২০০২ কি ২০০৩ সাল, তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখামন্ত্রী জ্যোতি বসু আশঙ্কা করে বলেছিলেন, আমরা প্রায়ই স্কুলভোটে হেরে যাচ্ছি। এতে জনমত আমাদের থেকে সরে যাচ্ছে| তাহলে সরে যাচ্ছে কোথায়? যাচ্ছে একটি উপযুক্ত মুখের সন্ধানে। আর সেই মুখটি বাংলার মানুষের জন্যই আগেই তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন আজকের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মাননীয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৯৩ সালের একুশে জুলাই মহাকরণ অভিযানের মাধ্যমে। সেই ইতিহাস সকলের জানা। ধারাবাহিক জনসংযোগের ও সিপিএমের এক শ্রেণির নেতাদের উদ্ধত আচরণের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধীরে ধীরে জনগণের কাছের মানুষ, এমনকি বাংলার দিদি-তে পরিণত করেছে। এই কাজ আরো সহজ করে দেয় নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুর এর জমি আন্দোলন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ওরা ৩০ আমরা ২৩৫। এটাই ছিল সিপিএম এর সর্বোচ্চ শিখর, তারপর নেমে এল পতন। এরপর ২০০৮ পঞ্চায়েত ২০০৯ লোকসভা নির্বাচন এবং অবশেষে ২০১১ বিধানসভা ১৮৫/২৯৪ বিধান সভা আসন জয়লাভ এর মাধ্যমে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেন।
শুরু হল নতুন যুগের সূচনা। শুরু হল বাংলার মানুষের অতৃপ্ত হৃদয়ে সরকারি সুধা সঞ্চারের কাজ অর্থাৎ সরকারি পরিষেবা বাংলার মানুষের দরজায় পৌঁছে দেওয়ার কাজ| বাংলার মানুষকে তিনি বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করলেন যে বাংলা সরকার বাংলার মানুষের সাথে যেমন বাংলার মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে আছে।
মমতা মানুষের কাছের মানুষ হিসেবে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেন। প্রথমেই তিনি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে ২০১২ সালে চাকরি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষকনিয়োগ করেন। এরফলে বাংলার মানুষ ও শিক্ষিত যুব সমাজের আস্থা অর্জন করেন। ধীরে ধীরে শিক্ষাক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ভাতা চালু করে স্কুলছুট কমানো উচ্চ শিক্ষায় আগ্রহ এবং অন্যান্য কাজ, বাল্যবিবাহ রোধে সক্রিয় হন। এরফলে দেখা যায় মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকে ছাত্রদের থেকে ছাত্রী পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। যদিও মিড-ডে-মিল অবশ্যই একটি বড় সহযোগী |
বাংলার প্রান্তিক মানুষের হাতে অর্থ যোগানোর ১০০ দিনের কাজে গতি আনা। সারা ভারতে নজির সৃষ্টি করেছে। বাংলার শিক্ষা ক্ষেত্রে সবুজসাথী অর্থাৎ ছাত্র-ছাত্রী বিনামূল্যে সাইকেল প্রদান এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ, এরই সাথে আছে আর এক প্রকল্প যা পৃথিবীতে নতুন দিশা দেখিয়েছে “কন্যাশ্রী” যা ইউনেস্কো দেখিয়েছে সারা পৃথিবীকে- “যে মাননীয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পৃথিবীর কন্যাশ্রী”।
এরপর “রূপশ্রী” এক কন্যাকে এক সাথে ২৫০০০ টাকা প্রদানে বিবাহিত জীবনে এক পরিণত মহিলা ও মা-এ পরিণত করে। বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ভর্তুকি যুক্ত ওষুধ বাংলার বাংলায় গর্ভবর্তী মায়েদের মাতৃযান। সরকারি হাসপাতালে নবজাতকের প্রসাবে ১০০০ টাকা প্রদান ইত্যাদির মাধ্যমে মা ও শিশু মৃত্যুরোধ সম্ভব হয়েছে।
নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ, উপজাতি সম্প্রদায়ের ও জনজাতি গোষ্ঠী গুলির প্রতি বিশেষ অর্থ প্রকল্প, জঙ্গলমহল সুন্দরবন এবং উত্তরবঙ্গের চা বাগান শ্রমিকদের বিশেষ রেশন ব্যবস্থা উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। সচিবালয় গঠন এই সরকারের এক উল্লেখযোগ্য যোগ্য পদক্ষেপ|
সরকারি প্রকল্পের সাথে চলে দলের কিছু কর্মীর নৈতিক অবক্ষয়। যার ফল দল ও সরকারের হয়। এরপর কিছু নেতা সুবিধামতো দলবদল করে। এতে ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মমতাকে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়। বাধ্য হয়ে তাকে বলতে হয়, আমি মমতা বন্দ্যোধ্যায়ের ২৯৪টি আসনে প্রার্থী। আমাকে দেখে ভোট দিন। মানুষ বিশ্বাস করলেন। ফলে ২১১টি আসন তার ঝুলিতে এল।
মাঝে অনেক জল গড়িয়েছে ২০১৯-এর লোকসভায় বিজেপি ২টি সিট থেকে ১৮টি আসন পেল।অবশ্যই তাতে মুকুল রায় এক বিশেষ কারণ। কারণ ২০১৬ সালে তিনি ঘাসফুল থেকে পদ্মফুলে যোগ দেন। কিন্তু বহু নেতা ও কর্মী বড় সুযোগের আশায় আগে থেকেই বিজেপিতে চলে যান। পরে অবশ্য কেউ ফিরেও আসেন।
দিলীপ ঘোষের গরু ও রাম রাজনীতি অনেককে বোকা বানায়।তবে বিজেপির ২০১৪ থেকে ২০১৯ লোককসভা নর্বিাচনে ২টি আসন থেকে ১৮টি করে ফেলা, অর্থাৎ ১৭ শতাংশ থেকে ৪২ শতাংশ ভোট পাওয়া এবং তৃণমূল কংগ্রেসের ৩৪ থেকে ২২ আসনে নেমে আসে। বামেদের ৩০ শতাংশ থেকে ভোট কমে হয় ৭ শতাংশ। ফলে, ২০১৪ সালে বিজেপির পাওয়া ১৭ শতাংশ ভোট ২৩ শতাংশ বেড়ে হয় ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ বামের ভোট রামের ভোটে পরিণত হয় বলে ধারণা হয়।
এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে মোট জনসংখ্যার ২৭শতাংশ সংখ্যালঘু মুসলিম। এই বোট বামেদের আমলে ছিল তাদের পক্ষে। তা এখন তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে চলে এসেছে বলে ধারণা। যদিও ধারণা করা যায় বিজেপি মুসলিম ভোট পাবে না। তাহলে এই ২৭ শতাংশ মুসলিম ভোট কোন দিকে যাবে। বাম বা কংগ্রেসের দুরবস্থার কারণে মানুষ বিমুখ হয়ে তৃণমূল কংগ্রেসে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ গেলে মমতার চিন্তার কারণ তাকার কথা নয়। বাকি অমুসলিম ভোটার ৬৭ শতাংশের মধ্যে ২৬ শতাংশ পেলেই মমতাকে আটকানো মুশকিল। তাই ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে মুসলিম ভোট সবচেয়ে বেশি ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে। মুসলিম ভোট ভাগ হলে তৃণমূলেরই বিপদ। আর বিজেপি ভোট বাম কৎবা কংগ্রেসে কিছুটা ফিলে এলে তৃণমূলের লাভ। সেক্ষেত্রে মুসলিম ভোটরে কিছু অংশ বাম বা কংগ্রেসে আবার ভোটের শতাংশের নিরিখে বিজেপির লাভ। কম ভোট পেয়েও তারা ফায়দা লুটতে পারে। তাই বিজেপি চাইবে মুসলিম ভোট ভাগ হয়ে যাক। বাম, কংগ্রেস, তৃণমূল সবাই পাক। আর ছোট ছোট মুসলিম দলগুলিও নির্বাচনে প্রার্থী দিয়ে মুসলিম ভোটে থাবা বসাক। নির্বাচনের বাদ্যি না পড়লে অবশ্য সেই ইঙ্গিত বোঝা যাবে।
তাই, আগামী ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে মুসলিম কোন দিকে যায় সেটাই দেখার।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত
(লেখক উত্তর ২৪ পরগনার সমাজকর্মী)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct