস্তুত বাঙালি হিন্দু ছাত্রবর্গই গুরুত্ববাহী সুযোগ পেয়েছেন। বাঙালি মুসলমান জাগরণের মেধা আর মননের প্রতিনিধি সৈয়দ আমির আলি হুগলি মহসীন কলেজ, প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। খোলাখুলি বলা দরকার, হুগলি মহসীন কলেজ ‘সেক্যুলার’ আর আধুনিক একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেখানে সব ধর্মের ছাত্রদের শিক্ষার্জনের সুযোগ রয়েছে। এটি সুক্ষার্থে মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়। ব্রিটিশ সরকার এবং আজাদির পরে রাজ্য সরকার পরিচলিত একটি মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠান।
শেষ কথা
তামিলনাড়ুতে মুসলমান কওমভুক্ত সচেতন কিছু ব্যক্তিবর্গের দ্বারা পরিচালিত বিস্তর ইন্টারমিডিয়েট কলেজ আর স্নাতক কলেজ রয়েছে। ব্যাঙ্গালোর সহ কর্নাটকের ব্যাপক অংশে আধুনিক শিক্ষার সুযোগ রয়েছে। ত্রিচিনোপল্লী, কুর্নল, কালিকট, মাল্লাপপুরম, কাশারগড় ইত্যাকার জেলাঞ্চলে প্রয়োজনীয় সংখ্যক মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তামাম উত্তর ভারতের বিভিন্ন বৃহৎ শহরেও মুসলমানদের দ্বারা পরিচালিত মহাবিদ্যালয়, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লক্ষ্যযোগ্য হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতিটি আশাব্যঞ্জক। বিশ শতকের শেষের দশকে এবং একুশ শতকের প্রথম দশকে আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন ভাইস চ্যান্সেলর সয়ীদ হামিদ মুসলমানদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের সওয়ালে নিজের জীবনকে সঁপে দিয়েছিলেন। তিনি সেই সময় উত্তর ভারতের বিভিন্ন শহর এবং নগরের মধ্যে দিয়ে ‘তালিমি ক্যারাভান’ নামক শিক্ষাযান নিয়ে যাত্রা করেন। মুসলিম মানসে, এই আহ্বানে যথেষ্ট সাড়া পড়েছিল। দেশভাগের সময় উত্তরপ্রদেশের মুসলমানদের অবস্থান ছিল যথেষ্ট সম্মানজনক। সমাজতাত্ত্বিক পল ব্রাশ গবেষণায় তা প্রমাণ করেছেন। বিস্ফোরক তথ্য রয়েছে সেই গবেষণায়। আধুনিক ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমাজবিজ্ঞানী আসগার আলি ইঞ্জিনিয়ারের একটি অনুভব এখানে উদ্ধৃত হল: ‘মুসলমান সমাজের বুকে এক নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব ঘটছে, তারা তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে শিক্ষাক্ষেত্রে কওমের এগোনোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে।... মুসলমান সমাজে শিক্ষা-বিকাশ আর বিস্তারের প্রধান সমস্যা ধর্ম বা অনীহা নয়, দারিদ্র্যই তাদের বিকাশের বা জীবন উজ্জীবনের মূল অন্তরায়।’ দেখুন, ‘মন্থন সাময়িকী’, নভেম্বর-ডিসেম্বর, ২০০২)। একটি ইংরেজি প্রবন্ধের বঙ্গানুবাদের দুটি বাক্য। বঙ্গানুবাদ ‘মন্থন সাময়িকী’। তারিখ পূর্ববৎ। কলকাতা। ‘জ্ঞান সাধকের দোয়াতের করি শহিদের রক্তের চেয়েও পবিত্র।’ জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষার্জন ছাড়া সামগ্রিক উন্নতির আর কোনও পথ খোলা নেই। (সমাপ্ত)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct