বাবরি মসজিদ-রামমন্দির বিবাদ এখন স্তিমিত।সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বিষয়টির ফয়সালা করা হলেও তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।যদিও ভূমিপুজোর মাধ্যমে রামন্দিরের যাত্রা শুরু হয়ে গেছে।অযোধ্যায় অতীত হয়ে উঠছে বাবরি মসজিদের ইতিহাস।কিন্তু মানুষের মধ্যে এখনও বাবরি মসজিদ-রামমন্দির নিয়ে বিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত সত্য উদঘাটনের আগ্রহ অব্যাহত রয়েছে।তাই রামের ইতিহাস থেকে শুরু করে রামমন্দির, বাবর থেকে শুরু করে বাবরি মসজিদ- সমগ্র বিষয়টি নিয়ে এই অনুসন্ধিৎসু প্রতিবেদনটি লিখেছেন দিলীপ মজুমদার।চতুর্থ কিস্তি।
তখন ইউনাইটেড প্রভিন্সের (আজকের উত্তরপ্রদেশ) মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন গোবিন্দবল্লভ পন্থ। ১৯৪৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর গোবিন্দবল্লভকে এক তারবার্তায় নেহেরু প্রতিকারের পথসন্ধান করতে অনুরোধ করেন _ ‘ I am disturbed at developments at Ayodhya . Earnestly hope you will personally interest yourself in this matter . dangerous example being set there which will have bad consequences’ . ১৯৫০ সালের ৭ জানুয়ারি গভর্নর জেনারেল সি রাজাগোপালাচারিকে লেখা এক চিঠিতেও নেহেরু অযোধ্যার ঘটনা সম্বন্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
গোবিন্দবল্লভ পন্থ মসজিদ থেকে রামলালার মূর্তি অপসারণের কথা বলতে জেলাশাসক কে কে নায়ার তাঁকে বললেন, মূর্তি অপসারণের ফল ভালো হবে না, ক্ষিপ্ত হবে উঠবে হিন্দু জনতা।১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসে নেহেরু আবার গোবিন্দবল্লভকে মূর্তি অপসারণের কথা বলেছিলেন। কিন্তু এ কথা স্বীকার করতে হবে যে বিজ্ঞান ও সমাজতন্ত্রের অনুরাগী হলেও ভোটব্যাঙ্কের কথা ভুলে যেতে পারেন নি তিনি। এরজন্য তিনি ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে মাত্র ৬০০ মাইল দূরবর্তী অযোধ্যায় হাজির হতে পারেন নি। তাছাড়া, আরও একটা বাধা ছিল। কংগ্রেস দলের ভেতরেও বহু সদস্য ছিলেন সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন। পাকিস্তান ও ভারতীয় মুসলমানদের তাঁরা অপছন্দ করতেন । ১৯৫০ সালের ১৯ জানুয়ারি কে কে নায়ারের এক আবেদনের ভিত্তিতে সিভিল জজ তার মূল কথা হল : বিতর্কিত স্থান থেকে রামলালার বিগ্রহ সরানো যাবে না, পুজোপাঠ যেমন চলছিল, তেমনি চলবে।
এবার শুরু হল আইনি যুদ্ধ। হিন্দু- মুসলমানের মধ্যে। ফৈজাবাদ জেলা আদালতে প্রথম মামলা দায়ের করলেন ৪২ বৎসর বয়স্ক আইনজীবী গোপাল সিং বিশারদ। ধর্মপ্রাণ ও রক্ষণশীল এই মানুষটি ছিলেন অযোধ্যার হিন্দু মহাসভার সম্পাদক। নায়ার ও গুরুদত্তের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। এই মামলার ( Suit No. 2 of 1950 ) বিবাদীরা : উত্তরপ্রদেশ সরকার, ফৈজাবাদের ডেপুটি কমিশনার, সিটি ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্ট ও জহুর আহম্মদসহ ৫ জন মুসলমান।গোপাল সিং বিশারদ আদালতের কাছে ইনজাংশন প্রার্থনা করেন এবং আবেদন করেন –‘ উপরোক্ত সৌধ থেকে শ্রীরাম বিগ্রহসহ অন্যান্য বিগ্রহ সরানো চলবে না, পুজো ও দর্শনে বাধা সৃষ্টি করার জন্য প্রবেশপথ বন্ধ করা চলবে না, বাদীর এই অধিকারে বিবাদীর বাধা দেওয়ার কোন অধিকার থাকবে না।’ লক্ষণীয় যে গোপাল সিংএর আবেদনে কোথাও উল্লেখ নেই যে বাবরি মসজিদের জায়গায় আগে কোন মন্দির ছিল এবং সেটি ধ্বংস করে মসজিদটি নির্মিত হয়েছে। বিশারদের আবেদনের ভিত্তিতে সিভিল জজ বীর সিং অন্তবর্তীকালিন নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেন এবং বলেন যে সেই স্থানে বেশি মানুষ ভিড় করতে পারবে না এবং নতুন কোন নির্মাণ করা যাবে না।
২১ ফেব্রুয়ারি মামলা করেন আনিসুর রহমান। মূর্তি বসানোর পর থেকে তিনি জেলার সরকারি কর্মকর্তাদের সতর্ক করে বলেছিলেন এর পরিণতি মারাত্মক হতে পারে। জালাশাসক নায়ার তাঁর কথাকে গুরুত্ব দেন নি। আদালতে রহমানের আবেদন বাতিল হবে যায়।
২৩ এপ্রিল উত্তরপ্রদেশের রাজ্য সরকারের তরফে এক লিখিত বিবরণ আদালতে পেশ করা হয়। আবেদনে বলা হয় ২/১৯৫০ এর সঙ্গে নিম্ন প্যারাগুলি জুড়ে দেওয়া হোক---
প্যারা-১৪- বিতর্কিত সম্পত্তি বাবর-ই-মসজিদ নামে পরিচিত। সুদীর্ঘকাল মুসলিমরা সেখানে নমাজ পড়ে আসছে, শ্রীরামের মন্দির হিসেবে সেটি কখনও ব্যবহৃত হব নি।
প্যারা-১৫—২২ ডিসেম্বর, ১৯৪৯ এর এক রাতে গোপনে অন্যায়ভাবে মসজিদের ভেতরে রামলালার মূর্তি রাখা হয়েছে ( ‘ That on the night of 22nd December, 1949 the idols of Sri Ramchandraji were surreptitiously and wrongly put inside it’ )।
প্যারা-১৬—অন্যায়ভাবে মূর্তি স্থাপন করার জন্য জনজীবনে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা হয়েছিল, প্রশাসনের হস্তক্ষেপ করা উচিত ছিল ( ‘That as a result of the said wrongful act a situation imperiling public peace and tranquility was created and the public authorities had to intervene inorder to prevent breaches of peace and tranquility’ )।
এই লিখিত আবেদন ফৈজাবাদের ডেপুটি কমিশনার জে এন উগরা যাচাই করে ১৪ ও ১৫ প্যারাকে জ্ঞানমতে সত্য ও প্যারা ১৬কে আংশিক সত্য ও বাকিটাকে আন্দাজ বলে নোট দেন।
অযোধ্যার দিগম্বরী আখড়ার মোহন্ত পরমহংস রামচন্দ্র দাস ২.১৯৫০ এর মতো একটি মামলা দায়ের করেন ( Suit No. 25 of 1950)।তিনি বিবাদী করেছিলেন উত্তরপ্রদেশ সরকার ও ফৈজাবাদের ডেপুটি কমিশনারকে এবং আবেদনে বলেছিলেন এই বিতর্কে রাজ্য সরকার ও ফৈজাবাদের ডেপুটি কমিশনারের হসগতক্ষেপের কোন অধিকার নেই ( ‘ Permanent and prohibitory order may be issued against the defendants that defendants no. 1 to 5 and 6 and 7 and their legal representatives etc. should never remove the idols of Bhagwan Ramchandraji etc. installed at Asthan Janma Bhumi whose description is given below from the place where they are and should not close its entrance door or other ways of ingress and agress and should not in any way obstruct or interefere in the Puja, Patha ND Darshan’ ) ।
রামচন্দ্র দাসের সবচে্য়ে বেশি অভিযোগ ছিল হাজি ফেংকুর বিরুদ্ধে। ৬৫ বৎসরবয়স্ক ফেংকু ছিলেন বহু সম্পত্তির মালিক, প্রতিপত্তিশালী। আদালতে তিনি বলেছিলেন ১৫২৮ সাল থেকে মুসলমানরা বাবরি মসজিদকে তাদের ধর্মকর্মের স্থান বলে জানে ।
ফৈজাবাদ প্রশাসনের কাজকর্মে বিরক্ত হয়ে নেহেরু সরকার বাবর-ই-মসজিদের মূল দরজায় তালা লাগিয়ে দেবার নির্দেশ দেন। নির্দেশ দেওয়া হয় পাশের দরজা দিয়ে কেবলমাত্র পুরোহিত ঢুকতে পারবেন। প্রিয়দত্ত রাম রিসিভার নিযুক্ত হয়ে মসজিদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি বিগ্রহের পুজোর জন্য চারজন পুরোহিত নিযুক্ত করেন। পুরোহিত ব্যতীত সাধারণ দর্শনার্থীর প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়। তালা লাগানোর প্রতিবাদে সিটি ম্যাজিস্ট্রেট গুরুদত্ত সিং পদত্যাগ করেন।
১৯৫১ সালের ৩ মার্চ ফৈজাবাদ জেলার সিভিল জজ সকলপক্ষের বক্তব্য শুনে ১৯,০১,৫০এর আদেশ বহাল রাখেন—‘The order to remain in force until the suit is disposed of’ . ওই সালের ৪ আগস্ট ২ ও ২৫/ ১৯৫০ মামলা দুটির বিবাদী জহুর আহম্মদসহ কয়েকজন মুসলমান এক আবেদনে জানান যে Cr, P.C এর Order 1, Rule 8 অনুযায়ী মামলাদুটিকে প্রতিনিধিত্ব মামলা হিসেবে ধরা হোক, যেহেতু বিতর্কিত সম্পত্তি
কারোর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। কিন্তু বাদী গোপাল সিং বিশারদ ( Suit No. 2/1950) রামচন্দ্র দাস ( Suit No. 25/ 1950) মুসলমানদের আবেদনের বিরোধিতা করেন। ১৯৫১ সালের ২৭ অক্টোবর ফৈজাবাদের সিভিল জজ বিবাদীদের আবেদন খারিজ করে দেন।
১৯৫৩ সালে ফৈজাবাদ সিটি ম্যাজিস্ট্রেটের দরবারে বাবর-ই-মসজিদ অঞ্চলে ১৪৪ ধারা জারি করার ব্যাপারটা পর্যালোচনা করা হয়। এটি প্রথম পুলিশ বনাম প্রশাসনের মামলা।
১৯৫৪ সালে মসজিদে তালা বন্ধ করার বিরুদ্ধে দশ হাজার মুসলমান সত্যাগ্রহ করেন।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct