ফৈয়াজ আহমেদ: মুসলিম সভ্যতার অন্যতম প্রধান নিদর্শন হলো মসজিদ। স্থানীয় মুসল্লিদের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সক্ষমতা এবং ঐতিহাসিক পরম্পরার ভিন্নতার কারণে মসজিদসমূহের নির্মাণ-শৈলীতে নানা রকমফের দেখা যায়। সম্ভবত এর একটি উত্তম নিদর্শন হলো আফ্রিকার দেশ মালির ডিজেনি শহরে অবস্থিত ঐতিহাসিক মসজিদ ‘দ্য গ্রেট মস্ক অব ডিজেনি। যা আমাদের এশিয়া বা আরব অঞ্চলের মসজিদের গঠন প্রণালী থেকে অনেকটাই ভিন্ন।
ডিজেনি মসজিদের নির্মাণপদ্ধতি এখন পর্যন্ত আধুনিক প্রযুক্তি’মুক্ত’! মাটি, বালি ও জলের সাহায্যে নির্মাণ করা হয়েছে মসজিদটি। অবশ্য দেয়ালের গাঁথুনি শক্ত করতে নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর তাল গাছের কাঠ ব্যবহৃত হয়েছে, স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হয় ‘টোরন’।
মাটি দিয়ে নির্মিত হওয়ায় প্রতি বছরই মসজিদটির কিছু অংশ অথবা পুরো অংশ সংস্কার করতে হয়। সেই হিসেবে সম্ভবত এটিই বিশ্বের একমাত্র প্রাচীন মসজিদ, যা প্রতি বছর পুনর্নির্মাণ করতে হয়। এছাড়া এই মসজিদটিই বিশ্বের সর্ববৃহৎ মাটি ও বালি দ্বারা নির্মিত মসজিদ।
১৯৮৮ সালে এই মসজিদ ও ডিজেনি শহরকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করে ইউনেস্কো। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ সালে ডিজেনি শহরের গোড়াপত্তন ঘটে। সে হিসেবে এটি আফ্রিকান সাব-সাহারান অঞ্চলের অন্যতম প্রাচীন শহর। কিন্তু ১৩ থেকে ১৮ শতকের মধ্যে এর অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয় এবং গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক পথ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
ধারণা করা হয়, ১২ থেকে ১৩ শতকের মধ্যবর্তী কোনো এক সময় এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। কথিত আছে, সুলতান কুনবুরু ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তিনি স্বেচ্ছায় তার নিজস্ব রাজপ্রাসাদ ভেঙে সেখানে এই মসজিদটি নির্মাণ করেন।
পরবর্তীকালে কুনবুরুর উত্তরাধিকারগণ নানা সময়ে এটির সংস্কার করেন এবং নকশায় পরিবর্তন আনেন। তবে বর্তমানে মসজিদটি যে নকশায় বর্তমান আছে, তা ১৯০৭ সালে নির্মাণ করা হয়েছে। মূলত প্রাকৃতিক দুর্যোগে পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ায় মসজিদটির নকশা একাধিকবার পরিবর্তিত হয়েছে।
মসজিদটিতে পৃথকভাবে তিনটি সুউচ্চ মিনার রয়েছে। এছাড়া শতাধিক মিনার সদৃশ ছোট ছোট কাঠামো রয়েছে। মিনারগুলোর মাঝে সারিবদ্ধভাবে তাল গাছের একাধিক খন্ড গেঁথে দেয়া হয়েছে, যার সাথে খ্রিস্টান চার্চের নকশার কিছুটা সাদৃশ্য পাওয়া যায়।
প্রচণ্ড গরমের দিনেও মসজিদটির অভ্যন্তরীণ পরিবেশ অত্যন্ত ঠাণ্ডা থাকে। এর অভ্যন্তরে একসাথে প্রায় ৩ হাজার মানুষ নামাজ আদায় করতে পারে। মসজিদের দেয়াল ও ছাদের ভার বহন করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ৯০টি মজবুত কাঠের কলাম। অভ্যন্তরে আলো, বাতাস প্রবেশ করার জন্য ছাদ ও দেয়ালে রাখা হয়েছে একাধিক জানালা। তবে সমস্যা হয় বর্ষা-মৌসুমে। এ সময় বৃষ্টির পানিতে মসজিদের দেয়াল ও ছাদ আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
এ কারণে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে প্রতি বছরের এপ্রিল মাসে মসজিদটির পুনর্নির্মাণ উৎসব পালিত হয়, যাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘লা ক্রিপিসাজি’ বা ‘পলস্তারা দিবস’। মূলত জুলাই থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত মালিতে ভাড়ি বৃষ্টিবর্ষণ হয়, এর আগেই মসজিদটি সংস্কার করে প্রস্তুত রাখা হয়।
বর্তমানে প্রতিবছর মসজিদের খুব সামান্য অংশই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তারপরেও প্রতি বছর এই সংস্কারকাজ চালু রাখার মূল কারণ হচ্ছে- উৎসবটি উদযাপন করা। কেননা এতে স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রায় সকলে অংশগ্রহণ করে এবং এটি তাদের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য।
উৎসবের আগের রাতেই এলাকাবাসী পুরো শহরকে দারুণভাবে সাজায় এবং তারা আল্লাহর কাছে তাদের পাপকর্মের জন্য ক্ষমা চায়। এরপর তারা ‘লা নুটি’ নামক বিশেষ নৃত্য প্রদর্শন করে এবং রাস্তায় হেঁটে হেঁটে বিভিন্ন শোকগাথা ও ধর্মীয় সঙ্গীত গাইতে থাকে। তারপর সকাল থেকে তারা মসজিদ সংস্কারের কাজে শুরু করেন।
মসজিদের নির্মাণকাজে অংশগ্রহণ করতে পারা ডিজেনি শহরের প্রত্যেক বাসিন্দার জন্য গর্বের ব্যাপার। কেননা এটি একই সাথে তাদের কাছে সৌভাগ্য ও পুণ্যের কাজ। তবে একসাথে সকল মানুষকে এই কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct