পৃথিবী থাকার স্থান নয়, চিরদিন এখানে থাকা যায় না, কেউ থাকেনি। থাকা নয়, বরং চলে যাওয়াই সুনিশ্চিত। অথচ তার পরও আমরা সোনার হরিণ বা মরীচিকার পেছনে আমৃত্যু দৌড়িয়েই চলছি। এখন ২০২২ সাল। আজ থেকে ১০০ বছর পরের কথা একটু কল্পনা করি। ক্যালেন্ডারের পাতায় তখন ২১২২। আজকে আমরা যারা এ পৃথিবীতে বেঁচে আছি, সে সময় আমাদের এক জনও হয়তো বেঁচে থাকব না। প্রত্যেকে আমরা পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব। শতবর্ষ পরের ভাবনা নিয়ে লিখেছেন এ বি এম আবদুল্লাহ। আজ শেষ কিস্তি।
আসলে বাস্তবতা হচ্ছে এই জীবনটা আমাদের কল্পনার চেয়েও ছোট। এই স্বল্প সময় বিলাসব্যসনে পার করে দেওয়া যায় বইকি, কিন্তু তার চেয়ে হাজার গুণে উত্তম হবে পরার্থে পরিচালিত করা। কিন্তু আমরা কি তা করছি? মানুষ তো সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব, সৃষ্টিকর্তা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই কিন্তু মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, যেন তারা স্রষ্টার আরাধনা এবং অন্যের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করে। তেমন আচরণ কি আমরা করছি? আমরা কি নিজের সময়, শ্রম, জ্ঞান মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করছি? বরং এর বিপরীত। আজ আমরা সামান্য কারণে মানুষের প্রতি বিরাগভাজন হই, মানুষকে ঠকাই, পরনিন্দা করি, অন্যের হক নষ্ট করি, অবিচার করি, মারামারি করি, এমনকি মানুষকে খুনও করে ফেলি। মানুষের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি, হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা, যুদ্ধবিগ্রহ, লোভলালসা, অহংকার, সহনশীলতার অভাব, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থপরতা এখন সারা পৃথিবীব্যাপী ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। মানবিক মূল্যবোধ, মায়া-মমতা, মানবতা, পরার্থপরতা আজ ভূলুণ্ঠিত।
তাই আসুন, মানুষকে ভালোবাসি, অসহায়দের প্রতি সাহায্যের হাতটা বাড়িয়ে দিই। জীবন যে দুদিনের, সেই অল্প সময়টাকে মানুষের কাজে লাগাই। এতে ক্ষণকালের ভোগবিলাস হয়তো কম হবে, কিন্তু তার প্রতিদান পাওয়া যাবে পরবর্তী অনন্ত জীবনে, যেখান থেকে আর ফেরা যাবে না কখনো। অনন্ত পরকালে বিশ্বাসী যারা, তাদের এতে দ্বিমত হওয়ার কোনো উপায় নেই। যে উদ্দেশ্য নিয়ে সৃষ্টিকর্তা আমাদের এ সুন্দর পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, আমরা কি তার মর্যাদা দিতে পারছি? যে ধর্মই মেনে চলেন না কেন, সব ধর্মই মানবসেবার কথাই বলে। মানুষকে কষ্ট দেওয়া, মানুষকে ঠকানো, মানুষের ক্ষতি করা কোনো ধর্মই প্রশ্রয় দেয় না। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মৃত্যুশয্যার একটি গল্প প্রচলিত আছে। তিনি মাত্র ৩৩ বছর বেঁচেছিলেন। এই অল্প সময়েই তিনি হয়েছিলেন দিগ্বিজয়ী বীর। কিন্তু মৃত্যুর সময় তিনি আসলে কী নিয়ে গেলেন? বলা হয়, মৃত্যুশয্যায় আলেকজান্ডার তার জেনারেলদের ডেকে বলেছিলেন, আমার মৃত্যুর পর তিনটা ইচ্ছা তোমরা পূরণ করবে। ‘আমার প্রথম অভিপ্রায়, শুধু ডাক্তারেরা আমার কফিন কবরস্থানে বহন করে নিয়ে যাবে। আমার দ্বিতীয় অভিপ্রায়, আমার কফিন যে পথ দিয়ে গোরস্থানে নিয়ে যাওয়া হবে, সেই পথের দুপাশে আমার কোষাগারে সংরক্ষিত টাকাপয়সা, মণিমুক্তা, সোনাদানা, রুপা ছড়িয়ে দেবে। শেষ অভিপ্রায়, কফিন বহনের সময় আমার দুই হাতের তালু ওপর দিকে রেখে কফিনের বাইরে রাখবে।’ উপস্থিত সবাই আলেকজান্ডারের এই অদ্ভুত অভিপ্রায়ে বিস্মিত হন। কিন্তু এ ব্যাপারে তাকে কেউ কিছু জিগ্যেস করার সাহস পাচ্ছিলেন না। তখন তার একজন প্রিয় সেনাপতি তার হাতটা তুলে ধরে চুম্বন করে বলেন, ‘হে মহামান্য, অবশ্যই আপনার সব অভিপ্রায় পূর্ণ করা হবে। কিন্তু আপনি কেন এই বিচিত্র অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন?’ দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে আলেকজান্ডার বললেন, ‘আমি দুনিয়ার মানুষের সামনে তিনটি শিক্ষা রেখে যেতে চাই। আমি আমার ডাক্তারদের কফিন বহন করতে বলেছি, যাতে লোকে অনুধাবন করতে পারে ডাক্তাররা রোগের চিকিৎসা করে মাত্র, মৃত্যুর থাবা থেকে কাউকে রক্ষা করতে অক্ষম। মৃত্যু যখন আসবে তখন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ডাক্তারেরা একসঙ্গে মিলেও বাঁচাতে পারবে না। মানুষকে এটা বোঝাতে যে, ঐ সোনাদানার একটা কণাও আমার সঙ্গে যাবে না। আমি এগুলো পাওয়ার জন্য সারাটা জীবন ব্যয় করেছি, কিন্তু নিজের সঙ্গে কিছুই নিয়ে যেতে পারছি না। মানুষ বুঝুক, ধনসম্পদের পেছনে ছোটা সময়ের অপচয় মাত্র। বাউলের ভাষায়, ‘খ্রিস্টান হইলে কফিনে, মুসলিম হইলে কাফনে, হিন্দু হইলে চিতায় পুড়ে ছাই। ও মানব, দুই দিনের এই দুনিয়াতে, গৌরব করার নাই রে কিছু নাই।’ (সমাপ্ত)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct