সদ্য আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। ফলাফলে দেখা গেল ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সরিয়ে হোয়াইট হাউস দখল করলেন ভারতপতির অপছন্দের মানুষ ডেমোক্র্যাট দলের জো বাইডেন। আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার পিছনে ভারতের পছন্দ অপছন্দ কিংবা চাওয়া না চাওয়ার কোন অবকাশ থাকে না। থাকাটাও অবাঞ্ছিত। কিন্তু এবার বাইডেনের ক্ষেত্রে তেমনটাই হয়েগেছে। জো বাইডেন আমেরিকার রাষ্ট্রপতির চেয়ারে এটা তো ভারতের জন্যে অপছন্দনীয়! ভারতের বললে ভুল হবে ভারতের, সর্বকালের সেরা অদূরদর্শী রাষ্ট্রপ্রধান নরেন্দ্র মোদির অপছন্দ।
সুতরাং আমেরিকায় এই পটপরিবর্তন ভারতের অদুরদর্শী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অত্যন্ত খারাপ তথা অদক্ষ এবং অবিবেচিত পদক্ষেপের ফলে ভারতীয়রা অজানা আশঙ্কায় প্রমাদ গুনছেন। কেন এই আশঙ্কা?
এক বছর আগে আমেরিকার হিউস্টনে ‘হাউডি মোদি’ সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী মোদিজী স্লোগান দিয়েছিলেন ‘অব কী বার, ট্রাম্প সরকার’। অর্থাৎ আমাদের মোদিজী ট্রাম্পের জন্যে ভোট চেয়েছিলেন। কোনও একটা দেশের রাষ্ট্রনেতা অন্য দেশের নির্বাচনে কোনও একটি পক্ষ নেওয়ার নজির নেই। এমনটা হলে দু’দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কে সমস্যা হতে পারে। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে কূটনৈতিক সম্পর্কে ছেদও পড়তে পারে। মোদিজী সেই ভুলটাই করেছিলেন। এখন দেখা যাচ্ছে যে মোদির পছন্দের অর্থাৎ যার জন্যে ভোট চাইলেন তিনি হেরে গেছেন। অপছন্দের ব্যক্তিটিই রাষ্ট্রপতি হলেন। এখন ওই নব নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান ভারতের প্রতি কেমন আচরণ করবেন! সেই অজানা আশঙ্কায় আছেন ভারতীয়রা।
ইতিপূর্বেই প্রমাণিত হয়েছে মোদির ‘হিন্দুত্ব’ এজেন্ডার পূর্ণ সমর্থক ট্রাম্প। ৩৭০ উচ্ছেদের সমর্থন করেছেন ট্রাম্প। সিমান্ত সমস্যা বিশেষত ভারত চিন সম্পর্কের মধ্যে ট্রাম্প ভারতেরই পক্ষে। কিন্তু বাইডেন ট্রাম্পের বিরোধী পক্ষ হওয়ার কারণে স্বাভাবিক ভাবেই তার বিপরীতেই অবস্থান করেছেন। সুতরাং ৩৭০ বিলোপ বিরোধী, হিন্দুত্ব এজেন্ডাও বিরোধী, ভারত-চিন বিরোধে চিনেরই পক্ষে বাইডেন । তাহলে মোদি ভক্তদের ভাবতে হবে যারা “মোদির পছন্দ তাই আমাদেরও পছন্দ” হিসেবে ট্রাম্পের পক্ষে উদাত্ত নৃত্যে মত্ত ছিল, তাদের অবস্থান কি হবে?
আগে উল্লেখ করেছি ট্রাম্প ভারতের পছন্দের বা প্রিয় পাত্র নয় বরং ব্যক্তি মোদি ওর তার দলের পছন্দের। এই বক্তব্যের সমর্থনে জোরালো তথ্য হচ্ছে, যেদিন এই হাউডি মোদি অনুষ্ঠানে অব কী বার ট্রাম্প সরকার বলে স্লোগানটা দিয়েছিলেন সেদিন থেকেই ভারতের বিরোধী দলগুলো এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছিল। তাদের যে বক্তব্য এবং আশঙ্কা ছিল এখন সেই একই বক্তব্য এবং আশঙ্কার মাত্রা বেড়ে গেছে। তাই জো বাইডেন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার সাথে সাথে দেশের প্রধান বিরোধী মুখ রাহুল গান্ধী তড়িঘড়ি টুইট করে বাইডেনকে অভিনন্দন জানিয়েছেন,। অভিনন্দনের পাশাপাশি একটু হলেও তোল্লাই দিয়ে বলেছেন “বাইডেন নিশ্চয় আমেরিকাকে নতুন দিশা দেখাবেন।’’ সাথে সাথে নয়া ভাইস প্রেসিডেন্ট ভারতীয় বংশোদ্ভূত কমলা হ্যারিসকেও অভিনন্দন জানাতে ভোলেননি রাহুল। ভারতের রাষ্ট্রপ্রধানের অভিনন্দন সর্বাগ্রে হওয়া কেবল বাঞ্ছনীয় নয় কাম্যও। কিন্তু তিনি অভিনন্দন বার্তা দেবেন কিভাবে তা ভাবছেন হয়তো তারপূর্বেই বিরোধী দলের তরফ থেকে অভিনন্দন। এটাও তো নব নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে জানান দেয় ভারতে রাষ্ট্রপ্রধান ও বিরোধী দলের মধ্যে অধিকতর সিরিয়াস কে?
ফ্লাশব্যাকে দেখা যাচ্ছে, ২০১৯-এ দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রীর গদিতে ফেরার পর সেপ্টেম্বর মাসে, আমেরিকা সফরে যগিয়েছিলেন মোদি। মোদির জন্যে স্পেশাল ইভেন্ট ‘হাউডি মোদি’ সমাবেশ। সমাবেশে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পও হাজির ছিলেন। সেখানেই মোদি ট্রাম্পের উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় ভরিয়ে দিতে বলেছিলেন, ‘‘ভারতের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সংযোগ খুব ভালো হয়েছে। প্রার্থী ট্রাম্পের জন্যে ‘অব কী বার, ট্রাম্প সরকার’ ভাল ভাবেই প্রতিধ্বনিত হয়েছে।’’
মোদির এই মন্তব্যের পরেই কংগ্রেস-সহ বিরোধী নেতারা তাঁর সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন। তাঁদের অভিযোগ ছিল, নরেন্দ্র মোদি কার্যত ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকানদের মধ্যে ট্রাম্পের হয়ে প্রচার করেছেন। অন্য দেশের নির্বাচনে নাক গলিয়ে ভারতের বিদেশনীতির বিরুদ্ধে গিয়েছেন। এটা ভারতের দীর্ঘমেয়াদি কূটনৈতিক স্বার্থের পরিপন্থী। তবে বহুবিধ প্রশ্নবানের মুখে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে বলতে হয়েছিল, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। ট্রাম্প নিজে ‘অব কী বার, ট্রাম্প সরকার’ স্লোগান ব্যবহার করেছেন। প্রধানমন্ত্রী সেটাই বলেছিলেন।’’
কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধী তখনই বলেছিলেন, ‘‘বিদেশমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর ‘অপদার্থতা’ আড়ালের চেষ্টা করছেন। কারণ, ট্রাম্পকে সমর্থন করায় ভবিষ্যতে ভারতের সঙ্গে ডেমোক্র্যাটদের সমস্যা হবে। প্রধানমন্ত্রীকে কূটনীতিতেও শিক্ষা দিতে হবে জয়শঙ্করকে।’’
ডেমোক্র্যাট প্রার্থী বাইডেন জয়ী হওয়ার ফলে কি মোদির সেই অদূরদর্শিতার মাশুল দিতে হতে পারে ভারতকে? এবিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করলেও বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র দাবি করেছে, ভারতের সঙ্গে বোঝাপড়ায় আমেরিকার দু’দলেরই জোরালো সমর্থন রয়েছে’। এই দাবির বাস্তবতা কতটা রয়েছে সময়ই তা বলবে। অবাঞ্ছিতভাবে একটা দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়াতে নাক গলাব এবং বিশেষ একটা দলকে সমর্থন করব, তারপরও সুসম্পর্কের প্রত্যাশা করব তা কি হতে পারে?
তবে বিরোধী মুখ রাহুল গান্ধীর অভিনন্দন অনেকটাই ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে পারে। সেটা হলে আমেরিকা ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের সূত্রিতায় দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা হবে। আর প্রধানমন্ত্রীর থেকে প্রকাশ পেল চরম দায়িত্ব জ্ঞানহীনতা।
লেখক প্রাবন্ধিক ও মাদ্রাসা শিক্ষক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct