বাবরি মসজিদ-রামমন্দির বিবাদ এখন স্তিমিত।সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বিষয়টির ফয়সালা করা হলেও তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। যদিও ভূমিপুজোর মাধ্যমে রামন্দিরের যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। অযোধ্যায় অতীত হয়ে উঠছে বাবরি মসজিদের ইতিহাস। কিন্তু মানুষের মধ্যে এখনও বাবরি মসজিদ-রামমন্দির নিয়ে বিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত সত্য উদঘাটনের আগ্রহ অব্যাহত রয়েছে। তাই রামের ইতিহাস থেকে শুরু করে রামমন্দির, বাবর থেকে শুরু করে বাবরি মসজিদ- সমগ্র বিষয়টি নিয়ে এই অনুসন্ধিৎসু প্রতিবেদনটি লিখেছেন দিলীপ মজুমদার। নবম কিস্তি।
১৯৮৯ সালে নতুন একটি মামলা হল ( Suit No. 236/1989)।মামলা করলেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জাস্টিস দেওকিনন্দন আগরওয়ালা।‘ভগবান শ্রীরাম বিরাজমান’এর পক্ষে তিনি ফৈজাবাদ সিভিল কোর্টের জজের কাছে দাবি করলেন ‘বিতর্কিত স্থানকে রাম জন্মভূমি হিসেবে ঘোষণা করা হোক।’ এ মামলা তিনি করেছিলেন ১লা জুলাই। ৭ জুলাই তিনি হাইকোর্টের কাছে আবেদন জানিয়ে বললেন, ‘ফৈজাবাদ সিভিল কোর্টে রুজু করা মামলাটি মহামান্য হাইকোর্টে স্থানান্তরিত করা হোক।’ ১০ জুলাই মসজিদ-মন্দির সংক্রান্ত সমস্ত মামলা হাইকোর্টের লখনউ বেঞ্চে পাঠানো হল। শুনানি গ্রহণ ও নিষ্পত্তির জন্য তিনজন বিচারক ঠিক হল। দেওকিনন্দনের মামলাটিও হাইকোর্টে পাঠানো হয়। অবশ্য c.p.c ১০নং ধারা অনুযায়ী ফুল বেঞ্চ তার শুনানি বন্ধ রাখেন।
১৯৮৯ সালের ১১ অগস্ট ১৯৬১ সালের ১২নং মামলার ২নং বিবাদী পরমহংস রামচন্দ্র দাস তাঁর আবেদনে জানান যে যেহেতু মামলাটি সুদীর্ঘকাল পড়ে আছে, তাই সিভিল প্রসিডিওর কোডের Order 8, Rule 2 অনুযায়ী সময়-উর্ত্তীর্ণ বলে খারিজ করা হোক। ১৪ অগস্ট লক্ষ্মৌ ফুল বেঞ্চ অর্ন্তবর্তী রায় দিলেন : ৫টি মামলার বাদী-বিবাদীরা বিতর্কিত জায়গার কোনরকম পরিবর্তনের চেষ্টা করতে পারবেন না। ২৩ অক্টোবর ফুল বেঞ্চ পরমহংস রামচন্দ্র দাসের আবেদন খারিজ করে দেন এবং ৭ নভেম্বর ফুল বেঞ্চ জানালেন ১৯৬১ সালের ১২নং মামলার পেশ করা নকশায় দেখানো ৫৮৬নং দাগসহ চিহ্নিত সীমানার সব সম্পত্তিই বিতর্কিত। অথচ বিতর্কিত জমির মালিকানা নির্ধারণের আগেই তা ব্যবহারের জন্য এক পক্ষকে দেওয়া হয়েছে।
১৯৮৯ সালের ১০ নভেম্বর ভারতীয় জনতা দল ঘোষণা করলেন পরদিন অর্থাৎ ১১ নভেম্বর মন্দির নির্মাণের জন্য করসেবা শুরু হবে এবং ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি শুরু হবে মন্দির নির্মাণের কাজ। ১৯৮৯ সালের ২ ডিসেম্বর আদালতের কাছে এক লিখিত আবেদন পেশ করলেন মৃত বাদী অভয়রাম দাসের স্থলাভিষিক্ত ধরম দাস। তিনি বললেন মন্দির ভেঙে বাবর-ই মসজিদ তৈরি করা হয়েছে। মন্দির ভেঙে মসজিদ গড়ার অভিযোগ এই প্রথম আদালতের কাছে উত্থাপিত হল। ৮ ডিসেম্বর ১৯৬১ সালের ১২নং মামলার ২নং বিবাদী পরমহংস রামচন্দ্র দাস এবং বাদী পক্ষ বেঞ্চের কাছে আবেদন জানালেন : বিতর্কিত স্থানটির সরজমিন তদন্ত হোক এবং বর্তমান অবস্থার ছবি তুলে রাখা হোক। সেদিন ও তার পরের দিন উভয়পক্ষের পেশ করা দরখাস্তের পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘ শুনানি চলে। ঠিক হয় ছবিসহ রিপোর্ট জমা দেবার শেষ তারিখ ১৫.০৭.৯০।
১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরের শেষে গোরখপুর বিশ্ববিদ্যাললয়ে ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন হয়। সারা দেশের ৩০০জন প্রতিনিধি এই কংগ্রেসে অংশগ্রহণ করেন। ৩০ ডিসেম্বর সেই সম্মেলনে বাবর-ই-মসজিদের ব্যাপারে সর্বসম্মতিক্রমে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এতেপ্রাচীন ও মধ্যযুগীয় স্থাপত্যকে Ancient Monument Act-এর আওতায় আনার সুপারিশ করা হয় : ‘... Monuments of ancient and mediaevel times should be rigorously brought under the protection of the Ancient Monuments Act, and no structural changed should be allowed, and that where ever religious worship had ceased, it should not be allowed to be re-started, whatever be the religious denomination involved. ‘ ( The Statesman, 06.01,1990).
ইতিহাস কংগ্রেসের অধিবেশনে গৃহীত এই প্রস্তাবের সংবাদ পেয়ে সাংসদ মোহন্ত অবৈদ্যনাথের নেতৃত্বে আর এস এস ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কিছু সদস্য অধিবেশন ভণ্ডুল করার চেষ্টা করেন। তার প্রতিবাদে ঐতিহাসিক ইরফান হাবিব, বরুণ দে, দুর্গাপ্রসাদ ভট্টাচার্য, আর চম্পালক্ষ্মীসহ অনেক ঐতিহাসিক অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করেন।
১৯৯০ সালের ১০ জানুয়ারি উভয়পক্ষের পেশ করা আবেদনের ব্যাপারে বেঞ্চ রায় দিল : উভয়পক্ষের আবেদনই মনে হচ্ছে CPC-র Order 39, Rule 7 অনুযায়ী এবং তাঁরা একই জিনিস চেয়েছেন। আদালত সিদ্ধান্ত নিচ্ছে যে সার্ভে কমিশন গঠন করা হোক এবং রেভিনিউ বোর্ডের রেজিস্টার বা সেক্রেটারিকে নির্দেশ দেওয়া হোক তাঁরা যেন সার্ভের ব্যাপারে একজন অভিজ্ঞ অফিসার নিয়োগ করে তাঁকে বিতর্কিত স্থানটির বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ বিবরণ জমা দিতে বলেন। সার্ভে অফিসারটি যেন P C S officerএর চেয়ে অধস্তন না হন। নথিতে আরও লেখা হল : ওই রিপোর্ট পাবার পরে দুপক্ষকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কমিশন গঠন করা হবে। উত্তরপ্রদেশের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে মসজিদ, মসজিদের স্তম্ভ ইত্যাদি নানা অংশের ছবি তুলে রাখারও নির্দেশ দেওয়া হল। আরও বলা হল : স্তম্ভ ও বিভিন্ন স্থানের নিদর্শনের কার্বন ডেটিংএর ব্যবস্থা করা হোক ; মন্দির ও সংলগ্ন স্থানেরও ছবি, ভিডিও ক্যাসেট তুলে রাখা হোক।
এর দুদিন পরে, ১২ জানুয়ারি ১৯৬১ সালের ১২নং মামলা খারিজের ব্যাপারে পরমহংস রামচন্দ্র দাস ও ধরম দাস দ্বারস্থ হন সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্ট একতরফা রায় দিয়ে বলেন : বিবাদীপক্ষ যদি মামলাটিকে সময়-উত্তীর্ণ বলে জোর দিতে চান, তবে যেখানে মূল মামলাটি রয়েছে সেই হাইকোর্টের বেঞ্চে এ আবেদন খতিয়ে দেখে গ্রহণ করা যেতে পারে ( ‘If the defendants press the contentions regarding maintainability grounded upon limitation to be raised as a preliminary issue, the Full Bench of the High Court which is trying this suit would do well to entertain the request . The evidence which is contemplated to be received under impugned order, in the event, should be confined to the issue. The S I P is disposed Of accordingly.’ ) ।
২৪ জানুয়ারি হাইকোর্টের বেঞ্চের কাছে রামচন্দ্র দাস আবার এক আবেদন করেন (u/s 151 of C.P.C) ।আবেদনে তিনি জানান যদিও তিনি ১৯৮৯ সালের ৮ডিসেম্বর বাদী পক্ষের সঙ্গে একই আবরদন করেছিলেন, সেই পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ১৯৯০ সালের ১০ জানুয়ারি যে রায় দিয়েছেন তা সুপ্রিম কোর্টের ১২ জানুয়ারির রায়ের পরে নিরর্থক হয়ে গেছে। উল্লেখযোগ্য যে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড এর বিরোধিতা করায় এর রায় দান স্থগিত হয়ে গেছে। সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড ৫ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের ১২ জানুয়ারির একতরফা রায় বাতিল অথবা পুর্নবিবেচনা করার জন্য দরখাস্ত পেশ করলেন, ৬ ফেব্রুয়ারি তাঁরা রামচন্দ্র দাসের ২৪ জানুয়ারি পেশ করা আবেদনের বিরুদ্ধতা করে পাল্টা আবেদন পেশ করেন।
১৩ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের ১২ জানুয়ারি দেওয়া রায়ের ব্যাখ্যা দিয়ে জানালেন : এই রায়ে তাঁরা ফুল বেঞ্চকে কোন নির্দেশ দিতে চান নি, কাজেই বিবাদী কোন নোটিশও তলব করেন নি। তাঁরা বেঞ্চকে শুধু জানিয়েছিলেন আবেদনকারীর আবেদনের গ্রহণযোগ্যতা তাঁরা বিচার করে দেখুন ( ‘Heard learned counsel, when we made our order on 12th January, 1990, we did not intend to give any direction to the Full Bench of the High Court specially constitued to hear the case and, therefore did not issue notice to the defendant-respondents. We only indicated that it was for the High Court to consider in case the defendant wanted the direction whether prayer should be entertained . Since we have given no direction the High Court is free to deal with the matter on its own.’)।
১৮৮৫ সালে মোহন্ত রঘুবর দাস ভারতের রাজ্য সেক্রেটারির বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন (Suit No. 61/280 of 1885)।মামলার আর্জিতে বলা হয়, ‘মসজিদের পাশে রাম চবুতরার উপর মন্দির তৈরির অনুমতি দেওয়া হোক।’ আর্জির সঙ্গে যে নকশা জমা দেওয়া হয় সেখানে চবুতরার পশ্চিমে মন্দিরকে দেখানো হয়েছে। ১৯৮৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ফৈজাবাদের সাব-জজ সে আবেদন খারিজ করে দিয়েছিলেন। সে সময় রঘুবর দাসের আবেদনের বিরোধিতা করেছিলেন বাবর-ই-মসজিদের তখনকার মুতাওয়াল্লি মহম্মদ আসগর। আসগর কারণ দেখিয়ে বলেন যে রাম চবুতরায় যদি মন্দির নির্মাণ হয় তাহলে মসজিদ ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা যছে। ফৈজাবাদের সাব-জজ রঘুবরের আবেদন খারিজ করায় তিনি ফৈজাবাদের জেলা জজ ও বিচার বিভাগীয় কমিশনারের কাছে আপিলের আবেদন করলে তাঁরাও তা খারিজ করেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি ফৈজাবাদের সাব-জজ যে রায় দিয়েছিলেন, তা তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছিলেন, ‘ এমন এক স্থানে বাদী মন্দির নির্মাণের আবেদন করেছেন যেখানে মন্দির ও মসজিদের একটিমাত্র প্রবেশপথ। যে স্থানে হিন্দুরা পূজা করে আসছে সেখানকার অধিকার সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করা যায় না। কিন্তু সেই স্থানে মন্দির নির্মিত হলে শাঁখ-ঘণ্টাধ্বনি হবে। সেখানে মন্দির তৈরি হলে ফৌজদারি মামলার ও সংঘর্ষের সম্ভাবনা থেকে যাবে।’ ( The prayer for permission to construct the temple is at such a place where there is one passage for the temple as well as for the mosque . The place wher the Hindus worship is in there possession from old and their ownership can not be questioned . ..... If a temple is constructed at such a place, then there will be sound of bells and sankha, when both Hindus and Muslims pass from the same way and if permission is given to Hindus for constructing temple, then one day or the other a criminal case will be started and thousands of people will be killed... the reliefs claimed should not be granted.’ )
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
পড়ুন:
রাম, রামায়ণ ও বাবরি মসজিদ নিয়ে রাজনীতির নেপথ্যে/১
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct