এসে গেল পুজো। কিন্তু আনন্দ নেই। চারদিকে ভয়ের ছায়া। করোনাভাইরাসের ছায়া। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন সেপ্টেম্বরে করোনা চলে যাবে। করোনা যায় নি। বহাল তবিয়তে আছে। বাড়ছে কলেবরে। ইউরোপের কয়েকটা দেশ তো কাঁপছে ভয়ে । দ্বিতীয় তরঙ্গের ভয়। আমাদের দেশের যে কেরল প্রথম কয়েকমাস তাকে বাগে এনেছিল, সে কেরলে এখন ত্রাহি ত্রাহি রব উঠছে। দৈনিক সংক্রমণের নিরিখে ভারত যেমন জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন নিয়েছে, কেরল তেমনি ভারতসভায় নিয়েছে শ্রেষ্ঠ আসন। কম নয় আমাদের রাজ্য। তিন হাজার ছাড়িয়ে চার হাজার ছুঁতে যাচ্ছে।
এরকম অবস্থায় ভেবেছিলাম সরকারবাহাদুর পুজো কমিটিগুলিকে বলবেন ঘটপুজো করে এবছরের পুজোর পাট চুকোতে। তা না করে তাঁরা ক্লাবগুলিকে পঞ্চাশ হাজার টাকা অনুদান দিলেন। ভাতা দিলেন পুরোহিতদের। তার মানে প্রকারান্তরে পুজো করতে উৎসাহ দেওয়া। তাঁরা কি দেখছেন না ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ফলাফল ? অভিযোগ উঠেছে, মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তানে 'তবলিগি' জমায়েতের ফলে করোনা সংক্রমণ বেড়েছে। ফ্রান্স আর আমেরিকায় গির্জায় সমাবেশে বেড়েছে সংক্রমণ। কেরলে হঠাৎ সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণ তাদের ওনাম উৎসবের জমায়েত । তার মানে আমাদের যত ভক্তি থাকুক না কেন, আল্লাহ বা গড বা ভগবান করোনার প্রকোপ থেকে আমাদের মুক্তি দিতে পারেন না।
তাহলে সরকার পুজোর অনুমতি দিলেন কেন?
কারণটা রাজনৈতিক। প্রথমত, ভক্তির আবেগে কিছু মানুষ পুজো না হলে দূষতেন সরকারকে। বলতেন, আমাদের ধর্ম-কর্মে বাধা দিচ্ছে সরকার। দ্বিতীয়ত, গেরুয়া শিবিরের ভীতি। হিন্দুত্ববাদী এই শিবির ভারতের ‘সনাতন ঐতিহ্যে’ বিশ্বাসী । কত আঁকা-বাঁকা পথে তাঁরা রামমন্দিরের শিলান্যাস করিয়ে ছাড়লেন। পুজো করতে না দিলে তাঁরা গর্জে উঠবেন। তাঁদের আই টি সেল বড় শক্তিমান, সেখানে নিরন্তর প্রচার শুরু হবে। সেটা ২০২১এর নির্বাচনে খারাপ প্রভাব ফেলবে । তাছাড়া মহামান্য রাজ্যপাল তো আছেনই। পুজো না হলে তিনিই বা ছেড়ে কথা বলবেন কেন? তিনিও যে বড় ভক্তিমান মানুষ। তৃতীয়ত, শারদোৎসবকে কেন্দ্র করে কিছু মানুষ মনের মুক্তি চান, একটু রাস্তায় বেরিয়ে আনন্দ করতে চান।
সুতরাং পুজো হচ্ছে। সেটা আরও পরিষ্কার বুঝলাম গতকাল। পাড়ার এক ক্লাবের ছেলেরা চাঁদা চাইতে এসেছে। একটু রেগে বললাম, ‘সাহস আছে তোমাদের। পুজো করছ, চাঁদা চাইতে এসেছ!’ তারা বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘ কি করব কাকু! এই কটা মাস একেবারে বোর হয়ে গেছি, অন্তত পুজোর কটা দিন একটু হেসে-খেলে কাটবে।’ বুঝলাম, সেই মুক্তি বা আনন্দতত্ত্ব। সত্যি তো হাঁপিয়ে উঠেছে মানুষ। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে প্রায় অসামাজিক হয়ে উঠেছে। মুখঢাকা দেখতে দেখতে মানুষ মানুষের মুখের কথা ভুলে গেছে। কথাটা শুধু আমাদের দেশের মানুষের নয়। এই তো দিনকয় আগে দেখলাম ইতালিতে মাস্ক আর লকডাউনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছে মানুষ। যখন শুনছে, করোনা কখন যাবে তার ঠিক নেই, তখন যেন বেপরোয়া হয়ে উঠতে চাইছে মানুষ। নাঃ, আর না, আর ভাল্লেগা না ।
শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা পুজো-পার্বণের সমাবেশ করোনা সংক্রমণ বাড়াচ্ছে না। তার সঙ্গে আছে রাজনৈতিক সমাবেশ। আসলে ধর্ম আর রাজনীতি একদিক থেকে ভাই-ভাই। দুটোই আফিম। গিলে ফেললেই চোখ আর মন ঢুলুঢুলু। দম মারো দম। যুক্তিবুদ্ধি ঘাবড়ে ঘোড়া। তখন আসল বাজিগর বাঁদরের মতো নাচায়। নাচায় পুতুল যথা দক্ষ বাজিগরে। করোনাভীতি কি দমিয়ে রাখতে পেরেছে রাজনৈতিক সমাবেশকে? প্রতিবাদের ও পাল্টা প্রতিবাদের সভাকে? না, মোটেই পারে নি। চিনের বিরুদ্ধে হংকংএ বিক্ষোভ সমাবেশ, কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার বিরুদ্ধে আমেরিকায় বিক্ষোভ সমাবেশ.... বিদেশ কেন, আমাদের মহান ভারতের দিকে চোখ মেলে তাকান। কৃষিবিলের বিরুদ্ধে কৃষক সমাবেশ, হাসরথে দলিত নারীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে সমাবেশ ও পাল্টা সমাবেশ, যেসব রাজ্যে নির্বাচন সেখানে শাসকের পক্ষে ও বিপক্ষে মিছিল-মিটিং, অযোধ্যায় রামমন্দিরের শিলান্যাসের ছদ্ম রাজনৈতিক সমাবেশ। কোন কোন রাজনৈতিক কর্মী ও নেতা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন, কিন্তু অন্যরা তা দেখে দমে যাচ্ছেন না। উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ ভয় নাই ওরে ভয় নাই। নেতাদের অকুতোভয়তা দেখে অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন কর্মীরা। করোনার ভয়কে জয় করার প্রেরণা। সে প্রেরণা তাঁরা লাভ করুন ক্ষতি নেই, কিন্তু তাঁরা যে আমজনতার বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারেন, সে কথা বোধহয় ভেবে দেখেন না। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের হাসপাতালে বা সেফ হোমে যাওয়ার সুবিধে আছে। কিন্তু রামা কৈবর্ত বা হাসিম শেখের সে সুযোগ নেই। এদিকে আবার সংবাদমাধ্যমে দেখছি হাসপাতালে সিট বাড়ন্ত। পুজোর পরে যে করোনা-সুনামি আসছে, সে কথা ভেবেই ভয়ে কাঁটা হচ্ছি। তবে আমজনতা সম্বন্ধেও আমার বড় বিস্ময় আছে । যেসব মানুষ থুতনিতে মাস্ক বেঁধে অথবা আদৌ না বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে, মনে হচ্ছে করোনা-ফরোনাকে থোড়াই কেয়ার করে, তাদের ঘরের পাশে কোন প্রতিবেশী করোনা আক্রান্ত হলে তার ছায়াও মাড়ায় না ।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct