আপনজন ডেস্ক: গঙ্গার উপর ফরাক্কা বাঁধ রাজ্যের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। মালদা জেলার ফরাক্কা সহ কালিয়াচক এলাকার বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষ এই বাঁধের জন্য জমি ছাড়তে বাধ্য হন। কারণ, সরকারের তরফে বাঁধের জন্য জমি অধিগ্রহণ করে সরকার। প্রবাহিত গঙ্গা নদীর উপর এই বাঁধ তৈরি উদ্দেশ্যে ছিল নব্যতা কমিয়ে হুগলি বন্দরকে পুনরীজ্জীবিত করা। তাই অবস্থানগত কারণে গঙ্গার জল আটকাতে বাঁধ দেওয়া হয়। ১৯৬১ সালে এই বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হলেও তা শেষ হয় ১৯৭৫ সালে। অবশেষে ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল থেকে বাঁধ চালু হয়।
২,২৪০ মিটার বা ৭,৩৫০ ফুট দীর্ঘ ফারাক্কা বাঁধটি তৈরি করেছিল হিন্দুস্তান কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। প্রযুক্তিগত সহায়তা নিয়েছিল তৎকালীন সোভিযেত সরকারের। মোট ১০৯টি স্লুইস গেট সম্পন্ন এই বাঁধের জলই ভরসা ফরাক্কা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য। এই বাঁধের জল্ বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে মতবিরোধ রয়েছে। কল্যাণ রুদ্র থেকে শুরু করে বহু পরিবেশবিদ ফরাক্কা বাঁধের পরিণামের কথা তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশেও জল বণ্টনের ব্যাপারে নানা অভিযোগ করে আসছে। এ সবের মাঝে হারিয়ে গেছে যারা জমি দান করেছে তাদের ত্যাগের বিনিময়ে প্রাপ্যর কথা। রাজ্য সরকার সার্কুলার জারি করে বলেছিল, যারা ফরাক্কা বাঁধের জন্য জমি হারাবে বা যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হবে তাদের পরিবারের একজনকে অন্তত চাকরি দেওয়া হবে।
মায়ের সঙ্গে আলি হোসেন। আপনজন চিত্র।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে বহু মানুষ জমিভিটে হারিয়ে এখন পথে বসলেও তাদের পরিবারের সদস্যদের চাকরি পেতে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। মুখ চেয়ে বসে থাকতে হচ্ছে কবে তাদের চাকরি জুটবে। অথচ এই সব জমি হারানো মানুষদের রাজ্য সরকারের তরফেও ‘ল্যান্ড লুজার’ হিসেবে সার্টিফিকেটও দেওয়া হয়েছিল। তারপর সেই সার্টিফিকেট অনুযায়ী পরিবারের তরফ থেকে সরকারের কাছে চাকরি আবেদন করা হয় নিয়ম মেনে। সরকারও তাদেরকে ‘চাকরির’ কার্ড দিয়ে দেয়। কিন্তু আজও তাদের চাকরি মেলেনি। সেই চাকরি না দেওয়ার বিরুদ্ধে গঠিত হয়েছে ‘মালদহ জেলা ল্যান্ড লুজার (ই.সি) উন্নয়ন সমিতি’। সেই সমিতি রাজ্য সরকারের ১০০ পয়েন্ট রোস্টারে উল্লেখ থাকা ই.সি সংরক্ষণের বাস্তবায়নের কথা বললেও তা মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ তুলেছে এই সমিতি।
বিধায়ক থেকে শুরু করে তাবড় তাবড় নেতাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও চাকরি না মেলায় তারা এখন জীবন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত করছেন।
ফরাক্কার বাঁধের জন্য জমি অধিগ্রহণের ফলে এখন প্রায় ভিটেমাটি ‘শূন্য’ এক পরিবারের সন্তান আলি হোসেন নীরবে ‘মালদহ জেলা ল্যান্ড লুজার (ই.সি) উন্নয়ন সমিতি’র হয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, তাদের মতো অন্যান্য পরিবারের সদস্যরা যাতে চাকরি পান। যখন ফরাক্কা বাঁধের জন্য জমি অধিগ্রহণ হয়, এখন এই আন্দোলনকারীদের অনেকেই অবশ্য জন্মাননি। কিন্তু লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, যদি সরকার তাদেরই জারি করা সার্কুলারের বাস্তবায়ন করে চাকরি দেয়।
ফরাক্কা বাঁধ লাগোয়া ও গঙ্গার ধারে কালিয়াচক থানা এলাকার তোফি গ্রামের বাসিন্দা মুমহাম্মদ আলি হোসেন। তার বাবা গাজিরুদ্দিন সেখের বিঘে তিনেক জমি ফরাক্কার জন্য অধিগ্রহণ করে সরকার। কিন্তু তিনি জানতেন না ‘ল্যান্ড লুজারদের’ পরিবারের কারোর সরকারি চাকরি দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। এর মূল কারণ তিনি শিক্ষিত নন। তার তিন ছেলের মধ্যে ছোট ছেলেই একমাত্র কোনওক্রমে বিএ পাস করেছেন। কালিয়াচক কলেজ থেকে গাজিরুদ্দিনের ছোট ছেলে আলি হোসেন স্নাতক হলেও আরও তদুই পুত্র ও কন্যা কেউ কিন্তু মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরননি। গাজিরুদ্দিনের জমি অধিগ্রহণ হয়েছে ফরাক্কা বাঁধের জন্য। বাকি কিছু জমি গঙ্গার করাল গ্রাসে চলে যাওয়া সামান্য কাটা চারেক জমিই এখন ভরসা।
আলি হোসেন ২০১৫ সালে বিষয়টি নিয়ে সক্রিয় হন। তার নাম এমপ্লয়মেন্ট একচেঞ্জে এক্সামটেড ক্যাটেগরিতে নাম নথিভুক্ত করেন ল্যান্ড লুজারদের চাকরি দেওয়ার নিয়মের ভিত্তিতে। তারপর সরকারি নিয়ম মেনে আবেদন করেন রাজ্য সরকারের কাছে। সেই আবেদনের ভিত্তিতে তৎকালীন মালদা জেলার অতিরিক্ত জেলাশাসক ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে চাকরির জন্য সুপারিশ করেন কলকাতার ৬৭ নং বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে ডেপুটি ডিরেক্টর অফ এমপ্লয়মেন্টের কাছে। এই মর্মে ২০১৫ সালের ২৬ আগস্ট আলি হোসেনকে দেওয়া সার্টিফিকেটে মালদার অতিরিক্ত জেলাশাসক ১৫/০৯/২০১৪ তারিখের 614/LA অফিস মেমো অনুযায়ী আলি হোসেনকে ‘ল্যান্ড লুজার’ পরিবারের সদস্য হিসেবে চাকরি দেওয়ার জন্য ৬৭ নং বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে ডেপুটি ডিরেক্টর অফ এমপ্লয়মেন্টের কাছে ফরওয়ার্ড করা হল।
এরপর বহুবার মালদা জেলা শাসক থেকে শুরু করে মোথাবাড়ির বিধায়কের কাছে সরকারি নিয়মের ভিত্তিতে তার চাকরি দেওয়ার দাবি জানালেও কোনও কাজ হয়নি। যদিও, আলি হোসেনের নেতৃত্বে গড়া ‘মালদহ জেলা ল্যান্ড লুজার (ই.সি) উন্নয়ন সমিতি’ দাবি জানিয়ে এসেছে, অবিলম্বে সরকারি রোস্টার মেনে ল্ন্ডলুজারদের চাকরি দেওয়া হোক। যারা ল্যান্ড লুজার হিসেবে চাকরি পেয়েছেন তাদের তালিকা প্রকাশ করা হোক। যতদিন না বাকি ল্যান্ড লুজারতে চাকরি হয় ততদিন যেন মাসিক ১০ হাজার টাকা ভাতা দেওয়া হোক ইত্যাদি। ২০১৮ সালে সেই দাবি সম্বলিত কপি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী ও রাজ্যপালের কাছে পাঠান। তাতেও কোনও কাজ হয়নি।
এ সম্পর্কে আলি হোসেন জানান, ল্যান্ড লুজার হিসেব চাকরির দাবি জানিয়ে আসছি ২০১৫ সাল থেকে। সেই লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মধ্যে তার বাবা গাজিরুদ্দিন সেখের মৃত্যু হয়েছে বছর খানেক আগে। বড় দিদি বিয়ে হয়ে গেলেও সংসারের খরচ নির্বাহ করতে তার দুই দাদা রবিউল সেখ ও বিশরদি সেখকে ভিন রাজ্যে শ্রমিকের কাজে যেতে হয়। যদি সরকারি চাকরি মিরত তাহলে আর তাদেরকে শ্রমিকের কাজে ভিন রাজ্যে যেতে হত না।
আলি হোসেন জানান, যখন সরকারি তরফে কোনও সাড়া পাননি তখন গত বছর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ‘দিদিকে বলো’-র নম্বরে ফোন করি। তারা বিষয়টি সম্পর্কে সব শোনেন। তারপর তার কাছে ‘দিদিকে বলো’ থেকে তাকে ফোন করে জানানো হয়, তার বাড়িতে সরকারি প্রতিনিধি যাবে বিষয়টির সুরাহা করার জন্য। আলি হোসেন দুঃখের সঙ্গে জানান, বছর পার হয়ে গেলেও কোনও সরকারি প্রতিনিধি তার বাড়িতে আসেননি।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৫ অক্টোবর সব জেলার সরকারি আধিকারিকদের সঙ্গে প্রশাসনিক ভার্চুয়াল করার কথা। তবু বড় আশায় রয়েছেন আলি হোসেন যদি মানবিক মুখ্যমন্ত্রী ওই বৈঠকে ঘোষণা করেন ল্যান্ড লুজারদের আটকে থাকা চাকরি অবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে হবে। সেই প্রতীক্ষায় দিন গুনছেন আলি হোসেনের মতো ফরাক্কা বাঁধের জন্য জমি হারানো পরিবারের সদস্যরা।
আলি হোসেনের দেওয়া কিছু তথ্য-প্রমাণ:
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct