এহসানুল হক, বসিরহাট: হাজার বছরের চলে আসা বাঙালিদের কিছু ঐতিহ্যবাহী জিনিস যা আমরা সেই প্রাচীন কাল হতে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে আসছি। এই ঐতিহ্যবাহী জিনিসগুলি হাজার বছরের বাংলার সংস্কৃতির এক একটি উপাদান যা গ্রাম বাংলার গৃহস্থের স্বচ্ছলতা ও সুখ সমৃদ্ধির প্রতীক হিসাবে প্রচলিত ছিল। আধুনিকতার ছোয়ায় সেই প্রাচীন জিনিসগুলি আজ বিলুপ্তির পথে। তার মধ্যে অন্যতম "ঢেঁকি"।
ঢেঁকি নিয়ে এখন কোনও কবিতা বা ছড়া এখনকার শিশুদের পাঠ্য বইয়ে আর দেখা যায় না। এই ঢেঁকি নিয়ে সে সময় অনেক জনপ্রিয় গান, কবিতা, ছড়া ও প্রবাদবাক্য রচিত হয়েছিল। যেমন ‘ধান ভাঙ্গিরে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া, ঢেঁকি নাচে আমি নাচি হেলিয়া- দুলিয়া ও ধান ভাঙ্গিরে’। এই গানটি এক সময় গ্রাম বাংলার মহিলাদের মুখে খুবই জনপ্রিয় ছিল। এই ঢেঁকি নিয়ে এখনও অনেকেই বলে থাকেন, ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য এই ঢেঁকিকে নিয়ে কবিতা, ছড়া, গান ও প্রবাদ বাক্য প্রচলিত থাকলেও ঐতিহ্যবাহী সেই ঢেঁকি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে।
গ্রাম-বাংলার ঘরে ঘরে এক সময় ঢেঁকিতে ধান ভানা, চিড়া কুটা আর আটা কুটার দৃশ্য সবসময়ই চোখে পড়ত। এক সময়ে গ্রাম বাংলার বহুল ব্যবহৃত এই উপকরণটি আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। কালের বিবর্তনে যান্ত্রিক আবির্ভাবের কারণে ঢেঁকি আজ প্রায় বিলুপ্ত অবস্থায়। এখন আর গ্রাম বাংলায় ঢেঁকিতে ধান ভানার দৃশ্য চোখেই পড়ে না। শোনা যায় না ঢেঁকির ধুপধাপ শব্দ। শহরে তো বটেই, আজকাল গ্রামের ছেলেমেয়েরাও ঢেঁকি শব্দটির কথা জানলেও বাস্তবে দেখেনি। অনেকের কৌতুহল কেমন করে মেশিন ছাড়া ধান থেকে চাল বের করা হত। কেমন করেইবা ঢেঁকিতে চিড়া এবং আটা কুটা হত। ঢেঁকি হচ্ছে কাঠের তৈরি কল বিশেষ। প্রায় ছয় ফুট লম্বা ও নয় ইঞ্চি চওড়া একটি কাঠের কাঠামো থাকে। মেঝে থেকে কয়েক ইঞ্চি উচ্চতায় কাঠের একেবারে সামনে দুই ফুট লম্বা একটি গোল কাঠ থাকে। এটাকে মৌনা বলা হয়। দু’টি বড় কাঠের দণ্ডের ভেতর দিয়ে একটি ছোট হুকড়া হিসেবে কাঠের গোলাকার খিল থাকে। এভাবেই তৈরি ঢেঁকি দিয়ে এক সময় ধান ভাঙ্গানোর কাজ করা হত ব্যাপকভাবে। বসিরহাটের এলাকায় গ্রামগঞ্জে ঢেঁকি আর চোখে দেখা যায় না। এই ঢেঁকি দিয়ে শুধু ধান থেকে চালই নয়, পিঠে-পুলি তৈরির জন্য চালের আটা তৈরি করা হত। এক সময় গ্রামে গ্রামে শীতের মাঝামাঝি সময়ে অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে নতুন ধান ঘরে তোলার পর পৌষ সংক্রান্তিতে ঢেঁকির শব্দে মুখরিত হয়ে উঠতো গ্রামের অধিকাংশ বাড়ি।
গ্রামের সম্ভ্রান্ত বাড়িগুলোতে ঢেঁকিঘর হিসেবে আলাদা ঘর থাকত। সেসময় গ্রামের বিত্তবান পরিবারের ঢেঁকি ছাঁটা পুষ্টিকর চালের কদর ছিল। ঢেঁকি ছাঁটা চালের ভাত ছিল পুষ্টি গুনে ভরা। গৃহস্থ বাড়ির মহিলারা ঢেঁকির মাধ্যমে চাল তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় কাটাতেন। দরিদ্র পরিবারের মহিলারা ঢেঁকিতে শ্রম দিয়ে আয়-রোজগারের পথ বেছে নিতেন। সেই সময় ঢেঁকিতে কাজ করাই ছিল দরিদ্র পরিবারের মহিলাদের আয়ের প্রধান উৎস।বসিরহাটের এলাকায় পিফা গ্রামের এক মহিলা রসিদা বিবি বলেন, "আমার বয়স আশি ছুঁই ছুঁই। আমি যখন ছোট ছিলাম, মায়ের সঙ্গে আটা কুটতে যেতাম, এখন সেই ঢেঁকি চোখে পড়ে না। আমরা ঢেঁকিতে পাক দিয়ে কত টাকা আয় করেছি।'' বিবর্তনে আধুনিক যুগে সেই ঢেঁকির জায়গা দখল করে নিয়ে বিদ্যুৎ চালিত মেশিন ধান ভাঙ্গার চাল কল। এর মাধ্যমে মানুষ এখন অতি সহজেই অল্প সময়ে ধান থেকে চাল পাচ্ছে। গ্রামে গ্রামে বসছে চাল তৈরির কল। মেশিনে আটা কুটা, চিড়া তৈরি করার কাজ চলছে সর্বত্র। হাতের কাছে বিভিন্ন যন্ত্র আর প্রযুক্তি সহজলভ্য হওয়ায় ঢেঁকির মতো ঐতিহ্যবাহী অনেক কিছুই এখন হারিয়ে যাচ্ছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct