কাঞ্চন বসু : সরকারি উন্নয়নের পরিকল্পনার নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স সরকার ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতে নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলির (সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন বা সংক্ষেপে সি.এস.ও) বিরুদ্ধে একটা কথা শোনা যাচ্ছে - ‘হয় তুমি আমাদের উন্নয়নের মডেল এর সঙ্গে সহমত, নয় তুমি দেশদ্রোহী’। বিভিন্ন সি.এস.ও -র তোলা উদ্বেগজনক সমস্যা গলি আলোচনা না করে, তার পরিবর্তে নরেন্দ্র মোদির সরকার যেভাবে বিভিন্ন সি.এস.ও -র পিছনে লেগে রয়েছে সেই প্রেক্ষিতে ‘দেশদ্রোহিতা’র সংজ্ঞা কি এবং কাকেই বা বলে ‘জাতীয় স্বার্থ’ তা নিয়ে জনপরিসরে এবং তাত্ত্বিক স্তরেও আলোচনা হওয়া উচিত ।
২০১৪ সালে আইবি রিপোর্টে কিছু সিএসও -র নাম ভারতের পয়লা নম্বরের শত্রুদের তালিকায় ওঠার পর থেকেই এই কাণ্ডের শুরু। এরপর নরেন্দ্র মোদি সরকার রীতিমত ভয় দেখিয়ে ‘ভিন্নমত পোষণের অধিকারের’ পরিসরটিকে সংকুচিত করেছে। সেই আইবি রিপোর্ট এবং তার প্রতি সংবাদমাধ্যমের একাংশের নিঃশর্ত সমর্থন সিএসগুলিকে ভীষণ রকমের ভীত আর উদ্ভিগ্ন করে তুলেছিল। সেই সংবাদমাধ্যমই আবার পরে ‘সেন্সরশিপের’ বিপদ নিয়ে বড় বড় কথা বলেছে।
এই অধ্যায়ের শুরু হয়েছিল ইউপিএ সরকারের শেষের দিকে সময় থেকেই। সেই সময় ইউপিএ সরকারের বিশেষ নজরদারি ছিল পরমাণুকেন্দ্র বিরোধী এবং পসকো বিরোধী আন্দোলনের প্রতি। কেন্দ্রীয় সরকারের এমন ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠার কারণ ইউপিএ আমলে কোনও কোনও পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র আর প্রকল্পের বিরুদ্ধে সেখানকার নাগরিকদের ব্যাপক আন্দোলনের দুটি ছবি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনের ফলে প্রকল্প রূপায়নের কাজ অত্যন্ত শ্লথ গতিতে চলছিল। ফলে ফিরে যাচ্ছিলেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা।
ইউপিএ সরকারের মতো একই কারণে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকারও এই ধরনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যে সিএসও গুলি কয়লা পরমাণু জলবিদ্যুৎ ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রকল্পগুলি নিয়ে শিক্ষিত জনমত তৈরি করছে, বিতর্ক তৈরি করছে, সেগুলির রূপায়ণ বিলম্বিত করছে, এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে বন্ধ করে দিচ্ছে যেসব প্রকল্প থেকে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন সরকার ফায়দা তুলতে পারে। এই সবগুলি সেইসব প্রকল্পের কাজে বাধা সৃষ্টি করছে এবং সেগুলি আইনের এবং দেশের সংবিধানের স্বীকৃত অধিকার মেনে চলা সত্বেও একের পর এক কেন্দ্রীয় সরকার তাদের দেশদ্রোহী খেতাবে ভূষিত করছে।
অথচ, ভারতীয় সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে, অরণ্য ও অরণ্য প্রাণী পরিবেশের সুরক্ষা এবং উন্নতি করা প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক কর্তব্য। এইসব সিএসওর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিদেশি অর্থের যে দোহাই দেওয়া হচ্ছে, তা আদতে ভিত্তিহীন।
সত্যিই কি সিএসও গুলিতে আসা বিদেশি অনুদানের ফলে ভারতের জাতীয় স্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে? এরকম বালখিল্য অভিযোগ ভারতীয়রা আর কতদিন সহ্য করবেন?
যারা সি এস গুলির বিদেশি অনুদান বন্ধ করে দেওয়ার পরামর্শ বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারকে দিচ্ছেন তারা ভুল করছেন। মনে রাখতে হবে ভারতের বিভিন্ন প্রকল্পের ফলে অবশ্যম্ভাবী উচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী উচ্ছেদ এবং পরিবেশের ক্ষতি বিরুদ্ধে আন্দোলন গুলির অনেকগুলো স্বনির্ভর এবং স্থানীয় মানুষের মধ্যে থেকেই তৈরি হয়। ভারতে অনেক সংগঠন ও ব্যক্তি আছেন যারা নিয়মিত বিদেশ থেকে টাকা পাচ্ছেন। দেশের যাবতীয় উন্নয়নকে বন্ধ করে দিতে দেশবিরোধী এইসব ব্যক্তি ও সংস্থার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
এনজিও বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মূলত সেই সব ব্যক্তি এবং সংগঠনের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলা হচ্ছে, যারা দীর্ঘ সময় ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে আমাদের দেশের জল জঙ্গল জমিকে নতুন প্রদান করে উপনিবেশ বিরোধী দলের নিয়ে গণ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
এদেশে এনজিওগুলোতে বিদেশি লগ্নির কথা বলা শুধু হাস্যকর নয় একেবারে রাজনৈতিক অভিসন্ধি মূলক।
বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের এইসব গণ আন্দোলন দমনের জন্য বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করা ছাড়া অন্য কোন পথ নেই। উদ্দেশ্য যদি যথার্থ হতো তাহলে গণসংগ্রামের সহায়ক ব্যক্তি এবং সংগঠনের কথা উঠে আসতো না গোয়েন্দা রিপোর্টে। তাই, রাজনৈতিক অভিসন্ধি কিছুদিন বিরতি দিয়ে মুখ বন্ধ রাখতে পারে চিরদিন নয়। পশ্চিমা দুনিয়ার সামনে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-র আহ্বান করলেও তা ব্যর্থ হবে। তাই বিরোধীদের কণ্ঠরোধ না করে তা সহ্য করার সাহস বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের সরকারে থাকা উচিত।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct