সেনাবাহিনীতে “এক পদ এক পেনশন” নীতি চালুর পর দেশের সেনাবাহিনীর বরাদ্দের এক চতুর্থাংশ চলে যায় পেনশন খাতে। অন্যদিকে রিটায়ার্ডের পর পুনরায় কাজের সুযোগ অনিশ্চিত থাকায়, সেনাবাহিনীর শর্ট সার্ভিস বন্ডের ব্যবহার কমে আসায়,সেনাবাহিনীর গড় বয়স প্রায় ত্রিশের উপর। অন্যদিকে দেশের সেনাবাহিনীতে দুই লক্ষেরও বেশী শূন্যস্থান, করোনাকালে নিয়োগ প্রায় তিন বছর বন্ধ, এমন সময়ে “অগ্নিবীর” প্রকল্প দেশের যুবসমাজের কাছে ক্ষোভের বিষয়। এ নিয়ে লিখেছেন তন্ময় সিংহ। আজ শেষ কিস্তি।
তুঘলকি পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নের জন্য শুরু হয় প্রতিশ্রুতির বন্যা। দেশের বর্তমান সেনা থেকে অবসর নেওয়া কর্মীদের নেওয়ার ব্যাপারে যেখানে সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত সংস্থা গুলি উদাসীন। সেখানে শুরু হয় বিভিন্ন সেনা, আধাসেনা সহ সংস্থায় অগ্নিবীর প্রকল্পে বাতিল হয়ে যাওয়া শতকরা ৭৫ জন সেনার ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি। কেন্দ্রের ডাকে এগিয়ে আসে বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থাগুলি তারাও প্রতিশ্রুতি দেন নিয়োগের।আরও একধাপ এগিয়ে বিজেপির এক জাতীয় নেতা অগ্নিবীরদের বিজেপির পার্টি অফিসের সিকিউরিটির দায়িত্ব দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। সেনার বিভিন্ন স্তর থেকেও শুরু হয় বিরোধ, সেনার যে বড় অংশ চুক্তি শেষের পর এখনও কর্মহীন এবং দেশের রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলি যেখানে সংরক্ষণ থাকা সত্ত্বেও মাত্র এক থেকে দুই শতাংশ গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি পোস্ট গুলিতে নিয়োগ করেছে, সেখানে এই চুক্তিসেনাদের জন্য ভবিষ্যতে প্রতিশ্রুতিই সার হবে বলে বিরোধিতা করেন। কর্পোরেট সংস্থাগুলি সেনার অবসরপ্রাপ্ত দের যেখানে নিয়োগ করতে চান না, সেখানে এই “অগ্নিবীর” দের কিভাবে নিয়োগ করবে, সে সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেন অবসরপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর একাংশ। প্রধানমন্ত্রী কৌশল বিকাশ যোজনায় ছয় মাসের ট্রেনিং দিয়ে বেসরকারী নিরাপত্তা রক্ষী নিয়োগের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সেই ছয় মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে নিয়ে সরাসরি আধুনিক সমরাস্ত্র সহ দেশের নিরাপত্তায় কিভাবে কাশ্মীর সহ বিভিন্ন সীমান্তে মোতায়েন হবে “অগ্নিবীর” রা সে প্রশ্ন তুলে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার সাথে আপোষ করা হচ্ছে বলে সরব বিরোধীদের একাংশ। বর্তমানে চরবৃত্তির ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমশ,সেখানে এই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে থাকা “অগ্নিবীর” রা দেশের শত্রুদের পাতা ফাঁদে পা দেবে না তো, সংশয়ে প্রশাসনিক মহল। আবার একই কাজে যুক্ত থাকা একজন সেনার থেকে একজন অগ্নিবীর প্রায় অর্ধেক বেতন সহ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে কিভাবে একই ডেডিকেশন নিয়ে সীমান্তরক্ষা করবে, সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে ওয়াকিবহালের একাংশ। আবার প্রতি চারজন অগ্নিবীরের মধ্যে একজন মাত্রই ভবিষ্যতে পার্মানেন্ট হবে এই ভাবনা থেকে দেশরক্ষায় নিজেদের মধ্যে বন্ডিং তৈরী আদৌও করতে পারবে বা মূল সেনার সাথে সম্বন্বয় তৈরী করতে পারবে অগ্নিবীররা, সেটাই বড় প্রশ্ন।
প্রকল্পের ঘোষণার পর সারা দেশে এর বিরূপ প্রভাব দেখে, সেনাবাহিনীর মিডিয়া সেল বা উচ্চ পদস্থ আধিকারিক দের দিয়ে প্রেস মিট করে ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টা করছে কেন্দ্র। ১৯৪৭ এর পরে পঁচাত্তর বছর পেরোলেও ভারতীয় সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলাপরায়ণাতা বিশ্বে দৃষ্টান্তমূলক। পড়শি দেশগুলিতে সেনাবাহিনীর নানাবিধ সমস্যার মাঝে ভারতীয় সেনাবাহিনী শৃঙ্খলার এক অনন্য নজির কায়েম করে রেখেছে। ট্রিলিয়ন ডলার ইকোনমির স্বপ্ন দেখানো কেন্দ্রীয় সরকার যেখানে নেতা আমলাদের সুরক্ষায় বিশেষ বিমান,সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রোজেক্ট ইত্যাদি ও এমপি এমএলদের নানাবিধ সুবিধা ও ভাতার ব্যবস্থা করছে, সেখানে অর্থনৈতিক কারণে ভারতের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষের দেশসেবার পাশাপাশি আর্থিক স্বচ্ছলতা ও স্বপ্নপূরণের সুযোগ তৈরী হওয়া “সেনার চাকরী” চুক্তি ভিত্তিক করাটা দেশের যুবসমাজকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতে ঠেলে দেওয়া। যদিও সরকার বলছে সমস্ত নিয়োগ চলবে, কিন্তু রেল,বিএসএনএল সহ একগুচ্ছ দেশের নবরত্নের নিয়োগের বর্তমান নিরাশাজনক চিত্রে এই প্রতিশ্রুতিও সোনার পাথরবাটি। বরং একটা শঙ্কা তৈরী হয়ে যায়, এই বেতন বৈষম্য বা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভাগ ভারতীয় সেনায় ভবিষ্যতে কোনো সমস্যার সৃষ্টি করবে না তো, রাজনৈতিক পঙ্কিলতা মলিন করবে নাতো ভারতীয় সেনার শৌর্য।ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি যদি একান্তই অর্থনৈতিক বাধানিষেধ থাকে তাহলে এই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যামে একটি নতুন ব্যাটেলিয়ন তৈরী করে,তাকে পাইলট প্রজেক্ট হিসাবে সেনারই কোনো কাজ বা বিশেষ দায়িত্বে আধাসেনার মতো নিয়োগ করা যেত “অগ্নিবীর” দের। অথবা সার্ভিস পিরিয়ড আরও একটু প্রসারিত করে এককালীন টাকার সাথে এলআইসি কিংবা কোনো বীমার মাধ্যমে আজীবন নূন্যতম পেনশন ও স্বাস্থ্য বীমার সুবিধা আয়ুষ্মান ভারত যোজনায় দেওয়া উচিত। দেশজুড়ে প্রতিবাদের পর আধাসেনায় সংরক্ষণ, আজীবন “অগ্নিবীর সেনা” হিসাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ,কার্যকালে মেডিক্যাল ও ক্যান্টিনের ফেসিলিটি সহ একগুচ্ছ ভ্যালু অ্যাড হয়েছে “অগ্নিবীর” যোজনায়। স্থল, নৌ ও বায়ু সেনায় সেবা করা এই শর্ট টার্ম “অগ্নিবীর” দের জন্য একমাত্র হরিয়ানা সরকারই ঘোষণা করেছে রাজ্যের সমস্ত চুক্তি শেষ হওয়া অগ্নিবীরদের পুনরায় নিয়োগ করা হবে। একমাত্র এরকম স্বচ্ছ আশ্বাসকে আইনসভায় পাশ করে লিপিবদ্ধ আইন করলে “অগ্নিপথ” এর “অগ্নিবীর” দেশের যুবসমাজের ক্ষোভ প্রশমিত করতে পারে। সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার এবং কর্পোরেট গুলি এগিয়ে এসে দেশের ভবিষ্যত, দেশের সীমানা রক্ষাকারীদের ভবিষ্যত সুনিশ্চিত করতে পারে। (সমাপ্ত)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct