আপনজন ডেস্ক: রাজ্যে তৃণমূল সরকার আসার পর সংখ্যালঘু উন্নয়নে নানা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল রাজ্যে সরকারি চাকরিতে ১০ শতাংশ ওবিসি-এ সংরক্ষণ ঘোষণা। রাজ্য সরকারের চাকরিতে ওবিসি-এ সংরক্ষণ যখন বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে চলেছে তখন প্রশ্ন তুলে দিল মালদার এক প্রান্তিক গ্রামের সরকারি চাকরি না পাওয়া শিক্ষিত বেকার যুবকের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশ্যে লেখা চিঠি।
মালদার চাঁচল থানা এলাকার শুক্রবারী গ্রামের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার পাশ যুবক তাজিবুল হক গত ৩ নভেম্বর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে চিঠি লিখে স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন জানিয়েছেন। তাজিবুল কেন স্বেচ্ছামৃত্যু চাইছেন তার কারণও উল্লেখ করেছেন ওই চিঠিতে।
তাজিবুল তার চিঠিতে জানিয়েছেন, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশের পর কলেজ থেকে কাম্পাসিং শেষে তিনি এখন একজন শিক্ষিত বেকার যুবক। চিঠিতে অভিযোগ জানানো হয়, এমপ্লয়মেন্ট ব্যাংকে নাম নথিভুক্ত থাকলেও সরকারি চাকরির কোনও সুযোগ পাননি। সম্প্রতি আপনি ‘বাংলার সহায়তা কেন্দ্র’ প্রকল্পের মাধ্যমে বেকারদের কাজের বন্দোবস্ত করতে শুরু করেছেন, সেখানেও আবেদন করার পর কোনও ডাক পাননি। অতি সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা তার। বাবা-মা অনেক কষ্ট করে পড়িয়েছেন। তাঁদের বয়স হয়েছে। এমতাবস্থায় কোনও কাজ না পেলে বাবা-মাকে কিভাবে দেখাশোনা করবেন, কিভাবে তাদের সেবা-শুশ্রূষা করবেন সেই প্রশ্ন তুলে সরকারি চাকরি বঞ্চিত হওয়ার কারণে তার স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নেওয়া।
তাজিবুল মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিঠিতে লেখেন যার শিরোনাম হল ‘বিষয়: কর্মসংস্থানের সুযোগ না পাওয়ায় স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন।’ আর চিঠিতে লেখেন, ‘আপনার কাছে আমার বিনীত আবেদন, আমার এই অসহায়ত্বের কথা শুনে সমাধানের রাস্তা দেখিয়ে দিন। স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন থাকলো। অনেক জেনে-বুঝে কোনও উপায় না দেখে বাধ্য হয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। আপনি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, সকলের অভিভাবক, সেই হিসাবে আপনার কাছে আমার এই আর্জি পৌঁছানো দরকার বলে মনে করেছি। তাই এই স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদনপত্র। আমার অসহায়ত্বের কথা, যন্ত্রণার কথা, মনের কথা উল্লেখের চেষ্টা করেছি। আমি যে কি নিদারুণ যন্ত্রণার মধ্যে রয়েছি সে কথা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এই চিঠি আমার কষ্টের নমুনা মাত্র। আমার মৃত্যুর পর আর কোনও শিক্ষিত বেকার যুবকের জীবন যাতে এইভাবে মৃত্যুমুখে পতিত না হয়, সেই বিষয়টিও দেখার আবেদন রইল’।
উল্লেখ্য, রাজ্যে তৃণমূল সরকার আসার আগে ৩৪ বছরের বাম শাসনে রাজ্য সরকারের চাকরিতে মুসলিমদের উপস্থিতির হার তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না বলে অভিযোগ প্রবল হয়। সাচার কমিটির রিপোর্টই পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকুরিতে মুসলিমদের হার নগণ্য বলে জানিয়ে দেওয়ায় সেই অভিযোগ নিয়ে বিপাকে পড়েছিল তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। যে সরকারের ভোট ব্যাঙ্ক ছিল মুসলিমরা, ২০০৬ সালে সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশের পর বাম সরকারের ‘মুসলিম প্রীতি’ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে।
যদিও পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা শিক্ষা দফতরের মন্ত্রী ড. আবদুস সাত্তার সাচার রিপোর্টের বাস্তবতা অস্বীকার করে বলেছিলেন সাচার রিপোর্ট ঠিকভাবে বাংলার মুসলিমদের সরকারি চাকরির হাল তুলে ধরেননি। তাই সাচার রিপোর্ট অনুযায়ী রাজ্যে সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের হার ২.১ শতাংশ মাত্র বলে উল্লেখ করা হয়।
সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশের ১৪ বছর পেরিয়ে গেছে। বামফ্রন্টের মুসলিম ভোট ব্যাঙ্কে ধস নামিয়ে রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল সরকার।
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মমতা আশ্বাস দিয়েছিলেন, তিনি রাজ্যের সংখ্যালঘুদের সার্বিক উন্নয়নে বিশেষ নজর দেবেন। সেই মতো তিনি সরকারি চাকরিতে ওবিসি-এ সংরক্ষণ ১০ শতাংশ বরাদ্দ করে মুসলিমদের মন জয় করেন। এরপর একে একে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টিনন্দন স্তাপত্য সম্বলিত নিউটাউন ক্যাম্পাস তৈরি করে বুঝিয়ে দেন তিনি রাজ্যের মুসলিমদের প্রতি সদয় রয়েছেন। নির্বাচনে দেখা যায় মুসলিম প্রধান এলাকাগুলি থেকে একচ্ছত্র ভাবে ভোট গিয়ে পড়েছে তৃণমূলে বাক্সে। এক সময়ের বামেদের ভোট ব্যাঙ্ক মুসলিমরাই তৃণমূলের ভোট ব্যাঙ্কে পরিণত হয়।
কিন্তু ইদানীংকালে এক শ্রেণির সংখ্যালঘু মানুষ অভিযোগ তুলতে শুরু করেছেন, মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন রাজ্যের সংখ্যালঘুদে উন্নয়নের জন্য, বাস্তবের সঙ্গে ততটা মিল নেই। যদিও তারা স্বীকার করেন মুখ্যমন্ত্রী সংখ্যালঘু উন্নয়নে নিবেদিত প্রাণ হলেও এক শ্রেণির সরকারি আমলা ও শাসক দলের নেতাদের সদিচ্ছার অভাবে মমতার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বিশেষ করে সরকারি চাকুরিতে।
এ ব্যাপারে রাজ্যে তৃণমূল সরকার আসার পর বেসরকারি উদ্যোগ্যে একটি সমীক্ষা হয়। আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে ২০১৪ সালে পাওয়া যায় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা স্ন্যাপ ও গাইডেন্স গিল্ড প্রকাশিত এক সমীক্ষা রিপোর্ট (স্ট্যাটাস অফ মুসলিমস অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল, প্রিলিমিনারি পাবলিক রিপোর্ট ২০১৪)। নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেনের সংস্থা প্রতীচী ট্রাস্টের সহযোগিতায় স্ন্যাপ ও গাইডেন্স গিল্ড-এর ৭৭ পাতার রিপোর্টে মুসলিমদের আর্থ সামাজিক ও শিক্ষার হাল তুলে ধরা হলেও তাতে রাজ্যের সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের উপস্থিতি নিয়ে কোনও তথ্য ছিল না।
তবে, সাচার রিপোর্টের পর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘ব্যুরো অফ অ্যাপ্লায়েড ইকোনমিকস অ্যান্ড স্ট্যাটিকস’ ‘স্টাফ সেন্সাস রিপোর্ট: ২০১৪-১৫’ প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, সাচার রিপোর্টে সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের উপস্থিতি ছিল ২.১ শতাংশ। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘ব্যুরো অফ অ্যাপ্লায়েড ইকোনমিকস অ্যান্ড স্ট্যাটিকস’ যে ‘স্টাফ সেন্সাস রিপোর্ট: ২০১৪-১৫’ প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে ২০১৫ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের অংশিদারিত্বের হার ৫.৭৩ শতাংশ। অর্থাৎ, স্বীকার করতে বাধা নেই রাজ্যের সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের চাকরির হার বেড়েছে।
অবশ্য সংখ্যালঘূদের একাংশ প্রশ্ন তুলছে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারি চাকরিতে ওবিসি-এ সংরক্ষণ বরাদ্দ করেছেন ১০ শতাংশ। এই ওবিসি-এ তালিকাভূক্তরা মূলত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। কিন্তু রাজ্য সরকারের চাকরিতে সেই ১০ শতাংশের বাস্তবায়ন না হওয়ার অভিযোগ উঠতে শুরু হয়। ‘স্টাফ সেন্সাস রিপোর্ট: ২০১৪-১৫’ অনুযায়ী রাজ্য সরকারি চাকরিতে ৫.৭৩ শতাংশ মুসলিম উপস্থিতি সেই অভিযোগকে আরও ইন্ধন যোগায়।
তবে, ২০১৩-১৪ বর্ষের স্টাফ সেন্সাস অনুযায়ী যেখানে রাজ্যে সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের হার ছিল যেখানে ৫.৪৭ শতাংশ, তা ২০১৪-১৫ বর্ষে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৫.৭৩ শতাংশ। মনে করা হচ্ছে, সরকারি চাকরিতে ১০ শতাংশ ওবিসি-এ সংরক্ষণের ফল এটি।
উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ব্যুরো অফ অ্যাপ্লায়েড ইকোনমিকস অ্যান্ড ১৯৪৮ সাল থেকে ‘সেন্সাস অফ স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ’ রিপোর্ট প্রকাশ করে আসছে। তবে, ২০১৩-১৪ সালে যে এমপ্লয়মেন্ট সেন্সাস প্রকাশ করা হয়েছে তা সংগৃহীত হয়েছে ২০১৪ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। আর ২০১৪-১৫ সালের রিপোর্টের তথ্য সংগহ করা হয়েছে ২০১৫ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। উভয় রিপোর্টই ৪৫ পাতার। ২০১৪ সালের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে ১৮টি জেলার তথ্য। আর ২০১৫ সালের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে ১৯টি জেলার তথ্য। এই রিপোর্ট বলছে, ২০১৫ সালে রাজ্যে সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা কমেছে ২০১৪ সালের তুলনায়। ২০১৪ সালে যেখা রাজ্যে সরকারি কর্মচারীদের সংখ্যা ছিল ৩,৫৩,৫২৫ সেখানে ২০১৫ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৩,৩১,২৪৯। তবে, ২০১৪ সালের তুলনায় মুসলিমদের চাকরি পাওয়ার হার বেড়েছে ২০১৫ সালে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct