ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হল মুসলিম জনসমাজ। এই জনসমাজের মুসলিম উদ্যোগপতিরা, দীর্ঘদিন ধরেই নানা ধরনের কাঠামোগত বৈষম্য, সামাজিক, রাজনৈতিক উপেক্ষা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতার শিকার হয়ে আসছেন। গবেষণায় উঠে এসেছে ভারতীয় মুসলিমদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে পিছিয়ে থাকার বাস্তবচিত্র। উচ্চশিক্ষা, পেশাগত দক্ষতা এবং কর্মসংস্থানে মুসলিমদের অংশগ্রহণ এখনো অন্যান্য সম্প্রদায়ের তুলনায় কম। লিখেছেন ড. নাজমুল হুসাইন।
ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হল মুসলিম জনসমাজ। এই জনসমাজের মুসলিম উদ্যোগপতিরা, দীর্ঘদিন ধরেই নানা ধরনের কাঠামোগত বৈষম্য, সামাজিক, রাজনৈতিক উপেক্ষা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতার শিকার হয়ে আসছেন। গবেষণায় উঠে এসেছে ভারতীয় মুসলিমদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে পিছিয়ে থাকার বাস্তবচিত্র। উচ্চশিক্ষা, পেশাগত দক্ষতা এবং কর্মসংস্থানে মুসলিমদের অংশগ্রহণ এখনো অন্যান্য সম্প্রদায়ের তুলনায় কম। মুসলিম উদ্যোগপতিদের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পেশাগত শিক্ষায় শিক্ষিত নয়। শিক্ষা ও দক্ষতার এই সীমাবদ্ধতা প্রত্যক্ষভাবে তাদের ব্যবসা শুরু ও পরিচালনায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।মুসলিম নারীদের অংশগ্রহণ তো আরও সীমিত। পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম উদ্যোগপতিদের জন্য এসব সমস্যার মাত্রা আরও গভীর, যেখানে ধর্মীয়, সামাজিক, এবং অর্থনৈতিক বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা তাদের সামনে আরও কঠিন পথ। পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম উদ্যোগপতিদের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং পেশাগত দক্ষতার অভাব স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। রাজ্যজুড়ে অনেক মুসলিম উদ্যোগপতি যারা ব্যবসা শুরু করতে চান, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও পেশাগত দক্ষতার অভাব স্পষ্ট। ছোট শহরে, যেখানে মুসলিম সম্প্রদায় অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে, পেশাগত শিক্ষা পাওয়া কঠিন। এর ফলে ব্যবসা শুরু ও টিকিয়ে রাখা চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে।
ব্যবসা শুরুর পথেও মুসলিম উদ্যোগপতিদের সামনে একাধিক চ্যালেঞ্জ কাজ করে। যাঁরা পরিবারে ব্যবসার ইতিহাস ছাড়াই প্রথম প্রজন্ম হিসেবে উদ্যোগপতি হচ্ছেন, তাঁদের প্রথম বাধা আসে পরিবার ও সমাজ থেকেই। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত মানসিক সমর্থন না পাওয়া, ব্যবসার মডেল নিয়ে সংশয়, ও নিরাপদ ভবিষ্যতের আশঙ্কা অনেককে শুরুতেই নিরুৎসাহিত করে তোলে। তার পরেও, শরিয়াত সম্মত পন্থায় ব্যবসা পরিচালনা করতে গিয়ে অনেক উদ্যোগপতি ব্যাংক ঋণ নিতে চান না, যার ফলে প্রাথমিক পুঁজি জোগাড়েও দারুণ কষ্ট হয়। ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষা করতে গিয়ে তাঁরা নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেন প্রচলিত আর্থিক ব্যবস্থার বাইরে, অথচ বিকল্প কোনো ইসলামী অর্থনৈতিক কাঠামোও ভারতীয় বাজারে কার্যকরভাবে উপস্থিত নেই।
সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতাও মুসলিম উদ্যোগপতিদের ক্ষেত্রে জটিল হয়ে উঠেছে। ২০১৪ সালের পর থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বৈষম্যের ঘটনা বেড়েছে এবং পশ্চিমবঙ্গও এর বাইরে নয়। অনেকেই সরকার, প্রশাসন ও অন্য ব্যবসায়িক গোষ্ঠী থেকে প্রতিকূল আচরণের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরবরাহকারী পণ্য দিতে অস্বীকার করেছেন শুধু মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার ব্যবসা বলেই। আবার ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানও তাদের ব্যবসা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় ক্রেডিট বা ঋণ দিতে অনিচ্ছুক থেকেছে। এসব ঘটনায় বোঝা যায়, ব্যবসায়িক দুনিয়াতেও এক ধরনের অস্পৃশ্যতা তৈরি হয়েছে, যার শিকার হচ্ছেন মুসলিম উদ্যোগপতিরা।
তবে প্রতিকূলতা এখানেই শেষ নয়। ব্যবসা শুরু করার চেয়ে সেটিকে টিকিয়ে রাখা যেন আরও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার সংখ্যাধিক্য, পুঁজির ঘাটতি, দক্ষ শ্রমিক না পাওয়া, আধুনিক প্রযুক্তির নাগাল না থাকা—এসব বাস্তব সমস্যা তো আছেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক ধাক্কাগুলো—নোটবন্দি, জিএসটি এবং কোভিড-১৯ মহামারির ধাক্কা। ফলে অনেক ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এবং উদ্যোগপতিদের অনেকেই আবার শুরু করার শক্তি বা সহায়তা পাননি। এক ব্যবসায়ী তাঁর অভিজ্ঞতা শেয়ার করে বলেছেন, “পুঁজি কম থাকায় মানসম্পন্ন মেশিন কিনতে পারিনি, উৎপাদনের গুণগত মানও কম ছিল। এতে বাজারে প্রতিযোগিতা টিকে থাকা সম্ভব হয়নি।”
এই প্রেক্ষাপটে এক নতুন ও উদ্বেগজনক বাস্তবতা হলো—মুসলিম উদ্যোগপতিরা তাঁদের নিজেদের সম্প্রদায় থেকেই প্রয়োজনীয় সমর্থন পাচ্ছেন না। অনেকে অভিযোগ করেছেন, মুসলিম গ্রাহকদের কাছ থেকেই তারা সময়মতো অর্থ ফেরত পান না, এমনকি কোনো কোনো সহকর্মী উদ্যোগপতি প্রতারণাও করেছেন, যার ফলে বৃহত্তর বাজারে মুসলিম ব্যবসায়ীদের সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে একটি আত্মঘাতী প্রবণতার জন্ম হচ্ছে—সম্প্রদায়ভিত্তিক সহযোগিতার সংস্কৃতি ভেঙে পড়ছে, যার ফলে মুসলিম ব্যবসায়ীরা আরও বেশি একা ও নির্ভরহীন হয়ে পড়ছেন।
সব ধরনের সীমাবদ্ধতার মাঝেও উদ্যোগপতিরা নানা কৌশলে নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখছেন। গ্রাহক সন্তুষ্টিকে অধিকাংশই মূলমন্ত্র হিসেবে দেখছেন। মান বজায় রাখা, সময়মতো ডেলিভারি, পণ্যে উদ্ভাবনী চিন্তা, এবং ডিজিটাল মাধ্যমে বিপণন—এই উপায়গুলো তাদের জন্য টিকে থাকার অস্ত্র হয়ে উঠেছে। অনেকে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে নতুন বাজারে প্রবেশ করেছেন, আবার কিছু উদ্যোগপতি আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রবেশের চেষ্টা করেছেন। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, ‘কম দামে পণ্য’ বা ‘সম্প্রদায়ের নেটওয়ার্ক’ ব্যবহারে আগ্রহ তুলনামূলক কম। এটি যেমন আত্মনির্ভরতার ইঙ্গিত দেয়, তেমনি পারস্পরিক সহযোগিতা না থাকার সংকেতও দেয়।
পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম নারী উদ্যোগপতিদের প্রসঙ্গে বলতে গেলে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে তাঁদের সামনে বাড়তি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত রক্ষণশীল মনোভাব, লিঙ্গভিত্তিক ভূমিকার প্রত্যাশা, এবং সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরীণ সামাজিক চাপের কারণে অনেক নারী ব্যবসায় প্রবেশে দ্বিধাগ্রস্ত হন। এছাড়াও, শিক্ষার অভাব, প্রযুক্তিগত দক্ষতার সীমাবদ্ধতা, এবং মূলধনের অপ্রতুলতা তাঁদের উদ্যোগী হওয়ার পথে বড় বাধা। যে মুসলিম নারীরা উদ্যোগপতি হিসেবে এগিয়ে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই ক্ষুদ্র পরিসরের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত, যেমন হস্তশিল্প (যেমন, জরি বা এমব্রয়ডারির কাজ), খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ (আচার, পাপড়, স্ন্যাকস), বা গৃহভিত্তিক সেলাই-বুনন। কিছু ক্ষেত্রে, তাঁরা স্থানীয় বাজার বা সামাজিক মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করেন, কিন্তু বৃহত্তর বাজারে প্রবেশ বা ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্থান ও নেটওয়ার্কিংয়ের অভাব থেকে যায়।
রাজ্য বা রাষ্ট্রীয় স্তরে বিশেষ করে মুসলিম নারী উদ্যোগপতিদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা বা প্রকল্প নেই। সাধারণ নারী ক্ষমতায়ন প্রকল্পগুলো (যেমন, SHG বা স্বনির্ভর গোষ্ঠী) কিছুটা সুযোগ দিলেও, মুসলিম সম্প্রদায়ের নারীদের জন্য সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংবেদনশীলতা বিবেচনায় বিশেষ কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। উদাহরণস্বরূপ, হালাল ব্যবসার সম্ভাবনা বা ইসলামিক ফাইন্যান্সের মাধ্যমে ঋণ সুবিধা এখনো তেমন প্রতিষ্ঠিত নয়। অথচ, মুসলিম নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন গোটা মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে। তাঁদের আয় পরিবারের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে । এছাড়া, এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক কুসংস্কার ভাঙতে সহায়ক হতে পারে।
আমাদের সামনে এই বাস্তবতা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোলে—কেন ভারতের বৃহত্তম সংখ্যালঘু জনসমাজের উদ্যোগপতিরা এখনো মূলধারার বাইরে? কেন তাদের উদ্যোগে বিনিয়োগ, সহযোগিতা বা প্রশিক্ষণের সুযোগ সীমিত? কেন তাদের জন্য শরিয়াত ভিত্তিক ফাইন্যান্সিং বা পৃথক ব্যবসায়িক পলিসি নেই? রাষ্ট্র যদি সত্যিই ‘সবকে সাত সবকে বিকাশ’-এর বার্তা দিতে চায়, তাহলে মুসলিম উদ্যোগপতিদের উন্নয়নের জন্য টেকসই পলিসির প্রয়োজন। পাশাপাশি, মুসলিম সমাজের মধ্যেও সম্প্রদায়িক সহযোগিতা, সম্মিলিত ব্যবসায়িক উদ্যোগ এবং শিক্ষা-প্রশিক্ষণের প্রতি গুরুত্ব না দিলে এই পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব নয়।
মুসলিম উদ্যোগপতিরা শুধুমাত্র একটি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি নন, বরং ভারতের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার অন্যতম। তাঁদের কণ্ঠস্বরকে যদি মূলস্রোতের অংশ করে তোলা যায়, যদি বৈষম্যের দেয়াল সরিয়ে দিয়ে ন্যায়সঙ্গত সুযোগ তৈরি করা যায়, তবে তারা শুধু নিজেদের নয়, পুরো দেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তি দিতে পারেন। তাই এখন সময় এসেছে মুসলিম উদ্যোগপতিদের স্বীকৃতি দেওয়ার, তাঁদের পথ মসৃণ করার এবং তাঁদের হাত ধরেই একটি সাম্যভিত্তিক ভারতের স্বপ্ন গড়ে তোলার।
(ভারতের মুসলিম উদ্যোক্তাদের পরিস্থিতি নিয়ে আবরার আলী সাইয়্যেদ লেখার উপর ভিত্তি করে লেখা)
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct