সম্প্রতি সংসদে পাস হওয়া ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন-২০২৫ এর বিরুদ্ধে গৃহীত প্রায় ৭৫টি আবেদনের উপর দুইদিন ধরে সুপ্রিম কোর্টে শুনানি হয়। ১৭ এপ্রিল বৃহস্পতিবার শুনানি শেষে আদালত এক সপ্তাহের মধ্যে সরকারের কাছে জবাব তলব করেছে। পরবর্তী শুনানি অনুষ্ঠিত হবে ৫মে। লিখেছেন আ ফ ম ইকবাল।
স ম্প্রতি সংসদে পাস হওয়া ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন-২০২৫ এর বিরুদ্ধে গৃহীত প্রায় ৭৫টি আবেদনের উপর দুইদিন ধরে সুপ্রিম কোর্টে শুনানি হয়। ১৭ এপ্রিল বৃহস্পতিবার শুনানি শেষে আদালত এক সপ্তাহের মধ্যে সরকারের কাছে জবাব তলব করেছে। পরবর্তী শুনানি অনুষ্ঠিত হবে ৫মে। সিনিয়র এডভোকেট কপিল সিব্বাল এবং অভিষেক মনুসিংভি আইনের বিরুদ্ধে দায়ের করা আবেদনগুলোর উপর যুক্তি তুলে ধরেন। আর সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা। উভয় পক্ষের মধ্যকার তর্কবিতর্ক এবং বিচারকদের জিজ্ঞেস করা প্রশ্ন এবং হস্তক্ষেপের মাধ্যমে উদ্ভূত বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, এই আইনটি ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর এক বড় আক্রমণ। সেইসঙ্গে সংবিধানের মৌলিক নীতি, বিশেষ করে সাম্য ও নাগরিক অধিকারের উপর এক বড় আঘাত। অত্যন্ত বিতর্কিত এই আইনের বৈধতার প্রশ্নে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত যাই হোক না কেন, আদালতের জেরা থেকে একথা স্পষ্ট যে, সংশোধিত ওয়াকফ আইন গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক ব্যবস্থায় বিশ্বাসীদের সন্তুষ্ট করতে পারে না।
বুধবার, প্রথমদিনের শুনানির সময় প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না, বিচারপতি সঞ্জয় কুমার এবং বিচারপতি কে,ভি, বিশ্বনাথনের বেঞ্চ যখন শুনানি শুরু করে, প্রথমেই অ্যাডভোকেট সিব্বাল এই আইনের অনেক অসঙ্গতি তুলে ধরেন। তিনি এটাকে ২০ কোটি মানুষের স্বাধীনতা ও অধিকার হরণকারী আইন বলে আখ্যা দিয়ে বলেন, এটা ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ধর্মীয় বিষয়ে ব্যবস্থাপনার যে স্বাধীনতা সংবিধান নিশ্চিত করেছে, তার পরিপন্থী। আইনের ধারা ৩৬ -এর উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, কোনো সম্পত্তি না থাকলেও কেউ ওয়াকফ করতে পারে, এবং ওয়াকফ রেজিস্ট্রি করা হবে কিনা, তা নির্ভর করে ওয়াকফকারী ব্যক্তির উপর। আইনে ওয়াকফ রেজিস্ট্রেশনের বাধ্যবাধকতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওয়াকফের সৃষ্টি হয়েছে শত শত বছর আগে, যখন সম্পত্তি রেজিস্ট্রেশনের কোনো ব্যবস্থা ছিলই না। তখন প্রধান বিচারপতি নিজেই সলিসিটর জেনারেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন যে, ১৩ থেকে ১৫ শতকে অনেক মসজিদ নির্মিত হয়েছে। বৃটিশ শাসনামলেরও আগে, যখন রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা ছিল না, সুতরাং ওই ওয়াকফগুলোর দলিল কিভাবে দেখানো সম্ভব ? অপর আইনজীবী হুযাইফা আহমদি বলেন, সরকার আইনের ধারা ৩-এর মাধ্যমে ওয়াকফ এর পরিভাষাই পাল্টে দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে আইনের মাধ্যমে বলা হয়েছে, ওয়াকফ করার জন্য ওয়াকিফ যে ইসলামে বিশ্বাসী, তা অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে। তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘যখন কেউ জন্মসূত্রে মুসলমান, তাহলে তার আস্থার প্রমাণ করার দরকার হবে কেন ?’
প্রথমদিন বুধবার শুনানির সময় সিজেআই নিজেই জিজ্ঞেস করেন যে, সরকার যদি মুসলিম ট্রাস্টে অমুসলিম সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করতে চায়, তাহলে হিন্দু ট্রাস্ট সমুহে কি মুসলিমদের জায়গা দেয়া হবে ? এর জবাবে তুষার মেহতার উত্তর ছিল হাস্যকর এবং পলায়নমুখি। তিনি বলেন, ট্রাস্টে অ-হিন্দু সদস্য থাকতে পারেন, অথবা নাও থাকতে পারেন। এই ইস্যুতে তুষার মেহতার একটি মন্তব্য ছিল ভীষন অপ্রীতিকর, যা শোনার পর সিজেআইকে একপ্রকার রাগান্বিত হয়েছিলেন বলেই মনে হয়েছে। এসজি বলেন, সেই হিসেবে তো এই বেঞ্চও এই মামলার শুনানি গ্রহণ করতে পারে না, যেহেতু বেঞ্চে কোনো মুসলিম সদস্য নেই। সিজেআই খান্না তখন বলেন, আদালতের বিচারকরা যখন কোনো ধর্মীয় বিরোধ নিয়ে শুনানি গ্রহণ করেন, তখন তারা ব্যক্তিগত ধর্মীয় বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে উঠে, কেবল আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মাননীয় উচ্চতম আদালতের বিচারকদের সম্পর্কে সলিসিটর জেনারেলের এভাবে ব্যক্তিগত মন্তব্য করার মাধ্যমে একথাই ফুটে উঠে যে, মামলাটি কত দুর্বল ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে, সে সম্পর্কে তিনি নিজেও সচেতন।
যাই হোক, সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ বলেছে যে, কোনো সম্পত্তি ওয়াকফ কি না, সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার দেওয়ানি আদালতকে প্রদান করাই উত্তম। কিন্তু, নতুন ওয়াকফ আইনে এই অধিকার তুলে দেয়া হয়েছে জেলা কালেক্টরের হাতে। যখন এসজি মেহতা বলেন যে, ১৯২৫ সালের আগেকার ওয়াকফ বাই ইউজারকেও স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। তখন বেঞ্চ তাঁকে জিজ্ঞেস করে যে, নতুন আইনের অধীনে এসব ওয়াকফ সম্পত্তি ডি-কোড বা বাতিল বলে বিবেচিত হবে কিনা ? এসজি এর সন্তোষজনক কোনো উত্তর দিতে পারেন নি। এতেই প্রমাণিত হয় যে, সরকার পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়াই এই বিলটি এনেছে, আইনে পরিণত করেছে। সরকার যেমন সংসদে দাবি করছিল, এই আইনের উদ্দেশ্য মুসলমানদের ওয়াকফের মাধ্যমে সুবিধা প্রদান করা, যা বাস্তবে কোথাও প্রতিফলিত হয় না।
সরকার এবং ভারতীয় জনতা পার্টি যেভাবে রেল ও সেনাবাহিনীর পর ওয়াকফের হাতে সর্বাধিক জমি রয়েছে বলে প্রচার করছে, তাতে একথাই মনে হয় যে, সরকারের চোখ ওয়াকফের জমির উপর নিবদ্ধ হয়ে আছে, এবং তা হড়প করার লক্ষ্যে সংশোধিত ওয়াকফ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। ওয়াকফ বাই ইউজার এই আইনের সবচেয়ে সূক্ষ্ম বিষয়। অনেক ওয়াকফ সম্পত্তি দির্ঘদিন, এমনকি কয়েক শতাব্দী ধরে ধর্মীয় উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে, কিন্তু রেজিস্ট্রেশন করা হয় নি। নতুন আইনের মাধ্যমে সরকার তা সহজেই নিয়ে নিতে পারে। যদিও বিষয়টি সকল ধর্মের (হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ) সম্পত্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, কিন্তু মুসলমানদের ধর্মীয় ট্রাস্টের সঙ্গে এই বিধান জুড়ে দিয়ে সরকার প্রমাণ করছে যে, এই আইনের উদ্দেশ্য কেবল সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ছাড়া আর কিছু নয়।
ওয়াকফ আইন-২০২৫ এর পরবর্তী শুনানির তারিখ ধার্য করতে গিয়ে দেশের প্রধান বিচারপতি নির্দেশ দিয়েছেন যে, এই মামলার শুনানি শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিল এবং রাজ্যিক বোর্ডগুলোতে কোনপ্রকার নিয়োগ করা যাবে না। বেঞ্চ আরও বলে যে, এতগুলো পিটিশনের পৃথক পৃথক শুনানি সম্ভব নয়। তাই আদালত মাত্র ৫টি পিটিশনের উপর শুনানি গ্রহণ করবে। অবশিষ্ট পিটিশন ডিসপোজড অফ বলে ধরে নেয়া হবে।
উল্লেখ্য যে, ২০২৪-এর ৮ আগস্ট কেন্দ্রীয় সরকার লোকসভায় ওয়াকফ সংশোধনী বিল-২০২৪ পেশ করেছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল ওয়াকফ অ্যাক্ট, ১৯৯৫ সংশোধন করে ওয়াকফ সম্পত্তিতে স্বচ্ছতা এবং সুব্যবস্থা আনয়ন করা। ওয়াকফ আইন ১৯২৩ বাতিল করার প্রস্তাবও রয়েছে। সংসদের ভেতরে এবং বাইরে তখন থেকেই প্রস্তাবিত ওয়াকফ সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে জোরালো আপত্তি তুলে ধরা হয়েছিল। লোকসভায় একদিনের আলোচনার সময় বিরোধীপক্ষের প্রবল আপত্তির মুখে বিলটি যৌথ সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। জেপিসিতে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার ফলে এবং সরকার পক্ষের সদস্যদের নানা ধরনের হঠকারিতার জন্য বিরোধী দলীয় সদস্যদের সকল সুপারিশ উপেক্ষা করা হয়। জেপিসি-তে মোট ৪৪টি সংশোধনী সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু কমিটি কেবলমাত্র সরকার পক্ষের সদস্যদের উত্থাপন করা ১৪টি সংশোধনী গ্রহণ করে সরকারের কাছে রিপোর্ট জমা করে দেয়। এই মাসের ৩ ও ৪ তারিখে বিলটি যথাক্রমে লোকসভা এবং রাজ্যসভায় পাস হয়৷ এবং অব্যবহিত পরই মহামহিম রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভের পর গ্যাজেট নোটিফিকেশন জারি করা হয়।
মুসলিম সংগঠনগুলো এবং প্রায় সকল বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ নতুন সংশোধনী আইনের বিরোধিতা করে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে। আশা করা যায়, মামলাটিকে কেবল সংখ্যালঘুদের স্বাধীনতা সুরক্ষার প্রশ্ন হিসেবে নয়, বরং সংবিধানের মূল কাঠামোর সংরক্ষণের বিষয় হিসেবে বিবেচনা করে সদর্থক রায় প্রদান করা হবে।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct