রাজু আনসারী, অরঙ্গাবাদ, সজিবুল ইসলাম, মুর্শিদাবাদ, আপনজন: সংসারের হাল ধরতে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে মুর্শিদাবাদের হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক। বছরে পর বছর ধরে নিশ্চিন্তে ভিন রাজ্যে শ্রমিকের কাজ করলেও এখন আর তাদের জন্য নিরাপদ নয়। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি সেই বাস্তব সত্যতাকে প্রতিষ্ঠা করছে। তার উজ্জ্বল উদাহরণ প্রতিবেশী রাজ্য ওড়িশা। ওড়িশার বিভিন্ন জেলায় শুধুমাত্র ধর্ম পরিচয়ের কারণে মুর্শিদাবাদ মালদার পরিযায়ী শ্রমিকরা হেনস্থার শিকার হওয়ায় তারা নিজের রাজ্যে দলে দলে ফিরে আসছেন। আর আসার পরই তারা সংবাদমাধ্যমের কাছে শোনাচ্ছেন তাদের আতঙ্কে কাটানো দিনযাপনের কথা। মুর্শিদাবাদের প্রশাসনের তরফ থেকে ইতিমধ্যে তৎপরতার সঙ্গে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে ওড়িশায় থাকা মুর্শিদাবাদের পরিযায়ীদের। ওড়িশায় কোথাও মুর্শিদাবাদের পরিয়ায়ী শ্রমিকরা বিপদের মধ্যে পড়লে সে খবর প্রশাসনের কাছে এলে দ্রুত ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হচ্ছে বলে দাবি। এ সম্পর্কিত খবর পুলিশ প্রশাসনের দেওয়ার জন্য পরিযায়ী শ্রমিকদের পরিবারগুলির প্রতি বার্তা দেওয়া হচ্ছে বলেও জানা যাচ্ছে। তবে, ওড়িশা থেকে বাংলায় ফিরে আসা অব্যোহত থাকতে দেখা গেল মঙ্গলবারও। ওড়িশার সম্বলপুর থেকে ফিরে আসা কয়েকজন পরিযায়ী শ্রমিক এখন হাঁফ ছেড়ে বাঁচছেন বাড়ি ফিরে। জঙ্গিপুর মহকুমার সুতির মহিশাইল-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের আজাদ নগর বেলতলা গ্রামের বাসিন্দা বাশির সেখ ও গোলাপ সেখ ঘরে ফিরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও এখনও চরম হেনস্থার চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন। বাড়ি ফিরে সেই মর্মান্তিক ঘটনার শিকার হওয়া কাহিনী শোনালেন ‘আপনজন’-সাংবাদিককে। ২১ বছর বয়সি গোলাপ সেখ বাড়ির খরচ জোগাতে রাজমিস্ত্রির কাজের জন্য ওড়িশার পথে রওনা দিয়েছিলেন দিন পনেরো আগে। গোলাপ সেখ জানান, ১৭ তারিখ ট্রেনে সম্বলপুর স্টেশনে সকালে নামি। নামার সাথে সাথে একদল লোক এসে একে একে জিজ্ঞেস করতে থাকল মুসলিম কিনা। মুসলিম পরিচয় পেয়েই বলতে থাকল ‘হিন্দু লোককে মার কে আয়া’। তারপর অকথ্য গালিগালাজ করে সম্বলপুর স্টেশন থেকে মারতে মারতে বাইরের রাস্তায় নিয়ে গেল। সেখানে বসিয়ে রাখা হল। তাদের হাতে ছিল লাঠি। আর গায়ে ছিল জয় শ্রীরাম লেখা নামাবলি।
গোলাপ সেখ জানান, সেসময় প্রাণের ভয় করছিল। মারধরের পর ছেড়ে দেওয়া হলে পরের স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে বাড়ির পথে রওনা দিই। বাড়ি ফিরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। গোলাপ সেখের মতো নিগ্রহের শিকার ওই গ্রামেরই বাসিন্দা বাশির সেখ (২৮)। বাশির ‘আপনজন’-কে তার নির্মম অভিজ্ঞতার কথা শোনান। বাশির জানান, ওড়িশার কান্ধামাল জেলার গোচপদা এলাকার আদাবালি গ্রামে রাজমিস্ত্রির কাজে গেছিলেন দিন পনেরো আগে। বাশিরের অভিযোগ, তারা যখন রাজমিস্ত্রির কাজ করছিলেন তখন জনা পনেরো-ষোলোজন এসে বলতে থাকেন, তোরা মুসলিম, তোদেরকে মেরে ফেলব। তাদের হাতে ছিল পিস্তল, চাকু। বাশির জানান, তাদের ঘরে ছিল নির্মাণ সামগ্রী। তা থেকে রড বের করে তাদেরকে মাের। সেই সঙ্গে পিস্তল দেখিয়ে প্রাণে মারার হুমকি দেয়। আধার কার্ড চেক করে মুসলিম বলে চিহ্নিত করে। প্যান কার্ড ছোট থাকায় তা ছিঁড়ে ফেলে। এই ঘটনাটি ঘটে গত রবিবার রাতে। বাশির আরও জানান, তাকে কোমরে আর পায়ে আঘাত করা হয়। পায়ে এমন মারা হয় যে নিজে হাঁটতে পারছেন না। বাশির এখন তাই অন্যের ভর করে চলাফেরা করছেন। এই অবস্থাতেই মঙ্গলবার ওড়িশা থেকে বাড়ি ফিরেছেন।
ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের অনেকেই বলছেন তারা কেউ ২০ বছর কেউ বা ১৫ বছর ধরে কাজ করে আসছেন ওড়িশার বিভিন্ন জেলায়। কিন্তু এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিরি শিকার হতে হয়নি এর আগে।
ওড়িশায় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের শিকার হওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের সেখানে কাজে নিয়ে যাওয়া বহু ঠিকাদার এখন নিজের গ্রামে ফিরে আসছেন। (নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক) এক ঠিকাদার মহব্বত সেখ (নাম পরিবর্তিত) ‘আপনজন’কে জানান, মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরে হিংসতার খবর প্রচারের কারণে মুসলিম বিদ্বেষ চরম আকার নিয়েছে ওড়িশায়। তাই পরিযায়ী শ্রমিকরা আক্রান্ত হচ্ছে। তিনি জানান, তার অধীনে কাজ করতে যাওয়া মুর্শিদাবাদের পরিযায়ী শ্রমিকদের সবাই নিরাপদে বাড়ি ফিরেছেন। তিনিও সেখানে নিরাপদ বোধ না করায় আজ মঙ্গলবার রাতেই ট্রেন ধরে মুর্শিদাবাদের পথে রওনা দেবেন বলে ফোনে আপনজন প্রতিনিধিকে জানান। সব মিলিয়ে ওড়িশা থেকে এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা নিয়ে বাড়ি ফিরছেন মুর্শিদাবাদের পরিযায়ী শ্রমিকরা। কিন্তু ওড়িশার সেই নিগ্রহের আতঙ্ক এখনও তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাদেরকে।
তথ্য সহায়তা: আসিফ রনি
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct