ডা. প্রকাশ মল্লিক: ইউরেটরে স্টোন সম্বন্ধে আলোচনা করার আগে আমরা জেনে নেব ইউরেটর বলতে কী বোঝায় । কিডনি থেকে ইউরিনারি ব্রাডার বা মুত্রথলি পর্যস্ত ইউরিন নেমে আসার যে সরু রাস্তা বা চ্যানেল সেটাকেই ইউরেটর বলা হয়। কিছু পরিমাণ প্রোটিন ও গ্লাইকো প্রোটিন, ক্যালসিয়াম জাতীয় খনিজ পদার্থের মিশ্রণে স্বচ্ছ দানা বা পাথরের আকৃতি নেয়। যেহেতু মুত্র বেরিয়ে আসার রাস্তাটা খুব সরু তাই কিডনি থেকে ছোট ছোট স্টোন বেরিয়ে যখন ইউরেটরে আসে তখন স্বাভাবিকভাবেই স্টোনগুলোকে বের করে দেবার জন্য শরীর চেষ্টা করে, কারণ স্টোন থাকার কারণে ইউরিনের যে ফ্লৌ বা গতি তা বাধাপ্রাপ্ত হয়।
ইউরেটর স্টোন বিভিন্ন ধরনের হয়। বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল কম্পোজিশন (রাসায়নিক উপাদান) স্টোনগুলোর মধ্যে থাকে। যেমন ক্যালসিয়াম ফসফেট স্টোন, জ্যানথিন স্টোন, ইউরিক আযাসিড স্টোন। এইরকম বিভিন্ন ধরনের স্টোন কিডনিতে হয় এবং সেগুলো ইউরেটরে নেমে আসে। মূত্র প্রথমে কিডনির মাধ্যমে ব্রাডারে এসে জমা হয় ও মুত্রনালি দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। ছোট পাথর সাধারণত প্রস্রাবের সঙ্গেই বেরিয়ে যায়। এর জন্য কোনও যন্ত্রণা অনুভূত হয় না বলে চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু স্টোন যখন একটু বড় হয় তার কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। স্টোন বড় হলে ইউরেটরে খুব ব্যথা অনুভব করেন রোগী । পেটের ডানদিক-বাঁদিক এবং পেছনদিকে ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে। প্রশ্রাবে জ্বালা, তলপেটে ব্যথা-যন্ত্রণা হয়, মূত্র বা প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায় কিংবা ফৌটা ফৌটা নির্গমন, এমন কি মুত্রের সঙ্গে রক্ত দেখা দেয়, বমি হয়। ব্যথা কিডনি অঞ্চলের দিকে অথবা নিচের দিকে জেনিটাল এরিয়া পর্যস্ত নেমে আসতে পারে।
স্টোনের উপরিভাগ যদি মসৃণ হয় তাহলে পাথর অনেক সময় ধীরে ধীরে নীচে নেমে আসে । কিডনি থেকে ইউরেটরের মধ্য দিয়ে মুত্রনালির মধ্যে যখন নেমে আসে তখন ব্যথাটা অনেক কমে যায়। কিন্তু যতক্ষণ ইউরেটরের মধ্যে থাকে ইউরেটর মাসলগুলো সংকুচিত হয় পাথরটাকে ঠেলে নীচে নামিয়ে দেওয়ার জন্য, তখন খুব ব্যথা হয়। এটাকে কলিক পেইন বলে। এই ইউরেটারি কলিক যৌনাঙ্গ পর্যস্ত আসতে পারে। ছেলেদের ক্ষেত্রে অণ্ডকোষের দিকে ব্যথাটা নামতে পারে ।
আগেই উল্লেখ করা হযেছে স্টোনের উপরিভাগ মসৃণ হলে ব্যথা কম হয়। কিন্তু স্টোনের উপরিভাগ মসৃণ না হলে যেমন অক্সালেট স্টোন কাটা কীটা খাজের মতো তখন আটকে যাবার সম্ভাবনা বেশি থাকে এবং ইউরেটর যখন খুব জোরে সংকুচিত হয় তখন রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে। রোগী উপসর্গের মধ্যে কখনও জ্বর, কলিক পেইন এবং প্রস্রাবের সঙ্গে রক্তক্ষরণ নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসেন। প্রস্তাবে ব্যথা অনুভূত হওয়া, জ্বর, বমি এবং প্রস্রাবের সঙ্গে রক্তক্ষরণ হলে দেরি না করে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
বিশেষ করে যাঁদের বাড়িতে ইউরেটরে স্টোন বা কিডনিতে পাথর হয়েছে এমন কেউ থাকেন অর্থাৎ স্টোন সংক্রান্ত কোনও ইতিহাস থাকলে যেমন বাবা-মা-ভাই-বোন কারো যদি স্টোন পূর্বে হয়ে থাকে সেই সমস্ত ক্ষেত্রে বাড়ির কারো ইউরেটরে বা কিডনির স্টোনের সমস্যা দেখা দিলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
যে সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় তার মধ্যে কিডনি, ইউরিন পরীক্ষার মতো রুটিন চেক-আপ, ইউরিন কালচার করা হয়। দেখা হয় কোন ইনফেকশন আছে কি না। এইসব উপসর্গের সাথে জ্বর থাকলে রুটিন চেক-আপের সাথে সাথে এক্স-রে করা হয়। আলল্রাসোনোণ্রাফি করা হয়। আলট্রাসোনোগ্রাফিতে দেখা যায় ইউরেটরের মধ্যে যদি পাথর থাকে তাহলে ইউরিনটা স্বাভাবিকভাবে নীচে নেমে আসতে পারে না তার ফলে কিডনির ওপর চাপ পড়ে, ইউরিন ফর্মেশনের পরে যে রাস্তাটা দিয়ে নেমে আসে, পাথরের সেই অংশটা স্ফীত হয়ে যায়। এর ফলে বোঝা যায় যে জায়গাটা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।
এছাড়া আলট্রাসাউণ্ড বা এক্স রে করার পর যদি দেখা যায় যে পাথর আছে ইউরেটরের মধ্যে, তাহলে রোগীকে ইন্ট্রাভেনাস ইউরোপ্রাফি আই ভি ইউ, যাকে আগে আই বিপি বলা হতো) করা হয়। এখানে একটা কেমিক্যাল পদার্থ ব্যবহার করা হয় যার মধ্যে আয়োডিন আছে। যখন আয়োডিন স্পিরিটেড হয়ে কিডনির মধ্যে দিয়ে ফিল্টার্ড হয়ে ইউরেটরের প্যাসেজের মধ্যে দিয়ে নামে, তখন সাদা একটা ছবি পাওয়া যায়। এখানে যদি কোনও পাথর থাকে তাহলে সাদা জায়াগাটার মধ্যে একটা নেগেটিভ শ্যাডো থাকে অর্থাৎ কালো একটা এরিয়া থাকতে পারে।
রেডিও লুসান স্টোনের ক্ষেত্রে আই ভি ইউ বা আই বি পি খুব গুরুত্বপূর্ণ । আবার কখনও কখনও কোনও কিছুতেই বোঝা যায় না স্টোন, রেডিও লুসান। সব থেকে ভালো বোঝা যাবে সিটি স্ক্যান করে। তবে সিটি স্ক্যানে একটাই অসুবিধে যে এটা খুবই খরচসাপেক্ষ চিকিৎসা । সি টি স্ক্যান করার সময় সি টি ইউরোগ্রাফি করা যায়।
এইসব পরীক্ষার সাহায্যে নিশ্চিত হওয়া যায় যে পাথর আছে। এ ব্যাপারে দেখতে হয় পাথরটা ঠিক কোন এরিয়াতে, কোন পজিশনে, কিডনি থেকে কতটা নীচে, মুত্রনালির কতটা কাছে রয়েছে, তা দেখে চিকিৎসা ব্যবস্থা ঠিক করেন চিকিৎসকেরা।
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা স্টোন চিহিত করণ বা তার অবস্থান জেনে লক্ষণ মিলিয়ে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় সুফল পাওয়া যায়। আমার ৩৭ বছরের চিকিৎসা জীবনে বহু সফলতা পেয়েছি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct