সুতপা কর: পৃথিবী, রাষ্ট্র, সমাজ, সংসার, সর্বোপরি মানুষ নিয়মের দাস। আবার সামাজিক জীব হিসাবে মানুষকে মানতে হয় কিছু নিয়ম, কিছু রীতি-নীতি। মানুষই এই নিয়মগুলি তৈরি করেছে তার সমাজ-সংসার, তার রাষ্ট্রের প্রতি আবশ্যকীয় কর্তব্য পালনের জন্য।একটি কল্যাণমুখী সমাজ কখনই এমন নিয়ম - রীতি তৈরি করেনা যা ধ্বংসাত্মক। সুতরাং , সেই নিয়ম-রীতিগুলিকে যথার্থ সম্মান দেওয়া, মেনে চলার মধ্যে লুকিয়ে আছে সাফল্যের বীজ। বস্তুত যে কোনো সফল মানুষের জীবন আলেখ্য বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখব, আদতে তারা সামাজিক, পারিবারিক নাগরিক রীতি-নীতি মেনে চলেছেন বলে সাফল্যের শীর্ষেউঠতে পেরেছেন।একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে আমরা বুঝতে পারব প্রকৃতিও স্বীয় নিয়মের দাস। প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করলে প্রকৃতির নিয়মেও বিচ্যুতি ঘটে।যা সুখদায়ক হয় না কোনও দিক থেকেই।
তাই আমাদের শিশু বয়স থেকে আমাদের পিতা-মাতা এবং অন্যান্য গুরুজন আমাদের চরিত্রে বেশ কিছু নিয়ম-রীতি প্রবেশ করতে সচেষ্ট থাকেন। যা কালক্রমে আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়। তরুণ বয়সে অবশ্য কেউ কেউ স্রোতের বিরুদ্ধে যেতে সচেষ্ট হয়— তারা সংসার , সমাজ বা এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানের নিয়ম-রীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শৃঙ্খলাভঙ্গের মাধ্যমে বাহাদুরি প্রকাশ করেথাকে। এ জাতীয় আচরণ হঠকারিতা ছাড়া কিছু নয়। মনে রাখতে হবে, জীবনের যে কোনও ক্ষেত্রে সফল হওয়ার জন্য শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপন জরুরি।
সৃষ্টির আদিকাল থেকেই চন্দ্র সূৰ্য গ্রহ নক্ষত্র কঠোরশৃঙ্খলায় আবদ্ধ। ভোরবেলায় নির্দিষ্ট সময়ে সূর্য ওঠে , অস্তও যায় নিয়মমাফিক। গ্রহ উপগ্রহের কর্মকান্ডও সংঘঠিত হচ্ছে একেবারে রুটিন মেনে, একচুল এদিক ওদিক নেই। হাজার হাজার বছর ধরে মহাজাগতিক এই সব কর্মকান্ডের বিচ্যুতি ঘটেনি কখনও। শৃঙ্খলা বা নিয়মানুবর্তিতার চূড়ান্ত নিদর্শন এগুলি। আমাদের প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান যেমন বায়ু, জল, উদ্ভিদ প্রভৃতিগুলিও নির্দিষ্ট সূত্র বা শৃঙ্খলা মেনে চলে। শৃঙ্খলা হল নিজের চিন্তাভাবনা এবং কার্যাবলীকে নিয়ন্ত্রন করার সক্ষমতা।
নির্দিষ্ট আইন ও বিধি মেনে নিজের জীবনযাত্রার পরিচালনা করার অর্থই হল শৃঙ্খলা। সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করার মধ্যে শৃঙ্খলার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। শৃঙ্খলা মানুষকে সঠিক পথও দেখায়। আমরা যেখানেই থাকি না কেন , যে কাজই করি না কেন শৃঙ্খলার গুরুত্ব কোন অংশে হ্রাস পায় না। শৃঙ্খলা না থাকলে জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বিশৃঙ্খল জীবন সাফল্যের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, ব্যর্থতার মূর্ত প্রতীকরূপে প্রতিভাত হয়। একজন সুশৃঙ্খল মানুষ আইন মেনে চলেন, গুরুজনদের কিংবা উর্দ্ধতন কতৃপক্ষের আদেশকে মান্যতা দেন। এই আইন বা বিধি রাষ্ট্র বা সমাজ কর্তৃক ধার্য হতে পারে কিংবা আরােপিত হতে পারে। মানুষ তথা সমাজের শান্তি ও প্রগতির জন্য রাষ্ট্র বা নাগরিক সমাজ বিভিন্ন আইন কানুন প্রণয়ন ও রূপায়ণ করতে পারে। কিন্তু নিজের জীবনে সাফল্য ও সমৃদ্ধির জন্য নিজেকেই উদ্যোগ নিতে হবে। চালু রাখতে হবে কঠোর আত্ম-নিয়ন্ত্রণ। করতে হবে স্বার্থত্যাগ। ‘কি করব’ এবং ‘কি করব না’ -তার তালিকা তৈরি করে কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে স্বরচিত আইন। শৃঙ্খলা থাকলে ব্যক্তির আচরণও মার্জিত পরিশীলিত হয়।
শৃঙ্খলা আমাদের দেহ, মন এবং আত্মাকে নিয়ন্ত্রণে রাখে - যার দ্বারা আমরা যে কোন কাজ সহজে সঠিকউপায়ে করতে পারি। শৃঙ্খলা থাকার অর্থ লক্ষ্যের প্রতি ফোকাসড থাকা এবং লক্ষ্যপূরণের উদ্দেশ্যে গৃহীত উদ্যোগগুলি সুসংবদ্ধ এবং যুথবদ্ধ থাকা। নিঃসন্দেহে এটি সাফল্যলাভের এক আদর্শ ও অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করে দেয়।
অপরপক্ষে শৃঙ্খলার অভাব আমাদের মনে দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব তৈরী করে। ফোকাস নড়ে যায়, কার্যাবলী এলোমেলো হয়ে যায়। কাজের মধ্যে আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায় না, কাজের অগ্রগতিও হয় না। কার্য সম্পাদনের প্রতি পদে সমস্যার উদ্ভব হয়, জন্ম নেয় হতাশা। যা কালক্রমে ব্যক্তিকে ব্যর্থতার দিকে ঠেলে দেয়। একজন ছাত্র যদি বিশৃঙ্খল জীবন যাপন করে, সে কিছুই শিখতে পারে না, শিক্ষার উদ্দেশ্যটাই তার কাছে অর্থহীন হয়ে পড়ে। কিন্তু সে যদি নিজের জীবনে শৃঙ্খলা নিয়ে আসতে পারে, আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তবে সে শুধু শিখবেই না, বিষয়ের ওপর প্রভুত্বও করতে পারবে। পরীক্ষায় ভাল ফলও করতে পারবে। একইভাবে আমাদের পরিশ্রমগুলিকে যদি শৃঙ্খলায় আবদ্ধ করতে পারি, তবে অবশ্যই ভাল ফল আশা করতে পারব। সাফল্য পাবো অল্প সময়ে। প্রকৃতপক্ষে, সাফল্যের চাবিকাঠি হল শৃঙ্খলাবদ্ধ পরিশ্রম। শৃঙ্খলা আমাদের যেমন সাফল্যের স্বাদ এনে দেয় , অপরদিকে শরীরকে সুস্থ রাখে এবং মনকে শান্তি দেয়। শৃঙ্খলা আমাদের শক্তি যোগায়, চরিত্রগঠনে সহায়তা করে, সহমর্মী করে তোলে। সুতরাং সাফল্যের জন্য এটিকে কোনভাবে অবহেলা করা চলবে না। প্রকৃত শৃঙ্খলা দেশ বা দশের হানিকারক নয়। শৃঙ্খলা মানে কখনই শাস্তি নয়, জোর জবরদস্তি নয় অথবা দমবন্ধ করা কোনও অবস্থার জন্ম দেওয়া নয়। তবে অবশ্যই শৃঙ্খলা আরোপ করে যথেচ্ছাচার রোধে কিছু বিধিনিষেধ। তাই জীবনে সফল হওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত নিয়মনিষ্ঠ হওয়া।আপাতভাবে কঠোর মনে হলেও প্রস্তুতির সময় কোনও রূপ অবহেলা করলে চলবে না। কখনও মনে হতে পারে তুমি অসামাজিক হয়ে পড়ছ, পাঁচ জনে কটাক্ষও করতে পারে কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে হবে। পুজো-উৎসব , বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা তুলে রাখো সাফল্য পরবর্তী জীবনের জন্য। অর্থাৎ শুরুতেই নিজেকে নিয়মের এক বেষ্টনীতে বেঁধে ফেলতে হবে। মনে রাখবে , এ লড়াই নিজেকে নিজের কাছে প্রমাণ করার লড়াই। এই মানসিকতা নিয়ে তৈরি হতে হবে প্রতিযােগিতার জন্য। প্রতিযোগিতা যেহেতু হাড্ডাহাডিড, তাই তৈরি হতে হবে দাঁতে দাঁত চেপে। তাই প্রথমেই তৈরি করতে হবে রুটিন। যে রুটিন ভাঙা চলবে না , খুব প্রয়োজন না হলে।
শৃঙ্খলা বা ডিসিপ্লিন একটি মানসিক অবস্থা যার বহিঃপ্রকাশ মানুষের কার্যাবলীতে প্রকাশ পায়। কেউ কেউ এই গুনটি জন্ম সূত্রে প্রাপ্ত হয়, তবে বেশীরভাগ মানুষকে এটি অর্জন করতে হয়। এর জন্য যেমন আত্মত্যাগ দরকার, তেমনই দরকার তীব্র মনোবল এবং হাল না ছাড়া মানসিকতা। নিজের জীবনকে শৃঙ্খলার বেড়িতে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলতে পারলে যে কোন ক্ষেত্রে সাফল্য সহজসাধ্য হয়ে দাড়ায়। কি ভাবে নিজের জীবনকে ডিসিপ্লিনড় করা যায় তার কয়েকটি উপায় নীচে আলোচনা করা হল।
(১) নিজের সঙ্গে বসতে হবে শুরুতেই। প্রথমেই দেখতে হবে যে নিয়মগুলি তুমি মানবে বলে প্রাথমিকভাবে ঠিক করেছে তাতে তোমার মন কতটা সায় দিচ্ছে। মন যদি খুশি হয়ে নিয়মগুলি মানতে রাজি হয় অর্থাৎ তোমার পক্ষে খুব চাপের হবে না বলে বিশ্বাস জন্মায় তবে সেই নিয়ম ধরে এগিয়ে যাও। কখনই অন্যকে খুশি করতে কোনও কিছু নিজের ওপর চাপিয়ে দেওয়া বাস্তবসম্মত নয়। সেই নিয়ম বা বিধি অচিরেই বোঝা বলে মনে হতে পারে।
(২) নিয়ম তৈরির আগে পাঁচবার ভাবো। মানুষের চরিত্র তৈরি হয় তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রভাবে। পারিপার্শ্বিক এবং আজন্মলালিত ব্যবহার , আবেগ, ভালো লাগা-মন্দ লাগা রাতারাতি বদলে ফেলার চেষ্টা করার আগে আরেকটু ভাবতে হবে। নতুন নিয়ম-রীতি যাতে এই সহজাত অবস্থানগুলির মূলে আঘাত না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
(৩) কোনও সিদ্ধান্ত নিলে তাকে মেনে চলার অঙ্গীকার নিতে হবে। কোনও একটি নিয়ম মানতে মানতে কখনও শিথিলতা আসা দোষের নয়। শুধু তুমি কেন, এই দোষে দোষী বড় বড় মানুষও। কিন্তু তাঁরা জানেন কোথায় রাশ টানতে হয়। তোমাকেও সেই প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে নিরবচ্ছিন্নভাবে। শুরু যখন করেছে শেষটা দেখবে না?লড়াইয়ের ময়দানে যখন অবতীর্ণ হয়েছে, সাফল্য না পাওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। লড়াই করার এই মানসিকতাই তোমাকে সুশৃঙ্খল করে তুলবে।
(৪) নিজের কাছে পরিষ্কার থাকতে হবে। পৃথিবীর সবাইকে হয়তো একটা সময় পর্যন্ত ফাঁকি দেওয়া যায়, কিন্তু নিজেকে ফাঁকি দেওয়া একটি মুহূর্তের জন্যও সম্ভব নয়। নিজের কাছে পরিষ্কার - পরিচ্ছন্ন থাকার অর্থ সব সময় চাঙ্গা থাকা। নিজেকে মনে হবে আর সবার থেকে একটু আলাদা, মনে সব সময় ঝরঝরে ভাব অনুভব করবে। যা যে কোনও পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে তােমাকে সাহস জোগাবে, তোমাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করবে।
(৫) ম্যানেজ করতে হবে সব দিক। ওয়েল ম্যানেজ যারা করে তারাই গুড ম্যানেজার। ম্যানেজ করতে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। ঠিকঠাক সব দিকেম্যানেজ করে চলতে পারে তারা ছন্দোবদ্ধ জীবন উপভােগ করে। এই ম্যানেজ করার জন্য কতগুলি ছোট ছোট নিয়ম মানতে হয় , নিয়ম তৈরিকরতে হয়। হয়তো সে সব খুবই সাধারণ কিন্তু বাস্তবে এর অবদানও মহৎ হয়ে উঠতে পারে।ম্যানেজ করার এই গুনটি রপ্ত করতে পারলেদেখবে নিজের জীবনটা কেমন আপনা আপনিই ডিসিপ্লিনড হয়ে গেছে। সবশেষে, জীবন যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে কোনও অবস্থাতেই সমঝােতা করা যাবে না। যে নিয়ম বা শৃঙ্খলায় হয় নিজেকে বাঁধার অঙ্গীকার করেছে সেই রুটিন মাফিক ফেলতে হবে প্রতিটি পদক্ষেপ। এইভাবে এক সময় এই রুটিনই তোমার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মতো তোমার জীবনের সঙ্গে গেঁথে যাবে। যা তোমাকে বৃহত্তর জীবনে সফল হতে অপরিসীম সাহায্য করবেই করবে। সে যে রকমই হোক, নিয়মনীতি মেনে চলার অভ্যাস গড়ে ওঠার অর্থ জীবনে একটা শৃঙ্খলাবোধ গড়ে ওঠা। জীবনে সফল হতে এই শৃঙ্খলার অবদান অসীম।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct