ফৈয়াজ আহমেদ: লকডাউন পরবর্তী সময়ে ব্যবসায়ীরা চরম সঙ্কটে। ব্যবসা চালাতে চাই ঋন, এই চাহিদা মেটাতে নির্দিষ্টভাবে ছোট ব্যবসায়ীদের কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক, সরকারি ও বেসরকারিআর্থিক সংস্থা ঋণ প্রকল্পের ব্যবস্থা করেছে। এছাড়াও রয়েছে বিজনেস ক্রেডিট কার্ড। ব্যবসা লোন ও ব্যবসায়িক ক্রেডিট কার্ড- দুটিরই রয়েছে কিছু সুবিধা ও অসুবিধার দিক। ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করার আগে জেনে নেওয়া ভাল আপনার ব্যবসার প্রয়োজনের জন্য কোনটি বেশি উপযোগী।
চালু মূলধন ঋণ বা ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোন
ছোট ব্যবসাদের চালু মূলধনের প্রয়োজন মেটাতে সহজ শর্তে ও কম সুদের হারে একাধিক ঋণ প্রকল্প রয়েছে। নিজেদের প্রতিদিনের ব্যবসার খরচ যোগাতে বহু ছোট ব্যবসায়ীকেই এই ঋণ প্রকল্পের সুযোগ নিতে হয় ব্যবসার বিভিন্ন পর্যায়ে। ঋণ করা টাকার ওপর সুদ দিতে হয় ঠিকই কিন্তু সেই সুদের হার বিজনেস ক্রেডিট কার্ডের অ্যানুয়াল পার্সেন্টেজ রেট (এপিআর)-এর থেকে কম। এই সব ঋণ প্রকল্পে সাধারণত বেশ বড় অঙ্কের টাকা ঋণ হিসেবে পাওয়া যায় এবং তা পরিশোধের জন্য অনেক বেশি সময় পাওয়া যায়। তবে ক্রেডিট হিস্ট্রি বা অতীতের ঋণের ক্ষেত্রে রেকর্ড খারাপ হলে এই ঋণ পেতে সমস্যা হতে পারে।
ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোনের সুবিধা
ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোন নিলে তত্ক্ষণাত হাতে আসে বেশ কিছু নগদ টাকা যা আপনি আপনার ব্যবসার প্রয়োজন মেটাতে পারবেন। অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবসা চালু রাখতে হঠাত্ করেই বেশ কিছু নগদের প্রয়োজন পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে এই নগদ কাজে আসবে।
এছাড়াও সাপ্লায়ার ও যেসব কর্মীরা দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে বেতন পান তাঁদের টাকা দেওয়ার জন্য ছোট ব্যবসায় নগদের যোগান প্রয়োজন। সাময়িক চাহিদা মেটানোর জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোন খুবই কার্যকরী। এক্ষেত্রে আপনার হাতে নগদ টাকা থাকে, টাকার পাওয়ার জন্য কোনও পেমেন্ট গেটওয়ের দ্বারস্থ হতে হয় না। এর ফলে আপনি আপনার কোম্পানির উত্পাদন স্বাভাবিক রাখতে পারেন ও টাকা অভাবে তা বন্ধ হয়ে যাওয়া আটকাতে পারেন। এছাড়াও আপনি সময়ে মতো সব বিল মেটাতে পারেন ফলে আপনার বিজনেস্ ক্রেডিট রেটিং অক্ষুণ্ন থাকে।
কোল্যাটারাল ছাড়া ঋণ পাওয়া
ছোট ব্যবসায়িক লোনের ক্ষেত্রে সাধারণত কোল্যাটারাল প্রয়োজন হয়। অর্থাত্ আপনি যদি ঋণ শোধ করতে না পারেন সেক্ষেত্রে ঋণদাতা সংস্থা আপনার সেই সম্পদের ওপর নিজেদের মালিকানা স্থাপন করতে পারে। ভূসম্পত্তি, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি নানা জিনিস কোল্যাটারাল হিসেবে দেওয়া যায়। কিন্তু ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোনে কোনও কোল্যাটারাল দাখিল করার প্রয়োজন পড়ে না।
ঋণ পরিশোধের সহজ শর্ত
ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোন সাধারণত শর্ট টার্ম-এর জন্য পাওয়া যায় এবং পরিশোধের শর্তগুলো হয় সহজ। এই ঋণ প্রকল্পগুলো এমনভাবেই পরিকল্পনা করা হয় যাতে আপনি সহজে ও তাড়াতাড়ি ঋণ পরিশোধ করে দিতে পারেন। এই ঋণের টাকা আপনি ব্যবসার যেকোনও কাজে ব্যবহার করতে পারেন তবে ঋণ পাওয়ার জন্য উপযুক্ত কারণ ও পরিকল্পনা দর্শাতে হবে। ঋণদাতা সংস্থার যদি আস্থা জন্মায় যে আপনি ঋণের টাকাটা যথা সময়ে ফেরত্ দিতে সক্ষম শুধুমাত্র তখনই তারা ঋণ মঞ্জুর করবে।
ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোনের অসুবিধা
ঋণ পরিশোধের কম সময়সীমা
ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোন দেওয়া হয় ব্যবসার সাময়িক নগদের প্রয়োজন মেটাতে। ফলে কম দিনের মধ্যে এই ঋণ পরিশোধ করে দিতে হয়। সাময়িক সমস্যা সামাল দিয়ে ব্যবসা থেকে লাভ করে ঋণের টাকা ফিরিয়ে দিতে হবে- ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোন মূল ধারনা এটাই।
বেশি সুদের হার
এই ঋণগুলো যেহেতু স্বল্প সময়ের জন্য হয় তাই সুদের হার অন্যান্য ছোট ব্যবসায়িক ঋণের থেকে বেশি হয়। তবে সেই সুদের হার বহন করেও ব্যবসার জন্য এই ঋণ লাভজনক হতে পারে। ফলে সেই হিসেব করেই ঋণ নেওয়া উচিত্।
বিজনেস ক্রেডিট কার্ড
বিজনেস ক্রেডিট কার্ড কাজ করে সাধারণ ক্রেডিট কার্ডের মতোই। অর্থাত্ আপনি সারা মাস সেই ক্রেডিট কার্ড থেকে খরচ করলেন ও বিলিং সাইকেল-এর শেষে বিল এলে তা মিটিয়ে দিলেন। এর জন্য আপনাকে কোনওরকম সুদ দিতে হবে না। আংশিক বিল মেটানোরও সুযোগ থাকে। কিন্তু আপনি যদি আপনার ক্রেডিট বিল যথা সময়ে মেটাতে না পারেন সে ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের সুদ দিতে হবে।
বিজনেস ক্রেডিট কার্ডের সুবিধা
বিজনেস ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের জন্য ক্রেডিট কার্ড সংস্থার পক্ষ থেকে রিওয়ার্ড দেওয়া হয়। এছাড়াও নানা ছাড় ও অন্যান্য বিভিন্ন সুযোগ সুবিধাও পাওয়া যেতে পারে। এই সবগুলিই আপনার ব্যবসার অর্থের প্রয়োজন মেটাতে সাহায্য করবে।
ক্রেডিট হিস্টরি
ঋণ পাওয়ার জন্য ক্রেডিট হিস্টরি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিজনেস্ ক্রেডিট কার্ড নিয়ে যথা সময়ে কার্ডের বিলের টাকা মিটিয়ে দিয়ে আপনি আপনার ক্রেডিট হিস্ট্রি উন্নত করতে পারেন।
বিনা সুদে ঋণ
ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে ঋণ নিলে এবং মাসের শেষে সময়মতো সেই টাকা মিটিয়ে দিলে এই ঋণের ওপর কোনও সুদ আপনাকে দিতে হয় না। আপনি যতটাকা ক্রেডিট কার্ডে খরচ করেছেন সেই টাকাটাই আপনাকে দিতে হবে।
আবেদন করা ও পাওয়া সহজ
ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোনের তুলনায় বিজনেস্ ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার পদ্ধতি সহজ। ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোন পেতে ট্যাক্স রিটার্নের নথি, কোম্পানির ফিনান্সিয়াল স্টেটমেন্ট, ঋণ নেওয়ার কারণ ও পরিকল্পনা ইত্যাদি যাবতীয় তথ্য ও ডকুমেন্ট জমা দিতে হয়। ক্রেডিট কার্ডের ক্ষেত্রে সাধারণতঃ এত ঝক্কি থাকে না। ক্রেডিট কার্ডের জন্য আবেদন করা ও তা পাওয়া ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য প্রায়শই অনেকটাই সহজ হয়।
বিজনেস ক্রেডিট কার্ডের অসুবিধা
ক্রেডিট কার্ড ব্যালান্স যদি খুব বেশি থাকে তাহলে তা ক্রেডিট স্কোরকে অনেকটাই কমিয়ে দিতে পারে। আর ক্রেডিট স্কোর কম হলে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোন পাওয়া সমস্যার হবে। অল্প সময়ের জন্য বেশি ক্রেডিট ব্যালান্স তুলনায় নিরাপদ।
অ্যানুয়াল পার্সেন্টেজ রেট
ক্রেডিট কার্ড হল আনসিকিওকড্ লোন অর্থাত্ এই ঋণে কোনও সিকিউরিটি দিতে হয় না ফলে ক্রেডিট কার্ডের অ্যানুয়াল পার্সেন্টেজ রেট অন্যান্য সিকিওরড লোনের থেকে বেশি।
বিভিন্ন ধরনের অতিরিক্ত দেয়
ক্রেডিট কার্ডের জন্য বার্ষিক একটি টাকা দিতে হয়, দিতে হয় দেরিতে টাকা মেটানোর জন্য অতিরিক্ত টাকা। অগ্রিম নগদ নিলেও আলাদা টাকা দিতে হতে পারে। এই শর্তগুলো অনেক সময়েই গ্রাহকের কাছে পরিষ্কার থাকে না। ফলে গ্রাহককে বিপদে পড়তে হতে পারে। তাই আপনি যদি বিজনেস ক্রেডিট কার্ড নেবেন বলে মনস্থির করেন তবে এই শর্তগুলো অবশ্যই ভাল করে জেনে নেবেন।
ক্রেডিট কার্ডের একটি বড় সমস্যা হল প্রতি ৩০ দিনের বিলিং সাইকেলের শেষে বিলের টাকা মেটাতে হবে। নাহলে দিতে হবে মোটা সুদ। ব্যবসার ক্ষেত্রে অনেক সময়েই ৩০ দিনের মাথায় টাকা মেটানো মুশকিল হতে পারে। ব্যবসার ধরন ও প্রয়োজনের ওপরই নির্ভর করছে মাসের শেষে টাকা মেটানো সম্ভব কি না।
ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোন ও বিজনেস ক্রেডিট কার্ড দুটির কার্যকারিতা আলাদা, দুটি পৃথক ধরনের প্রয়োজন মেটাতে তৈরি হয়েছে। চটজলদি স্বল্প সময়ের জন্য টাকা প্রয়োজন হলে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে পারেন, কিন্তু উত্পাদন বৃদ্ধি বা ব্যবসার প্রসারের ক্ষেত্রে সাধারণত ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোনই বেশি উপযোগী।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct