ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নেতা আবুল কালাম আজাদ। মহাজ্ঞানী এবং অগণন মানুষের নেতা তিনি। তাই ‘মাওলানা’। পুরো নাম আবুল কালাম মহিউদ্দিন আহমদ। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় তাঁর জন্ম। পিতা মাওলানা খায়রুদ্দিন। পুরো পরিবার সমেত ১৮৯০-তে মক্কা থেকে কলকাতায় বসবাসের অভিপ্রায়ে চলে আসেন। ১৯১৬ সালে ‘ভারত প্রতিরক্ষা আইন’ বলে আজাদকে কলকাতা ছাড়তে বাধ্য করে। বরেণ্য এই দেশনায়ককে নিয়ে সন্দর্ভমূলক নিবন্ধটি লিখেছেন বিশিষ্ট ঐতিহাসিক খাজিম আহমেদ।
ভূমিকা
ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নেতা আবুল কালাম আজাদ। মহাজ্ঞানী এবং অগণন মানুষের নেতা তিনি। তাই ‘মাওলানা’। ধর্মীয় নেতা হিসেবে তিনি ‘মাওলানা’ অভিধায় ভূষিত হন- এটা মনে রাখা দরকার। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ১০,০০০ ‘উলামা’ (ধর্মবেত্তা) তাঁকে ‘আমিরুল হিন্দ’ বা ‘ইমামুল হিন্দ’ (ভারতের নেতা) হিসেবে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন। বিস্ময়ের কথা উক্ত সালেই তাঁকে অন্তত একবার ‘কায়েদ-ই-আযম’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। পরবর্তীতে এই শব্দবন্ধ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র নামে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে।
পরিচয়
পুরো নাম আবুল কালাম মহিউদ্দিন আহমদ। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় তাঁর জন্ম। পিতা মাওলানা খায়রুদ্দিন। পণ্ডিত-প্রবর এবং সুফি-সাধক। পুরো পরিবার সমেত ১৮৯০-তে মক্কা থেকে কলকাতায় বসবাসের অভিপ্রায়ে চলে আসেন। আজাদ সম্পর্কে সরোজিনী নাইডু একটি উক্তি করেছিলেন, ‘হি ওয়াজ ফিফটি দ্য ডে হি ওয়াজ বর্ন।’ শৈশব থেকেই কবিতা আর প্রবন্ধ চর্চায় তাঁর সবিশেষ আগ্রহ লক্ষ্যযোগ্য হয়ে ওঠে। পত্রিকা-প্রকাশ ও সম্পাদনা তাঁর বৌদ্ধিক চর্চার বিষয় ছিল। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে ‘তাজকিরা’ নামক একটি জীবনদর্শন ভিত্তিক গ্রন্থ প্রকাশ করেন। ১৬ বছর বয়স থেকেই ‘felt free of all conventionalities’, ‘আজাদ’-মুক্ত। এর আগেই তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। ১১ বছর তখন তাঁর বয়স। এর দশবছর বাদে পিতার মৃত্যু হল। ১৩ বছর বয়সেই জুলেইখা নামীয় সম্ভান্ত পরিবারের এক কিশোরীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। তামাম জীবনে তাঁর স্ত্রীকে সময় দিয়েছেন বিস্ময়করভাবে খুবই কম। ১৯০৮ সালে তাঁর একমাত্র সন্তান ‘হাসিন’ (Hand Some) চার বছর বয়সেই মারা গেলে আবুল কালাম কিয়ৎকালের জন্য কিঞ্চিৎ বিমর্ষ হয়ে পড়েন। এমনতরো সময়ে কলকাতা ছেড়ে পরিভ্রমণে চলে গেলেন ইজিপ্ট, সিরিয়া এবং তুরস্কে।
১৯০৬ সাল। অর্থাৎ তাঁর ১৮ বছর বয়স। ঢাকায় ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হল। তিনি এই সভায় যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু লীগের মতাদর্শ তাঁর পছন্দ হল না। ব্রিটিশ রাজের প্রতি লীগের আনুগত্য তাঁকে হতাশ করল। তিনি বাংলার একটি বৈপ্লবিক গুপ্ত সমিতিতে যোগ দিলেন।
শিক্ষা
ইসলামী প্রথাগত শিক্ষার সঙ্গে আধুনিক শিক্ষার প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল। দর্শন, জ্যামিতি, অংক, বীজগণিত পড়েছিলেন আরবি ভাষার মাধ্যমে। ইতিহাস আর দর্শন ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। ভাষার প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল ব্যাপক। আরবি, ফারসি, উর্দু ভাষায় তাঁর ব্যুৎপত্তি আর পাণ্ডিত্য ছিল অনিঃশেষ। প্যারিচরণ সরকারের ‘First Book’ তিনি পুরো মুখস্ত বলতে পারতেন। ইংরেজি ভাষার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত।
সশস্ত্র বিপ্লববাদে আগ্রহ
অরবিন্দ ঘোষ বরোদা ছেড়ে কলকাতায় এলেন। ‘কর্মযোগিন’ পত্রিকা সম্পাদনার মধ্যে দিয়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন। অরবিন্দের সঙ্গে আজাদের দুবার দেখা হয়েছিল। এর ফলে আবুল কালাম বৈপ্লবিক আন্দোলনে আগ্রহী হয়ে পড়েন। ‘দ্য সারভেন্ট’ পত্রিকার সম্পাদক শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী আজাদকে ব্যক্তিগতভাবে স্নেহ করতেন। তিনি আজাদকে বিপ্লবীদের সঙ্গে পরিচয় করে দেন। আগেই বলেছি তিনি ‘গুপ্ত সমিতি’তে যোগ দেন। প্রথমে তাঁকে অনেকে বিশ্বাস করতেন না। পরবর্তীতে বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠেন। উত্তরপ্রদেশ এবং ‘বোম্বেতে’ গুপ্ত সমিতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান স্বীকার্য।
মাওলানা আজাদ মিউজিয়াম। ৫, আশরাফ আলি লেন, কলকাতা-৭০০০১৯।
সাংবাদিকতা, সম্পাদনা
১৯১২ সালের ১৩ জুলাই তাঁর সম্পাদনায় উর্দু ভাষায় প্রকাশিত হল ‘আল-হিলাল’ নামক অসাধারণ একটি পত্রিকা। উইল ফ্রেড কান্টওয়েল স্মিথ তাঁর ‘মর্ডান ইসলাম ইন ইন্ডিয়া’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, পত্রিকাটি ছিল ‘amazingly forceful’. এই পত্রিকার মাধ্যমে আবুল কালাম আজাদেরনাম তাবৎ হিন্দুস্তান-এ ছড়িয়ে পড়ল। পত্রিকাটি ভারতের মুসলমানদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেয় যে আজাদির প্রশ্ন হিন্দুদের সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করা বাঞ্ছনীয়। পত্রিকা প্রকাশের তিন মাসের মধ্যেই বারবার পুনর্মুদ্রণ করতে হয়েছে দু'বছরের মধ্যে ২৬ হাজার কপি পাঠকের কাছে পৌঁছে গেছে।
পত্রিকা বাজেয়াপ্ত
ব্রিটিশ রাজ ‘আল হিলাল’-এর বার্তা পছন্দ করল না। সরকার পত্রিকা বিধিবদ্ধকরণের টাকা ১৯১৪ সালের এপ্রিল মাসে বাজেয়াপ্ত করার নোটিশ পাঠিযে দিল। প্রথমে দু’হাজার, পরে দশ হাজার। ‘আল হিলাল’ বন্ধ হয়ে গেল। ১৯১৬ সালে ‘ভারত প্রতিরক্ষা আইন’ বলে আজাদকে কলকাতা ছাড়তে বাধ্য করল। বিহারের রাঁচিতে অন্তরীণ অবস্থায় ১৯২০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত গৃহবন্দি রইলেন। পরবর্তীতে ‘আল-বালাঘ’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। ছ’মাসের শেষে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী সেই পত্রিকা বন্ধ করে দেয়।
সংগঠক আজাদ
১৯১৩ সালে আবুল কালাম আজাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘Party of God’ বা ‘হিজবুল্লাহ’ নামক একটি দল। ১৯১৪ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেছিলে ‘Dar-ul-Irshad’ (House of guidance), কিন্তু সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। আদতে তাঁর হিন্দু-মুসলিম রাজনৈতিক যৌথ উদ্যোগের বিষয়টি রক্ষণশীল উলেমা শ্রেণি সমর্থন করছিলেন না। বস্তুত দেওবন্দের বিশিষ্ট পণ্ডিত মাওলানা মাহমুদুল হাসানও আজাদকে সমর্থন করেননি।
১৯২১-এ মাওলানা আজাদ চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। হিন্দু মুসলিম মিলনের জন্য শ্রী দাশ যোগ্য ব্যক্তি- এই বিশ্বাস জন্মেছিল আজাদের মনে। ১৯২৫ সালে চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যু তাঁকে হতাশ করে তোলে। ১৯২২ সালে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তাঁকে এক বছরের জন্য কারারুদ্ধ করা হয়।
১৯২৩ সালে জেল থেকে বেরোলেন। তাঁর বয়স তখন প্রায় ৩৫ বছর। এই সময়ে Pro-Changers (দাশ, মতিলাল নেহরু) এবং No Changers (রাজা গোপালচারী, বল্লভভাই প্যাটেল এবং রাজেন্দ্রপ্রসাদ)-এর সংঘর্ষ কংগ্রেস দলকে প্রায় দ্বিধাবিভক্ত করে ফেলে!
কিন্তু মাওলানা আজাদের ‘Ideologue’ দলকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। উভয় পক্ষ তাঁর প্যাঁচহীন মতাদর্শকে বিশ্বাস করতেন। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি কংগ্রেসের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করলেন। এত কম বয়সে কোন রাজনৈতিক নেতা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেননি।
দ্বিতীয় বার সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর জাতীয় কংগ্রেসের ১৯৪০ সালের রামগড় অধিবেশনে ভাষণ দিচ্ছেন মাওলানা আজাদ। রয়েছেন জওহরলাল নেহরু, যমুনালাল বাজাজ, খান আবদুল গফফার খান।
সভাপতি হিসেবে অনবদ্য বক্তব্য
অধিবেশনে সভাপতি হিসেবে তাঁর ভাষণ ছিল অনবদ্য। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অনন্য সাধারণ দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়। বক্তৃতাটি বিশাল। অতি সংক্ষেপে নির্যাসটি তুলে ধরছি:
“বেহেস্ত থেকে দেবদূত নেমে কুতুব মিনারের শিরে দাঁড়িয়ে যদি আমায়ি বলেন, হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের কথা ছাড়ুন, আমি ২৪ ঘন্টার মধ্যে ভারতের স্বরাজের ব্যবস্থা করে দেব, সেক্ষেত্রে আমি পিছিয়ে আসব। আমি বলব, ‘না বন্ধু ওটা হবে না। আমি স্বরাজ ছাড়তে রাজি, কিন্তু হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রশ্নে কোন আপোষ করব না। কেননা স্বরাজ বিলম্বিত হলে তাতে ভারতের ক্ষতি হবে, কিন্তু হিন্দু মুসলিম ঐক্য যদি ভেঙে যায়, তাহলে সেটি হবে “Loss for the whole mankind”.
জীবনের শ্রেষ্ঠতম কাজ
১৯৩০ সালে তাঁর জীবনের সাধনার শ্রেষ্ঠ ফসল, ‘তারজুমান-আল-কুরআন’-এর অনুবাদ শুরু করেন। এটি শুধু আক্ষরিক অনুবাদ নয়। অতুলনীয় বিশ্লেষণ শক্তির পরিচয় রেখেছেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। তাবৎ জাহানে এমন দার্শনিক ব্যাখ্যা খুব বেশি নেই। আমেরিকান ইতিহাসবেত্তা ফ্রিল্যান্ড অ্যাবট তাঁর ‘Islam & Pakistan’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, “The Message of Azad’s Tarjunain was bold”. পুরো তিইশটি (২৩) বছর ব্যয় করেছিলেন এই মহত্তম গ্রন্থের জন্য।
যথার্থ বিশুদ্ধতাবাদী এবং আধুনিক
অনেকে মনে করেন, তিনি আধুনিকতাবাদী ছিলেন না। কিন্তু কথাটি সত্য নয়। তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষা আর আধুনিক বিজ্ঞানের সমর্থক ছিলেন। যৌবনের প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি স্যার সৈয়দ আহমদ খানের অনুসারী ছিলেন। ডব্লিউ.সি.স্মিথ সম্পর্কে বলেছেন, ‘Profound Scholar of Islam’, … ‘liberal in the very sense, … foremost of the Moderns’. এ বাবদে আর বোধ হয় কিছু বলার প্রয়োজন নেই।
হাকিম আজমল খাঁ এবং ড. এম এ আনসারির ইন্তেকালের (১৯৩৬) পর মাওলানা আজাদের সমকালের কোন ইসলামধর্মী নেতা জাতীয় কংগ্রেসে ছিল না। ১৯৩৯-এর শেষে গান্ধিজী আবার আজাদকে কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্বে নিয়ে এলেন। ১৮৫৪টি ভোট তিনি পেলেন, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী এম. এন. রায় পেলেন ১৮৩টি ভোট। ৩৫ বছর বয়সে বয়সে কংগ্রেসের সভাপতির পদে অদৃষ্টপূর্ব যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন। ৫২ বছর বয়সে আবার সভাপতির দায়িত্ব পেলেন। এবারের সময় ছিল ‘জটিল’। হিটলার যুদ্ধ শুরু করেছেন। মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ কংগ্রেসের অগ্রগতিকে রুখে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন। ১৯৪৩-এ বিহারের রামগড়ে প্রখর বাগ্মিতায় ভারতের ঐক্যের বিষয়টি তুলে ধরলেন। তিনি বলেন, “I am proud of being an Indian…. No fantasy or artificial scheming to separate and divide can break this unity” (See, Rajmohan Gandhi, Understanding the Muslim mind. PENGUIN Books, Page 237).
বিধ্বস্ত হয়ে গেল তাঁর স্বপ্ন
এর সাত বছর বাদেই মাওলানা আবুল কালাম আজাদের ঐক্যবদ্ধ ভারতের স্বপ্ন বিধ্বস্ত হয়ে গেল। অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের অন্যতম নেতা খালিকুজ্জামান তীর্যক মন্তব্য করলেন, ‘Pakistan is our destination rather than our choice’. মাওলানা আবুল কালাম আজাদ চেয়েছিলেন হিন্দু আর মুসলমান ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতা অর্জন করুক। হতাশা আর বেদনার কথা এই যে, তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বন্ধুরাই তাঁর সঙ্গে যথার্থ সহযোগিতা করেনি। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল দূর অস্ত্। গান্ধিজী আর নেহরুও কথা রাখেননি। মাওলানা আবুল কালামের স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়।
কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হল এই যে তিনি তাঁর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আল-কুরআনের নির্দেশ এবং হাদিসের বয়ান মোতাবেক নির্মাণ করতেন। নীতি-নৈতিকতার আদর্শে, তিনি অনেক বড় মাপের মানুষ ছিলেন। কিন্তু জাতীয় স্তরের রাজনীতিতে তাঁর গৃহীত মতামত সঠিক মর্যাদা পায়নি।
ব্যক্তি জীবনের ট্র্যাজেডি
তার ব্যক্তি জীবন ছিল গ্রীক ট্র্যাজজেডির নায়েকের মতো। একমাত্র সন্তান ‘হাসিন’-এর মৃত্যু তাঁকে ধ্বস্ত করে দেয়। তাঁর স্ত্রীর সঙ্গেও তিনি ন্যায্য সময় দিতে পারেননি। তার জন্য তিনি আত্মকথায় বেদনা প্রকাশ করেছেন। ‘আজাদি’র প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে অন্যত্র অবস্থানকালে তাঁর স্ত্রী জুলেইখার মৃত্যু হয় ১৯৪৪-এর এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে। বস্তুত তিনি ১৯৪১ সাল থেকেই অসুস্থ ছিলেন। আজাদ ছিলেন তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে প্রায় ১,৫০০ মাইল দূরে এর দু’মাস পরে আজাদ তাঁর অতি আদরের ভগ্নি আবরু বেগমকে হারালেন। আবরু থাকতেন ভূপালে।
ফিরে এলেন শূন্যগৃহে
১৯৪৫-এর এপ্রিল। ৩২ মাস কারারুদ্ধ থাকার পর মুক্তি পেলেন জুন মাসে। এপ্রিল থেকে জুন মাস আহমদনগর দুর্গের পরিবর্তে বাঁকুড়া শহরের একটি বাড়িতে তাঁকে অন্তরীণ করে রাখা হয়। মুক্তির পর তিনি কলকাতার ট্রেন ধরলেন। হাওড়া স্টেশনে তাঁর অনুরাগীদের অভ্যর্থনা তাঁকে বিহ্বল করে তুলল। ‘গুব-এ-খাতির’ নামক গ্রন্থে (অধ্যাপক একরাম ‘মডার্ন মুসলিম ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে বক্তব্য সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, “tour de force of literary craftsman”.) মাওলানা আবুল কালাম আজাদ লিখছেন, তিন বছর আগে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সময় জুলেইখা শুধু বলেছিলেন, ‘খুদা হাফিজ’। অন্য কোন শব্দটি উচ্চারণ করেননি। তাঁর বুকের ভিতরটি দুমড়ে, মুচড়ে যাচ্ছিল। অন্তরীণ বেদনা তাঁকে বেদনার্ত করেছিল, তিনি দরজা জাপটে ধরে আমার চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে ছিলেন। তাঁর চোখে ‘আঁশু’ নেই, কিন্তু মুখমণ্ডলটি ক্রন্দনরত। অন্তত শতবার তাঁকে ছেড়ে গেছি কিন্তু এহেন বেদনার্ত কোন দিন ‘মেহসুস’ (উপলব্ধি) করিনি। এই পরিস্থিতিটি ছিল যেন তাঁর ‘দিল কি জুবান’। যাই হোক গাড়ির চালককে আমার জীবনসঙ্গিনীর কবরস্তানের দিকে নিয়ে যেতে বললাম। ভক্তদের দেওয়া একটি ফুলের মালা সমাধিতে রাখলাম। নিঃশব্দে ‘ফতেহা’ উচ্চারণ করলাম। মনে পড়ল তিনি ‘খুদা হাফিজ’ বলে আমাকে বিদায় জানিয়েছিলেন। আমার গৃহশূন্য হয়ে গেছে। তিনি, ‘খুদ পে খুদ-আলবিদা’ হয়ে গেছেন।
মাওলানা আজাদের অন্তিম যাত্রায় শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন।
শেষের কথা
ভারত নামক সৃষ্টি দেশ স্বাধীন হল। তিনি ভারত সরকারের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী হলেন। অধ্যাপক হুমায়ুন কবিরের শলা পরামর্শে আধুনিক ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামোটিকে তিনি নির্মাণ করলেন। সাংস্কৃতিক উজ্জীবনে তাঁর ভূমিকা ছিল গৌরবময়। সে ভিন্ন কথা, ভিন্ন প্রসঙ্গ।
প্রসঙ্গত বলে রাখি, জহরলাল নেহরু এবং আবুল কালাম আজাদ-এর বন্ধুত্ব ছিল কিংবদন্তীর মতো। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের সঙ্গে নেহরুর মতবিরোধ লেগেই থাকত। মাওলানা আজাদ এর মধ্যস্থতা করতেন। আজাদ বলেন, “Jawaharlal and I have been the best of friends”. কিন্তু এমন ‘দোস্তি’ শেষতক প্রাণবন্ত ছিল না। ১৯৫০ সারের ডিসেম্বরে বল্লভভাই প্যাটেলের মৃত্যুর পর মাওলানা আজাদের প্রভাব এবং গুরুত্ব কমতে থাকে, ভি. কে. কৃষ্ণ মেননের ভূমিকা বাড়তে তাকল। তিনি মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন না। কিন্তু ক্রমে প্রধানমন্ত্রীর ‘de facto principal Adviser’ হিসেবে প্রতিভাত হলেন। মাওলানা বদরুদ্দিন তায়েবজি মন্তব্য করেছেন, জীবনের শেষ পর্যায়ে নেহরু আর আজাদের ‘মোলাকাত’-ও বিরল হয়ে গেছিল। রাজমোহন গান্ধি বেদনার সঙ্গে উচ্চারণ করছেন, মাওলানা আজাদ লেখকের কলমটি ছেড়ে মন্ত্রিত্বের কলম হাতে তুলে নেওয়ায় তাঁর বৌদ্ধিক জীবনের ক্ষতি হয়েছিল। মি. গান্ধি বলছেন, ১৯৪৫ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত একটি মাত্র ‘কিতাব’ রচনা করেছেন- সেটি হচ্ছে, ‘India wins freedom’. ‘It is a loss’ (প্রাগুক্ত, পৃ: ২৫৩)
মূল্যায়ণ
১৯৫৮ সালে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ সম্পর্কে পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু স্পষ্ট উচ্চারণ করেছেন, ‘the encyclopaedist, men of Intellect, men of action’. অধ্যাপক মুজিব-এর অনুভব হল, আজাদের ছিল ‘high position among the great men of the world’. (Indian Muslims, page 441).
মাওলানা আবুল কালাম আজাদের ‘ইন্তেকাল’-এর তারিখ হল, ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৮ সাল। আধুনিক ভারতের রাজনৈতিক নাটকের নিঃসঙ্গ পদাতিকের বয়স তখন ৭০ বছর। তিনি শায়িত দেহলীতে। জুলেইখা রইলেন হাজার মাইল পূর্বে কলকাতায়।
নিঃসঙ্গ পদাতিক মাওলানা আজাদের ‘জার্নি’ শুরু হয়েছিল মক্কায়। পথের শেষ হল দেহলীতে।
সূত্র: ১. আই.এইচ. ডগলাস, এ. কে. আজাদ, বায়োগ্রাফি, দিল্লি, ১৯৮৮।
২. অশীন দাশগুপ্ত, মৌলানা আজাদের বক্তব্য, দেশ, ২৫শে মার্চ, ১৩৮৯।
৩. কাজী আবদুল ওদুদ, মুসলিম জগতে নতুন চিন্তা, দেশ, সাহিত্য সংখ্যা ১৩৬৭।
৪. পুলকনারায়ণ ধর, আবুল কালাম আজাদের চিন্তাধারা, মুসলমান সমাজ ও স্বদেশ, চতুরঙ্গ, জুলাই, ১৯৮৯।
৫. রাজমোহন গান্ধি, আন্ডারস্ট্যান্ডিং দ্য মুসলিম মাইন্ড (অসাধারণ এই কেতাবটি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন ‘কলম’ মাসিক পত্রিকার সম্পাদক পরম প্রিয়ভাজন আহমদ হাসান ইমরান। তারিখটি ছিল ০২.০৩.৮৯। আই. এইচ. ডগলাসের বইটি .মুসলিম রেনেসাঁ সোসাইটি’ (কলকাতা-১৭) আয়োজিত- ‘মাওলানা আযাদের আকাংখিত ভারত: বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক আলোচনাচক্রে বক্তব্য পেশ করার জন্য ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক শ্রদ্ধাভাজন আবদুর রাউফ তাঁর এই অনুজকে ‘গিফট’ দিয়েছিলেন। সেমিনারটি ‘মুসলিম ইনস্টিটিউট’ হল (হাজী মুহাম্মদ মহসীন স্কোয়ার)-এ অনুষ্ঠিত হয়েছিল (১৭.০২.১৯৯০)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct