এহসানুল হক, বসিরহাট: হেমন্তের শেষে শীতের ঠান্ডা পরশের মাঝেই খেজুর গাছের রসে নিজেকে ডুবিয়ে নেওয়ার সুযোগ কমে যাচ্ছে গ্রাম বাংলায়। রসবোধ কমে যাচ্ছে বাঙালির! শীত পড়তেই খেজুর রসের স্বাদ নিতে আগে শহরের মানুষ ছুটে যেত গ্রাম বাংলায়। এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। দিনকে দিন রস দেওয়া সেই খেজুর গাছ কমে গেছে।
বসিরহাটের গ্রাম অঞ্চল ও আশেপাশের এলাকা গুলিতে শীতের মরসুমে সকালে এক দশক পূর্বেও চোখে পড়ত রসের হাড়ি ও খেজুর গাছ কাটার সরঞ্জামসহ শিউলিদের ব্যস্ততার দৃশ্য। সাত সকালে খেজুরের রস নিয়ে তাঁরা বাড়ি বাড়ি হাকডাক দিতেন। শীত পড়তেই বাড়ি বাড়ি চলত খেজুরের রস কিংবা রসের পাটালি গুড় দিয়ে মজাদার পিঠাপুলির আয়োজন। আর খেজুরের রস দিয়ে তৈরি বসিরহাটের গুড়ের নাম রয়েছে দেশব্যাপী। তবে গ্রামবাংলার এ দৃশ্য এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। এর প্রধান কারণ হল বিভিন্ন কারণে খেজুর গাছ নিধন। এতে করে দিনে দিনে বসিরহাটের বিভিন্ন এলাকায় কমছে খেজুরের গাছের সংখ্যা । অমিল হয়ে উঠেছে খেজুরের রসও।
এদিকে, শীত পড়তেই বসিরহাটের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে খেজুর গাছে রস আহরণের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে শিউলিরা। কিছুদিন পরই গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের প্রতীক খেজুর গাছ ঘিরে গ্রামীণ জনপদে শুরু হবে উৎসবমুখী পরিবেশ। তুলনামূলকভাবে বসিরহাটের বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে খেজুর গাছ অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। গ্রামের মাঠে আর মেঠোপথের ধারে কিছু গাছ দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। গ্রামবাংলার ঐতিহ্য এই খেজুর গাছের অস্তিত্ব আজ সঙ্কটে। যে হারে খেজুর গাছ নিধন হচ্ছে, সে তুলনায় রোপণ করা হয় না। রসনা তৃপ্তির উপকরণ সুমিষ্ট রসের জন্যই নয়, জীবনের প্রয়োজনে প্রকৃতির ভারসাম্য ও বাংলার ঐতিহ্য রক্ষায় ব্যাপকভাবে খেজুরগাছ রোপণ করা দরকার এমন দাবি অনেকের। সকালে খেজুরের তাজা রস যে কতটা তৃপ্তিকর তা বলে শেষ করা যাবে না। আর খেজুর রসের পিঠা এবং পায়েস তো খুবই মজাদার। এ কারণে মরসুমের শুরুতেই গ্রামাঞ্চলে রসের ক্ষীর, পায়েস ও পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। শুধু খেজুরের রসই নয়, এর থেকে তৈরি হয় গুড় ও প্রাকৃতিক ভিনেগার। রস আর গুড় ছাড়া আমাদের শীতকালীন উৎসব ভাবাই যায় না। বসিরহাটের ঘোনা গ্রামের কালাম মোল্লা বলেন, কাঁচা রসের পায়েস খাওয়ার কথা এখনও ভুলতে পারি না। আমাদের নাতি-নাতনিরা তো আর সেই দুধচিতই, পুলি-পায়েস খেতে পায় না। তবুও ছিটেফোঁটা তাদেরও কিছু দিতে হয়। তাই যে কয়টি খেজুর গাছ আছে তা থেকেই রস, গুড়, পিঠাপুলির আয়োজন করা হয়।
বসিরহাটের রামনগর এলাকার হাবিবুল্লাহ গাজী জানান, গাছের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। এক সময়ে বসিরহাটের বিভিন্ন এলাকা যেমন ঘোনা, গাছা আকার পুর, পিফা, তেতুলতলা খেজুর রসের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। এখন গাছ যেমন কমে গেছে, তেমনি কমে গেছে শিউলির সংখ্যাও। ফলে প্রকৃতিগত সুস্বাদু সে রস এখন আর তেমন নেই। তবুও কয়েকটা গাছের পরিচর্যা করে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। যে কয়েকটা গাছ রয়েছে তাতে যা পাওয়া যায় তা স্বজনদের নিয়ে রস আস্বাদন করি। শিউলি আদল মোল্লা জানান, খেজুর গাছ কমে যাওয়ায় আমাদের চাহিদাও কমে গেছে। আগে এই কাজ করে ভালোভাবেই সংসার চালাতাম। এমনকি আগে যে রোজগার হত তাতে সঞ্চয়ও থাকত। যে কয়েকটা খেজুর গাছ আছে তা বুড়ো হয়ে যাওয়ায় রস তেমন পাওয়া যায় না। রস বাজারে বিক্রির মতো আগের সেই অবস্থা নেই। তবুও তারা খেজুর গাছ এখনো রক্ষা করে চলেছেন। এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে জানা গেছে, ইট ভাঁটায় ব্যাপকভাবে খেজুর গাছ ব্যবহার করায় এ গাছ কমে গেছে। খেজুর গাছ কম হওয়ায় ইটের ভাঁটায় এই গাছই বেশি পোড়ানো হয়। এছাড়া অনেক সময় ঘরবাড়ি নির্মাণ করার জন্য খেজুরের গাছ কেটে ফেলা হয়। ফলে দিন দিন খেজুরের গাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct