মুহাম্মাদ আবদুল মোমেন: মরহুম সৈয়দ মুন্সীর বাড়িতে আজ সকাল সকাল অনেক মানুষের আনাগোনা। সৈয়দ সাহেব চল্লিশ দিন আগে মারা গেছেন। আজ তার চল্লিশা। চল্লিশা: চল্লিশ দিনের খানা। পাঁচ হাজার মানুষের এলাহী ভোজসভাই হচ্ছে সৈয়দ মুন্সীর চল্লিশা। চল্লিশা খানার মহাভোজের আয়োজন চলছে। কাকভোর থেকে ষোল গণ্ডা মুনিশ রান্না বান্না, বাটনা বাটা, কুটন কোটা সবই চালিয়ে যাচ্ছে অবিরাম। বাড়ির কর্তা, আর্দালি, পিয়াদারাও ছুটেই চলেছে। প্রচুর মাংসের আয়োজন। দুটো বড় বড় রাম ছাগল। সর্বসাকুল্যে বলা যায় মুন্সী বাড়িতে মহা ব্যস্ততা।
মুন্সী বাড়ির পাশেই থাকে মাত্র চার বছরের আমিনা আর সাত বছরের রহিমা। তারা বছরখানেক হয়েছে এতিম হয়েগেছে। ওদের আব্বা প্লিহার অসুখ ভোগ করে ওদের ছেড়ে নাফেরার দেশে চলে গেছে। মা, পাশের গ্রামের বনেদি বাড়িতে ঘরোয়া কাজ করে তিনটে পেট চালায়। আজকেও মা অন্য দিনগুলোর মত গৃহস্থ বাড়িতে কাজে চলে গেছে। ছোট্ট আমিনা আর রহিমাকে ওদের মা বলেগেছে হাঁড়িতে পান্তাভাত আছে দুপুরে খেয়ে নিস।
মুন্সী বাড়িতে মহা আয়োজন তাই জনমানুষের ভিড়ে ভিড়াক্কার। তা দেখে কৌতুলোদ্দীপ্ত চিত্তে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকে তারা। মলীন বদনে, ময়লা, ছেঁড়া- ফাটা দেহাবরণে অবোধ শিশুদের ভিড়ের মধ্যে ঘোরাঘুরি কর্মচঞল মানুষগুলোর চলনে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল। তাই মাঝে মধ্যেই কেউ না কেউ ওদের ধমক দিয়ে সরে যেতে বলছিল। মহল্লার মসজিদের ইমাম তথা মাওলানা সাহেব চল্লিশা - র পড়াশোনা করতে এসেছেন। ওনার আসার আগে পড়ার মজলিশে আরো জনা কুড়ি বৃদ্ধ এবং খান দশেক বাচ্চারা ভেজানো ছোলা নিয়ে চল্লিশার কলমা - দরুদ পড়ায় রত আছেন। ইমাম সাহেব তছবিহ দানা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন আর চতুর্দিকে ঘুরেফিরে লক্ষ্য করতে থাকলেন। সঙ্গে মনে মনে চাপ অনুভব করতে থাকলেন, সময়ের মধ্যে পড়া শেষ করা যাবে তো? কেননা এখন পর্যন্ত মাত্র কয়েকজন মুরুব্বী চল্লিশার পড়া পড়তে এসেছেন। যত বেশি সংখ্যক মানুষ পড়তে লাগবে ততই দ্রুত পাড়ার কাজ সমাধা হবে। শেষ পর্যন্ত সাকুল্যে শতাধিক বৃদ্ধ মানুষ যোগ দিলেন। ফলে কিছুটা হলেও একটু বিলম্বে পড়া শেষ হয়ে গেল। ইমাম সাহেব মজলিশে উপস্থিত সকলকে নিয়ে দুয়া সেরে নিলেন। দুয়ার পূর্বে মুন্সী বাড়ির কর্তাদের ডেকে নিয়ছিলেন। দুয়া শেষ হলে খাওয়া শুরু হবে ইমাম সাহেব তেমনটাই জানতেন। দুয়া শেষ করে চল্লিশার ভোজশালায় যাকে বলে খাওয়ার মজলিশে পৌঁছে দেখলেন পূর্ণ মজলিশে আহার চলছে। ইমাম সাহেব ভাবলেন এতগুলো মানুষ কোথায় ছিলেন! দুয়ার সময় তো দেখা যায়নি? প্রথম 'ফেরা' ভোজ শেষ হলে পরের ফেরাতে ভোজাসন পেলেন। খাওয়া দাওয়া সারছেন আর মনে মনে ভাবছেন, এমন সব সুন্দর, সুগঠনী, সুবেশী মানুষ গুলো কি 'চল্লিশা' খেতে এসেছেন? আধুনিক ভার্সনের গাড়ি ঘড়ি মেরে সব দল দল মানুষের লম্বা লাইন পড়েগেছে। ইমাম সাহেব যত দেখেন ততই বিস্মিত হতে থাকেন। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, পাশের বাড়ির এতিম বাচ্চা দুটোর কথা? যৎকিঞ্চিৎ অনুসন্ধান করতেই ক্ষুধার্ত, ললুপ নেত্রে ফেলফেল দৃষ্টিতে একস্থানে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করলেন। তাদের দিকে দীর্ঘক্ষণ লক্ষ্য রাখার পর ইমাম সাহেব চলে গেলেন।
এদিন ছোট্ট আমিনা ও রহিমাদের মা বাড়ি ফিরতে অনেক দেরি করেছে। সন্ধ্যা হয় হয় এমন সময় ক্লান্ত শরীর, ভগ্ন হৃদয়ে তারা ঘরে চলে আসে। একেবারে সন্ধ্যায় মা গৃহস্থ বাড়ির কাজ সেরে ভাত নিয়ে ঘরে ফিরে আসে। মা ওদের নিয়ে খেতে বসে। তখন ছোট্ট আমিনা মাকে বলে মা! ওদের বাড়িতে আজ না কতকিছু খানা হয়েছে। মা, জড়িয়ে যাওয়া স্বরে বলে মনা, তুমি এই আলুর তরকারি আর ডাল দিয়েও খেয়ে নাও। আমাদের এমন খেতে হয়। মায়ের কথা আমিনা শুনে নেয। তিনজনে আলুর তরকারি আর ডাল ভাত খেয়ে নিল। সারাদিনের না খাওয়া এবং দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকার ক্লান্তি তাদের গ্রাস করেছিল। ভাত পেটে পড়তেই ঘুম ধরে নিল। দুজনেই ঘুমিয়ে পড়লো। এদিকে মুন্সী বাড়ি বয়স্কা কর্তীর মনে পড়ে গেল, আমিনা ও রহিমার কথা। চটজলদি খানা বাড়ির খানাপিনা নিয়ে পড়িমরি করে আমিনাদের বাড়িতে হাজির। হাঁফাতে হাঁফাতে বলতে লাগলো, আমার একদম মনে ছিলনা। কেউ একটু মনেও করে দেয়নি। এখন মনে পড়ছে। ওদের জন্যে ভাত তরকারি এনেছি। ওদের খাইয়ে দিও। আমিনার মা খাবরটা নিয়ে রেখে দিয়ে বললো, এখই ওরা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কাল সকালে খাবেখোন। সকালে আর ওই খাবার খাওয়ার মত ছিলনা। পচে দুর্গন্ধ হয়ে যায়। শেষে কুকুরের খাবার হয়।
ইমাম সাহেবের পর্যবেক্ষণ জুময়ার দিনের নসিহতের উপজীব্য করলেন। চল্লিশা সম্পর্কে বয়ান করলেন। বক্তব্যে বললেন - মৃত ব্যক্তির মাগফিরাতের উদ্দেশ্যে খানা-পিনার উদ্দেশ্য সম্ভবত ব্যার্থ হচ্ছে। স্বচ্ছল ব্যক্তিদের খাওয়ানো অপেক্ষা দরিদ্রদের খাওয়ানোতেই ফায়দা।
বড়সড় খানাপিনার থেকে ছোটখাটো খানায় গরিব মিসকিন খাওয়ানোতেই আল্লাহ বেশি খুশি হবেন মনে করি। এমনভাবে অনেকগুলো নসিহত করলেন। এই নসিহত শোনার পর মহল্লার মানুষের মধ্যে আলোচনা - ইমাম সাহেব জামাতি, না হয়, লা মজহাবী। "ইমান খেকো ইমাম"। এই ইমামকে মসজিদ থেকে ছুটি করিয়ে দিতে হবে। সন্ধ্যায় জরুরি মিটিং হল। মিটিং থেকে ইমামকে ছুটি করে দেওয়া হল। সৈয়দ মুন্সীর চল্লিশা খানা, ইমাম সাহেবের ইমামতিতে মানা।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct