সঞ্জীব চ্যাটার্জি: রাত তখন দশটা হবে। আমি আর আমার স্ত্রী রাত্রে ডিনারের পর একটু হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। এসেছিলাম ঘুরতে চিরালা। এটি অন্ধ্রের উপকূলবর্তী একটা জেলার মতো। সে ভাবে পরিণত হয় নি। তাই আধুনিক “বিচ”-এর সংজ্ঞা দিয়ে একে ব্যাখ্যা করা যায় না। চারিদিকে চাষ হচ্ছে। ধান মূলত, সাথে পেঁপে, ফুল আর কিছু কাজুর বাদাম গাছ। বিশাল বিশাল ট্রাক্টরের মতো দৈত্যাকার যন্ত্রের সাহায্যে নিয়ে কাজ চলছে। কিন্তু সমুদ্র সৈকতের একটা নির্লিপ্ততা কিন্তু রোম্যান্টিকতা দুটোই আছে এখানে। অন্তত আমার তো তাই মনে হল।
যাই হোক আমার গল্পের উপজীব্য সমুদ্রসৈকতের স্থান মাহাত্ম্য নয়। আমরা যেখানে আছি,জায়গাটার নাম রাজা রামমোহন রায় রোড ক্লথ মার্কেট। অন্তত পাঁচ থেকে ছয় কিলোমিটার জায়গা জুড়ে রকমারি কাপড়ের দোকান। মূলত হোলসেলার। কলকাতার বড়বাজারের মতোই তবে ওই মারওয়ারীদের জায়গা নিয়েছে দক্ষিণের লোকাল মানুষেরা। ফলে চমকপ্রদ সস্তায় জিনিস পাওয়া যায়।
যে রাস্তাটা দিয়ে ফিরছিলাম, অন্ধকার গলির মতো। ওই চৌরাস্তার সৌরভের বাড়ির গলির মাপেই হবে। তা ফিরছিলাম যখন দেখি প্রায় প্রত্যেকটা বাড়িতে কাপড়ের উপর জরির কাজ হচ্ছে। প্রথম বার দেখলাম। অসাধারণ সূক্ষ্ম কাজ। বিভিন্ন ঘরের মেঝেতে খাটিয়া পাতা আর মাথা গুঁজে একমনে কাজ করে চলেছেন কিছু বিশ্বকর্মার বরপুত্ররা। এই যে আমরা দেখি চোখ ধাঁধানো শাড়ি যার দাম কখনো সখনো লাখ টাকার উপরে চলে যায়, সেই সব শাড়ির সূতিকা গৃহ তবে এই সব জায়গা?
একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অবাক বিস্ময়ে জরির কাজ দেখছিলাম। কি অসাধারণ নিখুঁত দক্ষতা যাকে আমরা পারফেক্ট প্রেসিসন বলি। স্ত্রীকে বলছিলাম দেখ কি অপূর্ব।
কপাল ভালো ছিল। এক ভদ্রলোক, বয়স কত হবে, বড় জোর তিরিশ, আমাকে বললেন আপনারা বাঙালি? সত্যি বলছি, এত ভালো লাগলো ওই মুহূর্তে।
ব্যাস, পরের ঘণ্টা আধেক গল্প করেই কেটে গেল। বেশভূষা দেখে বোঝা যাচ্ছিল ওনারা মুসলিম। কথায় দক্ষিণ চব্বিশের গ্রাম্য টান স্পষ্ট। জানতে পারলাম ওরা সরিষার কাছে উস্থির বাসিন্দা। বছরে কয়েক বার আসে এখানে। মূলত সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ উৎসব আর বিয়ের সময়টুকু মূলত। এছাড়া হঠাৎ কাজের দরকার থাকলে খবর যায়। এরা চলে আসে।
এরা কাজ করে সকল নয়টা থেকে রাত বারোটা অবধি। মাঝে খাবার ছুটি। একটা বড় শাড়ির কিছু অংশ এরা ভাগ করে নেয়। ডিজাইনার এদের ডিজাইন দিয়ে দেয়। সেই অনুযায়ী নিখুঁত ভাবে ওই সাদামাটা কাপড়ের উপর রামধনুর মতো উজ্জ্বল হাতের কাজের ফুটিয়ে তোলে এরা।
একটা শাড়ি তৈরি করে এরা পায় হাজার দেড়েক। তিন জনে হাজার দেড়েক ভাগ করে নেয়। অর্থাৎ গড়ে ওই পাঁচশোর মতো। আর বাজারে আমরা কত টাকায় কিনি? অন্তত হাজার দশেক। অর্থাৎ টাকার যোগ্য দাবিদার যারা তাদের কাছে মাত্র দশ শতাংশ টাকা পৌঁছাচ্ছে। তাহলে আর এদের অবস্থার উন্নতি হবে কি করে।
জানি ভারতের এই মিডলমান চক্র এদের দুর্দশার জন্য সরাসরি দায়ী তবু অসহায়ের মতো একটা জঘন্য সিস্টেম কে মেনে নিতে হয়। এদের কথা কেউ বলেনি আর বলবেও না। কারণ...” এটাই চলে আসছে, আমরা ভাবতে অভ্যস্ত নয়”।
একজন দেখলাম বাটিতে শুকনো মুড়ি খাচ্ছে। এত খারাপ লাগল। যে সব ডিজাইনাররা এদের দিয়ে কাজ করায় তারা আজ কোটিপতি।
জনা পাঁচেক ছিল। চারজন বাঙালি আর একজন লখনউ-এর। চলে আসার সময় জিগ্যাসা করলাম আপনাদের নাম কি ভাই?
দেখি এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। একজন দেখলাম ভয়ে ভয়ে বলল, আমরা দাদা মুসলিম।
সত্যি বলছি পাঠকগণ, একটা চড় খেলাম মনে হল। একটা স্বাধীন দেশে খেটে খাওয়া শোষিত কিছু মানুষ নিজের নাম বলতে ভয় পাচ্ছে মুসলিম বলে? এটা আমরা কোন দেশে আছি? পুরো অনুভূতি গুলি যেন ঘেঁটে ঘ হয়ে গেল। তার মানে কি ? এরা ভাবছে যেহেতু আমি হিন্দু তাই এরা মুসলিম জানলে আমি বিরক্ত বোধ করবো ? কথা বন্ধ করব দেব ওদের সাথে ?
ওরা জানেও না আমি কতটা লজ্জিত হয়েছি। শুধু আমি না, আমার এইটুকু ভরসা আছে বেশির ভাগ হিন্দু এই ঘটনাটা জানলে লজ্জা পাবে।
কিন্তু এর সমাধান কি ? এই ভাবে ভীতি তৈরি হওয়াকে কিছু মানুষ হয়তো ভাবে সফল হলো তাদের ঘৃণার রাজনীতি, কিন্তু এটা চূড়ান্ত ব্যর্থতা। “ভারত টেরে টুকরে হঙ্গে” - এটা কি বাস্তবতার দিকে এগোচ্ছে ? এই মুহূর্তে প্রতিবাদ করুন। নইলে আমি আর আপনিও দায়ী থাকবো। অনেক দেরি হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। তবু চেষ্টা করে যান।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct