অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় এই রাজ্যের মুসলিমরা েয অনেক পিছিয়ে রয়েছে, তার প্রমাণ মেলে সাচার কমিটির রিপোর্টে। ২০০৬ সালের বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচারের সেই রিপোর্ট চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের আর্থ সামাজিক শুধু নয় শিক্ষায় তাদের কি বেহাল অবস্থা। কিন্তু কেন একটি জাতিসত্তা এত উপেক্ষিত, শিক্ষায় অনগ্রসর, কেন এত দরিদ্র, আর কেনই বা মুসলমান বুদ্ধিজীবী সমাজ স্ব-সম্প্রদায়ের সমস্যাবলির স্বরূপ উদঘাটনে ও নিরসনের দিক নির্দেশ সম্পর্কে আগ্রহী হতে তেমন দেখা যায় না। সম্প্রতি সেই পরিস্থতির গবেষণালব্ধ বিশ্লেষণ “পশ্চিম বাঙলার বাঙালি মুসলমান : অন্তবিহীন সমস্যা” নামক প্রবন্ধগ্রন্থে সন্নিবিষ্ট করেছেন সমাজবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিক খাজিম আহমেদ।
লেখক খুবই সুনিপুণভাবে একটি জাতিসত্তার ইতিহাস, উৎপত্তি-বিকাশ, রাজনৈতিক অবস্থান, সামাজিক প্রেক্ষাপট, সাংস্কৃতিক অধোবিকাশ, ধর্মীয় পরিচয়ের প্রশ্নে উপেক্ষা, ‘মিশ্র সংস্কৃতি’ বা ‘কমপোজিট কালচার’-এর অনিঃশেষ গুরুত্ব, অর্থনৈতিক নিঃসীম দুর্বলতা সর্বোপরি মানবীয় মর্যাদা নিয়ে ‘বেঁচে-বর্তে’ থাকার প্রয়োজনে পরম সাদরে লালিত ধর্মনিরপেক্ষতা কেন প্রয়োজন– ইত্যাকার বিষয় নিয়ে বিস্তৃত চর্চা করেছেন। অগণন প্রবন্ধাদির মধ্যে থেকে ১৭টি রচনা নিয়ে গ্রন্থটি প্রকাশিত। প্রায় অর্ধ-শতকের ওপর তিনি সহৃদয় পাঠকবর্গের সঙ্গে রয়েছেন। সাবেক বাঙালিয়ানা, মিশ্র-সংস্কৃতি আর সমন্বয়ে বিশ্বাসী খাজিম আহমেদ কলকাতা কেন্দ্রিক বিভিন্ন দৈনিক সংবাদপত্র ও সাময়িকীেতে যেসব প্রবন্ধ লিখেছেন তার মধ্যে স্থান পেয়েছে ‘সেকুলারিজমের সওয়াল’ নামে একটি প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “এই দেশীয় মুসলমান সমাজের বেদনা এইখানে যে, স্বধর্মী কোনও ব্যক্তিত্ব তার সমাজের দুর্বলতার দিকটি যুক্তি ও সহানুভূতির সঙ্গে পর্যালোচনা করেননি। ...সাধারণভাবে মুসলিম নেতৃত্ব সস্তায় কেল্লাফতে করার জন্য এমন সব দাবি বা সমস্যার কথা তোলেন, যার ফলে অমুসলমানরা (এমনকি প্রগতিশীল অংশও) মুসলমানদের থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। ... শুধু মুসলমানদের নিয়ে যদি কেউ একটি পৃথক রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলতে চান, তাহলে সুনির্দিষ্টভাবে তা হবে মুসলিম স্বার্থ বিরোধী।... একমাত্র জন্মের সুবাদে মুসলমান নেতারা মুসলমানদের স্বার্থরক্ষা করতে সমর্থ, সাধারণ উপেক্ষিত মুসলমান সমাজ আর কতকাল এই ধরনের প্রচারের শিকার হবেন, তা আমাদের জানা নেই।”
এর ফলে বুঝিযে দিয়েছেন এরাজ্যে মুসলিমদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন দরকার। রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ছাড়া এই জাতিসত্তার তেমন বিকাশ ঘটবে না। সেই দাবি পরোক্ষে তুলে ধরেছেন লেখক।
দেশভাগের বাঙালি মুসলিমরা অনেকটাই অভিভাবকহীন হওয়ায় যেভাবে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে, তার উত্তরণের দাবির প্রয়োজনীয়তা সন্নিবিষ্ট হয়েছে এই গ্রন্থের বিভিন্ন প্রবন্ধে।
অষ্টাদশ শতকে ইউরোপীয়দের দুনিয়াব্যাপী সম্প্রসারণ জনিত ধ্বংসাত্মক নীতিতে বিপর্যস্ত অবস্থা হয়েছিল মুসলমান সমাজের। এ থেকে উত্তরণের পথ ছিল বিজ্ঞান ভিত্তিক প্রগতিশীল ভাবনা, যা পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় মুসলমান দেশগুলি উপলব্ধি করে জ্ঞানচর্চায় মনোনিবেশ করেছিল। এই বাংলার মুসলমান সমাজ প্রথমাবস্থায় আধুনিক জীবনধারায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতে না পেরেই ক্রমে ক্রমে তলানিতে এসে ঠেকে। এই অবস্থায় ইন্ধন জুগিয়েছিল সংখ্যাগুরুদের উন্নাসিকতা আর শাসকগোষ্ঠীর দেশ বিভাজনের সার্থকতা। তার যে প্রভাব এবং রাজনৈতিক – অর্থনৈতিক প্রসারের কালে কেমনভাবে মুসলিম জাতিসত্তা ধুঁকতে ধুঁকতে টিকে গেছে তার সবিস্তার বর্ণনা বিধৃত হয়েছে নানা প্রবন্ধে। তবে এটা বলতে দ্বিধা নেই খুবই সাহসিকতার সঙ্গেই লেখক আর্ত পীড়িত মুসলমান জনগোষ্ঠীর মনের কথা তুলে ধরেছেন খুবই অকপট ভাষায়।
রাজনৈতিক বঞ্চনা প্রসঙ্গে তিনি বাম আমলের মুসলিম নেতৃত্বকে উপেক্ষা করার বিষয়টি চোখে অাঙুল তুলে দেখিয়ে দিয়েছেন। সর্বোপরি লেখক সুনির্দিষ্টভাবে দেখিয়েছেন যে, শুধু শাসক হিসেবেই নয়, রাজনৈতিক নেতৃত্বের গুরুত্ব বিবেচনাতেও সিপিএম বাঙালি মুসলমানদের স্পষ্টভাবে বঞ্চিত করেছে। ঘটনাক্রমে কমিউনিস্ট নেতা মুজফফর আহমেদ এবং সৈয়দ মনসুর হবিবুল্লাহ’র মতো সর্বজন মান্য নেতৃত্বও সিপিএমের পক্ষ থেকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের শিকার হয়েছেন। সেই ট্র্যাডিশন এখন বন্ধ হয়নি তার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও সমালোচনায় বিদ্ধ করতে পিছপা হননি। আলোচনায় তথ্যের প্রাচুর্য আমাদের বিস্মিত করে! আগামী প্রজন্মের কাছে এটি নিশ্চিত দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে। ইতিহাসচর্চা ও সাম্প্রদায়িকতার পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্যানুসন্ধানে খাজিম আহমেদ বিকৃত ইতিহাস চর্চার উৎস নির্ণয় করেছেন। তাঁর মতে, স্বাধীনতা লাভের সাত দশক পরেও দুই যুযুধান সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য তো স্থাপন হয়ইনি, উপরন্ত সন্দেহ আর অবিশ্বাস ক্রমেই বেড়ে চলেছে। পক্ষপাতদুষ্ট ইতিহাসচর্চা স্বাধীনতা সংগ্রামে বিভিন্ন জাতিসত্তার অবদানের প্রকৃত মুল্যায়নে ব্যর্থ হয়েছে। সেই প্রভাব রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রেও ক্রিয়াশীল হয়েছে।
ফলে, ক্ষমতায়নের অভাবে সংখ্যালঘু সমাজের বিকাশও থমকে দাঁড়িয়েছে। এর জন্য লেখক শুধু রাজনৈতিক সংকীর্ণবাদকেই দোষারোপ করেননি, সংখ্যালঘু সমাজের যে সচেতনতার অভাব সেটাও তুলে ধরতে কুণ্ঠা বোধ করেননি। সমাজের যে চাহিদা তা সমানে না এলে তা পূরণ হওয়ার নয়। তাই সেভাবে আন্দোলন দানা না বাঁধার ফলে সংখ্যালঘুদের প্রকৃত সমস্যার কথা অন্দরেই থেকে গেছে। ফলে, মুসলিমদের উত্তরণের পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে বাঙালি মুসলিমদের এ ধরনের অন্তহীন সমস্যার জন্য। তারই অকাট্য দলিল হিসেবে প্রবন্ধ রাজি সম্বলিত গ্রন্থটি যে অমূল্য সম্পদ তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
পশ্চিমবাঙলার বাঙালি মুসলমান : অন্তবিহীন সমস্যা
খাজিম আহমেদ, উদার আকাশ, ঘটকপুকুর, দক্ষিণ ২৪-পরগনা
প্রথম প্রকাশ, অক্টোবর ২০১২
মূল্য ২০০ টাকা
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct