লিটন রাকিব: আধুনিক পৃথিবী আলোর নিচে থাকা অন্ধকারের মতোই যে কয়েকটি সামাজিক কলঙ্ক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার মধ্যে অন্যতম প্রতিবন্ধীদের সমস্যা। মুক,বধির, পঙ্গু, দৃষ্টিশক্তিহীন, মানসিক ভারসাম্যহীন,জড়বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ- যারা সম্পূর্ণভাবে শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক থেকে বিকাশ লাভ করতে পারেনা তারাই প্রতিবন্ধী হিসেবে চিহ্নিত। মানুষের উন্নতির সোনালী পৃথিবীর আড়ালে সে এক অন্য পৃথিবীর গল্প।
রাষ্ট্রপুঞ্জের সামগ্রিক সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী সমগ্র বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৫% কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধকতার শিকার। ওয়ার্ল্ড ভিশনের বিবরণ অনুযায়ী, প্রতিবন্ধী শিশুরা যাতে ন্যূনতম প্রাথমিক শিক্ষা টুকু পায় তা সুনিশ্চিত করার কথা ছিল কিন্তু নানা প্রতিকূলতার মাঝে আজও তা অধরা। সারা পৃথিবীব্যাপী এই প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা ব্যবস্থা বিশৃঙ্খলিত ও বহিষ্কৃত এবং ভারতের ক্ষেত্রে তা আরো ভয়াবহ। ২০১১সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা গেছে তপশিলি জাতি উপজাতি ছাত্র-ছাত্রীদের তুলনায় প্রায় পাঁচ গুণ বেশি। প্রতিবন্ধী শিশুদের বের করে দেয়া হয়েছে-এ ঘটনা শুধুমাত্র শিক্ষা ক্ষেত্রে নয় সমাজের সর্বত্রই আজ তারা বৈষম্যের শিকার। গোটা বিশ্ব তথা মানবতার কাছে এই সমস্যা একই সঙ্গে লজ্জার ও চিন্তার!
ভারত হল সেই মুষ্টিমেয় দেশ গুলির মধ্যে অন্যতম যেখানে ৯০ শতাংশ প্রতিবন্ধী শিশু কোনরকম শিক্ষা পায়না অথচ শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী ৬-১৪ বছর বয়সীদের পঠন-পাঠন সুনিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। যার মধ্যে রয়েছে প্রতিবন্ধী শিশুরাও। এদের যারা শিক্ষা দেবেন তাদের বলা হয় স্পেশাল এডুকেটর। রাজ্যে বর্তমানে ২০ লক্ষেরও বেশি প্রতিবন্ধী মানুষ রয়েছেন। প্রতিবন্ধী শিশুর সংখ্যা প্রায় ৩ লক্ষ কিন্তু স্পেশাল এডুকেটর রয়েছেন দুহাজারেরও কম। জদিও ১৫শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে স্পেশাল এডুকেটরের চাহিদা কিন্তু উপযুক্ত স্পেশ্যাল এডুকেটর তৈরির জন্য শিক্ষক শিক্ষণ কলেজের অপ্রতুলতা এবং এদের নিগয়ের অনিহা আরো দশ যোজন দূরে পিছিয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে প্রচলিত নেতিবাচক মনোভাব মানবসমাজকে আরো অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছে। অধিকাংশ ভারতীয় মনে করেন প্রতিবন্ধকতা হলো পূর্বজন্মের কর্মের ফল। ভারতে প্রতিবন্ধকতাকে গত জন্মের পাপ বলে আজও ধরা হয়।
উন্নয়নশীল দেশের প্রতিবন্ধকতার যে চিত্র পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় বেশিরভাগ প্রতীবন্ধী মানুষ এখানে লোকচক্ষুর আড়ালে সারাজীবন থেকে যান। জাতীয় লোকগণনা কমিশন বা বিভিন্ন সরকারি সার্ভে ওয়াক’- এ এদের অন্তর্ভুক্তি তো দূরের কথা, কোনোও উল্লেখই থাকে না।” মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষের পাশে দাঁড়াও” শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এই কথা আজ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। শুধু একটু সহযোগিতার হাত সামাজিক বিচ্ছিন্নতাকে দূরে সরিয়ে তাদের সুরক্ষা প্রদান করবে। সর্বোপরি তাদের প্রতিভা বিকশিত হবে।
বর্তমানে প্রতিবন্ধকতা যুক্ত ব্যক্তি আমাদের সমাজের অংশ তারা আর সমাজের বোঝা নয়। তারাও সমাজের রুপকার হিসেবে এবং মানব সম্পদ রূপে পরিগণিত হয়েছে নানা প্রতিকূলতার মাঝেও। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় স্টিফেন হকিন্স -এর কথা যিনি অনন্তকাল ধরে প্রতিবন্ধীদের বাঁচার শক্তি হিসেবে অনুপ্রেরনা যোগাবেন, তিনি গেহরিক নামে এক বিরল রোগে আক্রান্ত মাংসপেশীর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পুরো শরীরে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। কম্পিউটারের মাধ্যমে কন্ঠ অক্ষমতার নিকট মাথা নত করেননি। মাসাদুর রহমান বৈদ্য মাত্র দশ বছর বয়সে ট্রেন দুর্ঘটনায় দুটো পা হারিয়ে ফেলে। ১৯৯৭সালে বিশ্বকে অবাক করে তিনি ইংলিশ চ্যানেল পার হন। অদম্য জেদ আর নিষ্ঠা এবং হার না মানা মানসিকতাই তাঁকে অনেক দূরে পৌঁছে দেয়। রবীন্দ্র জৈন দৃষ্টিশক্তিহীন হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয় সংগীতে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। মাত্র একটি পায়ে খেলে গিরিশ শর্মা ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। সেরিব্রাল পালসি তে আক্রান্ত জিজা ঘোষ বা আর জে ডেন খ্যত সাম্যদেব মুখার্জির কথা আজ আর আমাদের কারো অজানা নয়। জিজা ঘোষের উপর নির্মিত চলচ্চিত্র ‘আই এম জিজা’ ২০১৬ সালে ভারত সরকার প্রদত্ত ন্যাশনাল ফিল্ম এওয়ার্ড পায়। প্রতিবন্ধী মানে তো আর প্রতিভা বন্দি নয়!
যেকোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে চাই সহযোগিতার হাত এই কাজে সহযোগিতা যেমন প্রয়োজন, ঠিক তেমনি সমাজ ও আমাদের সরকারের মনোভাব ও দৃষ্টি আকর্ষণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। যাতে তারা সমাজের মূল স্রোতে ফিরে আসতে পারে।
প্রতিবন্ধী সমস্যা একটি সামাজিক ব্যাধি। একে সম্পূর্ণ নির্মূল করতে সমাজের সকল স্তরের মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। যাতে -”আজ বিবর্ণ, ঝুঁকে পড়া অন্ধকার নেমে আসা কিছু মুখে দেখা দেবে সূর্যোদয়ের হাসি।” অন্ধকার ভেদ করে আসুক নতুন নতুন আলো আর সেই নতুন আলোর দিশায় উদ্ভাসিত হোক পৃথিবী। আজ বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসে আসুন সবাই শপথ নিই যেন হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিবন্ধীদের অধিকার আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী ও সচেতন করে তুলে তাদের যোগ্য সম্মান টুকু ফিরিয়ে দিতে পারি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct