‘ইন্ডিয়া টুডে’র‘মুড অফ দ্য নেশন সার্ভে’-এর সর্বশেষ রাউন্ড, দেশের জনসাধারণের এই মুহূর্তের মতামত অনুধাবনের জন্য একটি জনমত সমীক্ষায় উঠে এসেছে, যদি লোকসভা নির্বাচন এবছর অর্থাৎ ২০২২ সালের ১৫ জুলাই থেকে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত হত, সেক্ষেত্রে বিজেপির আসন সংখ্যা কমে দাঁড়াত। সেই সঙ্গে কমে দাঁড়াত এনডিএর মোট আসন সংখ্যাও। বিহারের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগে এই জনমত সমীক্ষাটি করা হয় যা বিশেষ বার্তাবহ। লিখেছেন যোগেন্দ্র যাদব। আজ শেষ কিস্তি।
জনমত সমীক্ষার একজন গবেষক হিসাবে, সাধারণ মানুষের তরফে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মূল্যায়নের চেয়ে পরিবারিক অর্থনৈতিকপরিস্থিতির ব্যাপারে তাদেরপ্রতিক্রিয়ায় অনেক বেশি করে আস্থা রাখি। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে ইচ্ছামতো উজ্জ্বল কিংবা অন্ধকারাচ্ছন্ন হিসাবে তুলে ধরে মানুষকে বোকা বানানো সহজ। কিন্তু দৈনন্দিন সাংসারিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বিষয়ে জনতাকে ঠকানো যায় না। কিন্তু গত ৬ বছর ধরে ‘ইন্ডিয়া টুডে’ মানুষকে প্রশ্ন করে গেছে, “২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশের অর্থনীতির কতটা পরিবর্তন হয়েছ বলে মনে করেন?” এরকম প্রশ্নের মাধ্যমে একদিকে সূক্ষ্ম কায়দায় নরেন্দ্র মোদির নামটাকে আরও বেশি করে জনপ্রিয় করে তোলা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এই প্রশ্নটি এমনভাবে করা হয়েছে, যার অভিমুখটাই ছিল মোদির পক্ষে। যদিও ৩৬ শতাংশের প্রতিক্রিয়া যে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশই খারাপ হয়েছে। তুলনায়, ২৮ শতাংশ মানুষের প্রতিক্রিয়া যে ২০১৪-র থেকে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি জারি আছে। অর্থাৎ এই যে বেশি সংখ্যক মানুষ যারা নিজেদের পরিস্থিতির উন্নতি আশা করেন কিন্তু তাঁদের আশঙ্কা যে অদূর ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক অবস্থা আরও খারাপ হবে— এই পরিসংখ্যান যেকোনও সরকারের জন্য ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে। এমনকি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকার পতনের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
অর্থনীতি থেকে রাজনীতি অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে রাজনৈতিক সম্ভাবনায় নিয়ে যাওয়ার বিষয়টা নির্ভর করে মানুষ তাদের খারাপ অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য সরকারকে দোষারোপ করছে কিনা তার ওপর। এক্ষেত্রেও মোদি সরকারের জন্য খবরটা মোটেও ভালো নয়। সরকারের অর্থনৈতিক নীতির ইতিবাচক রেটিং এখন মাত্র ৪৮ শতাংশ, যা গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন রেকর্ড। আর সরকারের অর্থনৈতিক নীতির বিপক্ষে নেতিবাচক রেটিং এখন ২৯ শতাংশ, যা পিছনের নেতিবাচক রেটিং-এর তুলনায় সর্বোচ্চ। এনডিএ সরকারের ‘সবচেয়ে বড় ব্যর্থতার কথা জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনটি প্রধান উল্লেখযোগ্য বিষয়ই হবে অর্থনীতি সম্পর্কিত – মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। তবে হ্যাঁ, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক নীতির নেতিবাচক মূল্যায়ন এখনও ইতিবাচক মূল্যায়নকে ছাড়িয়ে যায়নি। এবং সরকারের সামগ্রিক মূল্যায়ন এখনও বেশ ইতিবাচক। যেহেতু কাশ্মীর, রাম মন্দির, দুর্নীতি এবং আশ্চর্যজনকভাবে কোভিডের মতো অন্যান্য সমস্যাকে মোকাবিলার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের সমর্থন পেয়েছে। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব কমার কোনো লক্ষণ না থাকায় কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
তবে এটাও আবারও বলা দরকার যে যদি কেউ এখনই মনে করেন যে মোদি সরকারের পতনের সূচনা হয়ে গেছে, সেক্ষেত্রে এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াটা তাড়াহুড়ো করে ফেলা হবে এবং গভীরে চিন্তা ও পর্যালোচনা করে সিদ্ধন্তে পৌঁছানোর বদলে ‘অলস সিদ্ধান্ত’ হিসাবেই বিবেচিত হবে। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা এখনও অটুট। যদিও যাঁরা তাঁর কাজকে অসফল বা চূড়ান্ত ব্যর্থ হিসাবে মূল্যায়ন করেন, তাঁদের সংখ্যাটাও এখন অনেক।কিন্তু এটা ঠিক যে এখনও পর্যন্ত কোনো বিরোধী নেতা জনপ্রিয়তার বিচারে প্রধানমন্ত্রীর ধারে-কাছেও পৌঁছাননি। যদিও গণতান্ত্রিক কাঠামোর সাম্প্রতিক অবস্থার ব্যাপারে একটি চিহ্নিত অস্বস্তি রয়েছে। যাঁরা মনে করেন দেশের গণতন্ত্র বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে,তাঁদের সংখ্যা স্পষ্টতই চিহ্নিত, যাঁরা এটা মনে করেন না তাঁদের চেয়ে। আক্ষেপের বিষয়, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ধ্বংস হওয়া কিংবা বাকস্বাধীনতাকে বাধা দেওয়ার মতো বিষয়ে জনগণের কোনো ক্ষোভ নেই। ভারতীয়রা উদারনৈতিক ও সক্রিয় গণতন্ত্রের থেকেকেন্দ্রীয় সরকারের অহংকার এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণকেই পছন্দসই মনে করছে বোধহয়! সম্প্রতি আমার কলামেবলেছিলাম, ২০২৪ সালের নির্বাচনে তাঁদের জন্য জনসমর্থন ইতিমধ্যেই নির্ধারিত হয়ে গেছে বলে প্রচার চালানো হচ্ছে, যাকে তারা বলছে ‘done deal’, সেটা সমর্থন করার মতো কোনো কারণই নেই। আসলে বিজেপি তার পদলেহনকারী মিডিয়াদের মাধ্যমে এই ধরণের সার্কাস চালাতে পারদর্শী। এটা ছাড়া এই ধরনের কথার কোনো মূল্য নেই। আমাদের এখনই ধরে নেওয়া উচিত নয় যে বিজেপি নিশ্চিতভাবেই জিততে বা হারতে চলেছে। বিহারের পটপরিবর্তন, তাকে ঘিরে নির্বাচনী ভিত্তিরেখার পরিবর্তন এবং এই সমীক্ষায় উঠে আসা অর্থনৈতিক দুরাবস্থার প্রসঙ্গ স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে যে নির্বাচনী দৌড়ের রাস্তা এখনও খোলা আছে। আর সেই ঐতিহাসিক দায়িত্বভার এখন বিরোধী শিবিরের ওপরেই বর্তায়। (সমাপ্ত...)
লেখক ‘স্বরাজ ইন্ডিয়া’র প্রতিষ্ঠাতা।
অনুবাদ: অতনু সিংহ
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct