মানুষ জানে তাকে মরতে হবে একদিন। জন্মিলে মরিতে হবে। মৃত্যু অমোঘ হলেও তার কথা ভেবে ভয় হয় মানুষের। যে পৃথিবীতে সে হেসে-খেলে, নেচে-কুঁদে, আবাদ করে-বিবাদ করে কাটাল, সেই পৃথিবীতে সে আর থাকবে না! হারিয়ে যাবে চিরকালের মতো! তাই মানুষ নানাভাবে অমর হবার আয়োজন করে। সন্তানের মধ্যে বেঁচে থাকতে চায়। বেঁচে থাকতে চায় নিজের সৃষ্টির মধ্যে।
মনে পড়ে মধুসূদন দত্তের লেখার কথা। মরীচিকার পেছনে ছোটার জন্য তিনি আত্মবিলাপ করেছিলেন। অন্তত দেশবাসী তাঁকে মনে রাখুন, এই তাঁর আর্তি। সেই ধন্য নরকূলে লোকে যারে নাহি ভুলে। তাঁর আকুল আবেদন, দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করে দেশবাসী তাঁকে মনে রাখুন।
কিন্তু পৃথিবীতে অল্প কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা কোন স্মৃতিচিহ্ন রেখে যেতে চান না। জর্জ বার্নাড শ তাঁর শেষ ইচ্ছায় বলেছিলেন তাঁর মৃত্যুর পরে কোন ধর্মীয় আচার যান পালন না করা হয়, তথাকথিত শেযকৃত্যানুষ্ঠানের কোন দরকার নেই, তাঁর সমাধিক্ষেত্রে যেন কোন প্রতীক না থাকে। চার্লস ডিকেন্সও জানিয়ে রেখেছিলেন তাঁর শোকসভায় যাঁরা আসবেন তাঁদের কালো বস্ত্র, স্কার্ফ পরার কোন দরকার নেই।
প্রবাদপ্রতিম বাঙালি নাট্যকার ও অভিনেতা শম্ভু মিত্রের মৃত্যুর খবর দেশবাসী পায়নি তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী। সিরিটি শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য হয়ে যাবার পরে আমরা তাঁর মৃত্যুর খবর জানতে পেরেছিলাম। মৃত্যুর আগে ইচ্ছাপত্রে শম্ভু মিত্র লিখে রেখে গিয়েছিলেন, ‘মোট কথা আমি সামান্য মানুষ, জীবনের অনেক জিনিস এড়িয়ে চলেছি, তাই মরবার পরেও আমার দেহটা তেমনি নীরবে, একটু ভদ্রতার সঙ্গে, সামান্য বেশে, বেশ একটু নির্লিপ্তির সঙ্গে গিয়ে পুড়ে যেতে পারে।’
সম্প্রতি গায়ক-লেখক-সুরকার কবীর সুমনের ইচ্ছাপত্র প্রকাশ পেল সংবাদপত্রে। বাংলা গানে নতুন দিশা এনেছিলেন এই প্রবাদপ্রতিম গায়ক-সুরকার। মহাকবি ভার্জিল তাঁর অসমাপ্ত ‘ইনিদ’(‘আইনেইদ’?) পুড়িয়ে দেবার কথা বলেছিলেন মৃত্যুর পরে, বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে অসমাপ্ত লেখা পুড়িয়ে দেবার অনুরোধ করেছিলেন ফ্রানজ কাফকা। কিন্ত কবীর সুমন সমাপ্ত-অসমাপ্ত সব রচনাই ধ্বংস করে দেবার কথা বলেছেন।
ইচ্ছাপত্রে তিনি নিজের হাতে লিখেছেন, ‘আমার মৃতদেহ যেন দান করা হয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের
কাজে। কোনও স্মরণসভা, শোকসভা, প্রার্থনাসভা যেন না করা হয়। আমার সমস্ত পাণ্ডুলিপি, গান, রচনা, স্বরলিপি, রেকর্ডিং, হার্ডডিস্ক, পেনড্রাইভ, লেখার খাতা, প্রিন্ট আউট যেন কলকাতা পুরসভার গাড়ি ডেকে তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হয় সেগুলি ধ্বংস করার জন্য।... আমার ব্যবহার করা সব যন্ত্র, বাজনা, সরঞ্জাম যেন ধ্বংস করা হয়।’
তার মানে মৃত্যুর পরে তিনি আর কিছুতেই জীবিত থাকতে চান না। গা্য়ক-সুরকার একজন ব্যক্তিমানুষ। তাঁর স্বাধীন ইচ্ছাকে সম্মান জানানো উত্তরসূরীদের কর্তব্য। কিন্তু সেইসঙ্গে মনে একটা প্রশ্ন জাগে : এই ইচ্ছাকে কার্যকর করলে কী ইতিহাসকে অমর্যাদা করা হবে না ! বাংলা গানের ধারা থেকে কবীর সুমনকে বাদ দিলে সে ইতিহাস কী খণ্ডিত হবে না ? মানবজীবনের ধারার সঙ্গে ব্যক্তিমানুষ তো জড়িত। বিশেষ করে যাঁরা প্রতিভাবান মানুষ, তাঁরা তো সেই ধারাকে নতুন গতিপথে বইয়ে দেন। রবীন্দ্রনাথের কথা, এপার গঙ্গা/ ওপার গঙ্গা/ মধ্যিখানে চর। অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যৎ নিয়েই তো ইতিহাস।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct