সেনাবাহিনীতে “এক পদ এক পেনশন” নীতি চালুর পর দেশের সেনাবাহিনীর বরাদ্দের এক চতুর্থাংশ চলে যায় পেনশন খাতে। অন্যদিকে রিটায়ার্ডের পর পুনরায় কাজের সুযোগ অনিশ্চিত থাকায়, সেনাবাহিনীর শর্ট সার্ভিস বন্ডের ব্যবহার কমে আসায়,সেনাবাহিনীর গড় বয়স প্রায় ত্রিশের উপর। অন্যদিকে দেশের সেনাবাহিনীতে দুই লক্ষেরও বেশী শূন্যস্থান, করোনাকালে নিয়োগ প্রায় তিন বছর বন্ধ, এমন সময়ে “অগ্নিবীর” প্রকল্প দেশের যুবসমাজের কাছে ক্ষোভের বিষয়। এ নিয়ে লিখেছেন তন্ময় সিংহ। আজ প্রথম কিস্তি।
১৩০ কোটি মানুষের দেশ ভারতবর্ষ, বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুল ও সপ্তম বৃহত্তম আয়তনের স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। বিশাল দেশের ছটি বিভিন্ন দেশের সাথে বিশাল আয়তনের সীমান্ত নিরাপদ আছে,কারন ভারতীয় সেনা সীমান্ত রক্ষা করছে,এই ধারনা বদ্ধমূল প্রত্যেক ভারতবাসীর মননে। সেই ধারণাতে ধাক্কা লাগলো হঠাৎ করে চুক্তিভিত্তিক সেনা নিয়োগের ঘোষনায়, অগ্নিসংযোগ হলো দেশের সম্পত্তিতে। তবুও সরকার বদ্ধপরিকর প্রকল্পটি এগিয়ে নিয়ে চলার। চার বছরের চুক্তি ভিত্তিক কাজ,একুশ হাজারে শুরু করে চার বছরে একশ্রিশ হাজার হাতে নগদ মাসিক বেতন,ও চার বছরের শেষে এককালীন এগার লক্ষ টাকা সহ প্রতি চারজনে তিনজন বাতিল ও পেনশনহীন এই ছিল “মিশন অগ্নিপথ”। নব্বইয়ের দশকে নতুন করে অ্যাংরি ইয়াং ম্যানের অবতারে, হরিবংশ রায় বচ্চনের কবিতা “অগ্নিপথ” কে ক্যাচলাইন করে আর্বিভাব হয় অমিতাভ বচ্চনের। “তু না থকেগা কভি, তু না রুকেগা কভি,তু না মুড়েগা কভি, কর শপথ, কর শপথ, কর শপথ,অগ্নিপথ,অগ্নিপথ,অগ্নিপথ।” সারা দেশে হিল্লোল তুলে “অগ্নিপথ”। পরবর্তীতে সফলতার সাথে রিমেক করেন হৃতিক রোশন। সেই ট্যাগলাইন কে সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়ে ২০২৪ এর ফসল তোলার জন্য বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের পিআর টিম, চুক্তি ভিত্তিক সেনা নিয়োগের পরিকল্পনার নাম দেন “ মিশন অগ্নিপথ”, চুক্তিসেনার নাম হয় “অগ্নিবীর”।
সেনাবাহিনীতে “এক পদ এক পেনশন” নীতি চালুর পর দেশের সেনাবাহিনীর বরাদ্দের এক চতুর্থাংশ চলে যায় পেনশন খাতে। অন্যদিকে রিটায়ার্ডের পর পুনরায় কাজের সুযোগ অনিশ্চিত থাকায়, সেনাবাহিনীর শর্ট সার্ভিস বন্ডের ব্যবহার কমে আসায়,সেনাবাহিনীর গড় বয়স প্রায় ত্রিশের উপর। অন্যদিকে দেশের সেনাবাহিনীতে দুই লক্ষেরও বেশী শূন্যস্থান, করোনাকালে নিয়োগ প্রায় তিন বছর বন্ধ, এমন সময়ে “অগ্নিবীর” প্রকল্প দেশের যুবসমাজের কাছে “আই ক্যান্ডি” হবে ও সাথে সাথে সেনাবাহিনীতে প্রয়োজনীয় “ইয়াং ব্লাড” ইনজেক্টের যে আশু প্রয়োজন ছিল, তারও সমাধান হবে এটাই ছিলো “অগ্নিবীর” প্রকল্পের কারণ। চার বছরের সার্ভিস পিরিয়ড,একুশ হাজার টাকা ইন হ্যান্ড বেতন থেকে শুরু,এগার লক্ষ টাকা সহ রিটায়ার্ড। পেনশন, রেশন, স্বাস্থ্যের কোনো সুবিধা নেই ও পরবর্তীতে “সেনা” পরিচয় ব্যবহার করা যাবে না এই নজরে এই ছিলো প্রাথমিক ড্রাফট। চার বছরে প্রায় দু লক্ষ অগ্নিবীর সেনার গড়বয়স ২৫ এর মধ্যে নামিয়ে আনত ও সরকারের অর্থকোষের ব্যাপক ঘাটতি ছাড়াই কাজটি সম্পন্ন হতো। এই দু লক্ষ নিয়োগের সুফল উঠত ২০২৪ এর লড়াইয়ে এটাই ছিলো কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের মূল লক্ষ্য।
কিন্তু তুঘলকি শাসনেও যেমন কোনো পদক্ষেপের কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে,সে সম্পর্কে বিবেচনা করা হতো না। নোট বন্দী,লকডাউনের হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেওয়া সরকার এবারও প্রতিক্রিয়ার কথা আন্দাজ করতে পারেনি। স্বাধীন ভারতে ভারতীয় সেনা ও আধাসেনার কাজ সমাজে খুব গর্বের সাথে গৃহীত হয়। নিরাপদ পেনশন, কেন্দ্রীয় সরকারের পে কমিশনের ফলে বর্ধিত বেতন, পরবর্তীতে চাকরির সুযোগ, স্বাস্থ্য ও রেশনে সারাজীবনের সুবিধা এগুলো নিয়ে হরিয়ানা, পাঞ্জাব সহ হিন্দু হার্টল্যান্ড উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, দিল্লী, বিহারের গ্রামীণ এলাকায় লক্ষ লক্ষ যুবক সেনা ও আধাসেনায় কর্মরত। মূলত শাসকদলের রাজ্যগুলিতে অনিশ্চিত ভবিষ্যতে অর্ধেক বেতনে কম সময়ের এই চুক্তি ভিত্তিক সেনার কাজের খবর আসতেই ঘৃতাহুতি পড়ে। রাষ্ট্রীয় সম্পদের ব্যাপক ধংস্বলীলায় সপ্তাহ খানেক অচল হয়ে পড়ে যোগাযোগ। দেশের যুবসমাজ পথে নেমে প্রতিবাদ জানায় “অগ্নিপথের”। এই রাষ্ট্রীয় সম্পদের ধ্বংস ও সাধারন মানুষের অসুবিধা ঘটানোর এই আন্দোলনকে দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ সমর্থন না করলেও, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল “ অগ্নিবীর” প্রকল্পের বিরোধিতায় এগিয়ে আসে। শেষপর্যন্ত পিছু না হঠলেও একগুচ্ছ নতুন সুবিধা যোগ করতে বাধ্য হয় কেন্দ্র ও সরকারের সহযোগিতায় এগিয়ে আসা কর্পোরেটগুলি।
তুঘলকি পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নের জন্য শুরু হয় প্রতিশ্রুতির বন্যা। দেশের বর্তমান সেনা থেকে অবসর নেওয়া কর্মীদের নেওয়ার ব্যাপারে যেখানে সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত সংস্থা গুলি উদাসীন। সেখানে শুরু হয় বিভিন্ন সেনা, আধাসেনা সহ সংস্থায় অগ্নিবীর প্রকল্পে বাতিল হয়ে যাওয়া শতকরা ৭৫ জন সেনার ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি। কেন্দ্রের ডাকে এগিয়ে আসে বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থাগুলি তারাও প্রতিশ্রুতি দেন নিয়োগের।আরও একধাপ এগিয়ে বিজেপির এক জাতীয় নেতা অগ্নিবীরদের বিজেপির পার্টি অফিসের সিকিউরিটির দায়িত্ব দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। সেনার বিভিন্ন স্তর থেকেও শুরু হয় বিরোধ, সেনার যে বড় অংশ চুক্তি শেষের পর এখনও কর্মহীন এবং দেশের রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলি যেখানে সংরক্ষণ থাকা সত্বেও মাত্র এক থেকে দুই শতাংশ গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি পোস্ট গুলিতে নিয়োগ করেছে, সেখানে এই চুক্তিসেনাদের জন্য ভবিষ্যতে প্রতিশ্রুতিই সার হবে বলে বিরোধিতা করেন। কর্পোরেট সংস্থাগুলি সেনার অবসরপ্রাপ্ত দের যেখানে নিয়োগ করতে চান না, সেখানে এই “অগ্নিবীর” দের কিভাবে নিয়োগ করবে, সে সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেন অবসরপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর একাংশ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct