আপনজন ডেস্ক: গাজা উপত্যকা একটি সংকীর্ণ ভূখণ্ড; যার আকাশজুড়ে প্রতিনিয়ত ঘুরছে যুদ্ধবিমান আর ভূমিতে ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন। এখানকার প্রতিটি রাত যেন একেকটি দুঃস্বপ্নের নামান্তর, যেখানে মানুষ ঘুমাতে যাওয়ার আগে নিশ্চিত না—পরের ভোর দেখবে কিনা। গাজায় রাত আসার মানে হলো অজানা ধ্বংসযজ্ঞের আরেকটি অধ্যায় শুরু। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের পরিবেশ বদলে যায়। শিশুদের চোখে ভয়, মায়েদের মনে দুশ্চিন্তা, আর পুরুষদের মুখে দায়িত্ব আর বাঁচার লড়াই। সাধারণ মানুষের জন্য রাতের সময়টা হয়ে উঠে ভয়ানক ও অবিরাম যন্ত্রণার—কারণ কেউই নিরাপদ নয়, না নিজের ঘরে, না অস্থায়ী তাঁবুতে, না শরণার্থী ক্যাম্পে। গাজার নাগরিকরা মনে করেন, সময় যত গড়াচ্ছে পরিস্থিতি ততই হতাশাজনক হয়ে উঠছে, জীবনযাপন কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে এবং তারা যেভাবে এই অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছিলেন, সেই সহ্যশক্তিও এখন ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। তারা জানিয়েছেন যে, তারা এমন এক নজিরবিহীন উত্তেজনা ও মানবিক সংকট প্রত্যক্ষ করছেন যা তারা আগে কখনো দেখেননি।
গাজার বাসিন্দারা জানেন না, পরবর্তী হামলা কখন হবে এবং তাদের কোনো ধারণা নেই যে এই যুদ্ধবিরতির আলোচনা ভবিষ্যতে আদৌ কোনো ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে কি না। স্থানীয় বাসিন্দা ফাতেমা বলেন, আমার ৭ বছরের ছেলেকে নিয়ে ঘুমানোর সময় এখনো আমার বুকের উপর তার মাথা রেখে ঘুমোতে হয়। বোমার শব্দে সে কেঁপে উঠে আর জিজ্ঞেস করে, মা; আজও কি আমরা বাঁচব?
রাত হলেই যুদ্ধবিমানের শব্দ, ড্রোনের গুঞ্জন, হঠাৎ করে আলোকচ্ছটা আর তার পরেই বিস্ফোরণ—এই চিত্র যেন সাধারণ হয়ে উঠেছে। ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, পরিবার হারাচ্ছে প্রিয়জন, স্কুলগুলো পরিণত হয়েছে শরণার্থী শিবিরে। জাতিসংঘ পরিচালিত স্কুল বা সেল্টারগুলোতেও রাতের নিরাপত্তা নেই। অনেক সময় লক্ষ্যবস্তু হয়ে পড়ে সেগুলোও। যে শিবিরে হাজার হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে, সেখানে একটিমাত্র বাথরুম, অল্প খাবার আর সীমিত জল সবকিছুই চরম সংকটের নাম। রাফাহ থেকে পালিয়ে আসা ৬০ বছরের ওমর সাহেব বলেন, আমরা ভেবেছিলাম এখানে এসে অন্তত একটু শান্তিতে রাত কাটাতে পারব, কিন্তু ড্রোন তো এখানেও ঘুরে। রাতে চোখ বন্ধ করলেই মনে হয়, এবার বুঝি আমাদের পালা। এদিকে বোমাবর্ষণের কারণে বহু অঞ্চলে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন। ইন্টারনেট নেই, মোবাইল নেটওয়ার্কও ধ্বংসপ্রাপ্ত। রাতের অন্ধকার যেন দ্বিগুণ হয়ে পড়ে এই প্রযুক্তি বিচ্ছিন্নতায়। কেউ আর জানতে পারে না আশেপাশে কী ঘটছে।
প্রতিটি পরিবার তখন আল্লাহর ওপর ভরসা করে একে অপরকে জড়িয়ে থাকে। আশেপাশে কি কেউ আহত হয়েছে, কোথায় বোমা পড়েছে, কারা মারা গেছে—এই তথ্য পেতে ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। আর এসব হামলায় যেসব মানুষ রাতে আহত হন, তাদের অনেকেই হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না। যেসব হাসপাতাল এখনো সচল, সেগুলো রোগীতে উপচে পড়ছে। ওষুধের ঘাটতি, চিকিৎসক সংকট এবং জেনারেটর চালাতে জ্বালানির অভাব—সব মিলিয়ে যেন মৃত্যু কেবল সময়ের ব্যাপার। একজন চিকিৎসক বলেন, রাতের বেলা আমরা একসঙ্গে ৩০-৪০ জন আহতকে পাই। কার আগে কার চিকিৎসা করব—তা বোঝাই দায়। অনেক সময় কেবল বাঁচানোর চেষ্টা করেও হেরে যেতে হয়। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর বাস্তবতা হলো—গাজার শিশুদের শৈশব আর স্বাভাবিকতা বলতে কিছুই নেই। রাত মানেই তাদের কাছে কান্না, বোমার শব্দ, দুঃস্বপ্ন। খেলাধুলার বদলে তারা শিখে নিচ্ছে কিভাবে বেঁচে থাকতে হয়, কিভাবে আশ্রয় নিতে হয়, কিভাবে মৃতদেহ দেখলেও শক্ত থাকতে হয়।
জাতিসংঘের শিশু সংক্রান্ত সংস্থা ইউনিসেফ জানিয়েছে, গাজায় প্রতি রাতে শত শত শিশু মানসিক ট্রমায় ভুগছে। যাদের কেউ কেউ কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে, কেউ কেউ আবার ঘুমানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। এদিকে গাজার মসজিদগুলো এখন কেবল নামাজের জায়গা নয়, বরং আশ্রয় কেন্দ্র। রাতের অন্ধকারে বহু পরিবার সেখানে এসে ঠাঁই নেয়, যেন পবিত্র স্থান তাদের একটু হলেও সুরক্ষা দেবে। সেখানে দলবদ্ধভাবে প্রার্থনা, কান্না আর আল্লাহর কাছে মুক্তির মিনতি—এই চিত্র প্রতিনিয়ত দেখা যায়।
এমনি একটি মসজিদের একজন ইমাম জানান, মানুষ এখন দোয়ার মধ্যে আশ্রয় খুঁজছে। প্রতিদিনই নতুন কেউ মারা যায়, তাই রাতে আমরা মাইকে কোরআন তেলাওয়াত চালিয়ে যাই। এতে কিছুটা হলেও শান্তি আসে মানুষের মনে।
যদিও আন্তর্জাতিক সাহায্য আসে, তবে সেটা দিনে সীমিত পরিমাণে। রাতে কনভয় বন্ধ থাকে নিরাপত্তাজনিত কারণে। ফলে রাতের যেকোনো বিপর্যয়ে নিজেকেই নিজের সাহায্য করতে হয়। অনেক সময় মানুষ নিজের পরিবারের মৃতদেহ পর্যন্ত রাতভর ঘরের মধ্যে রাখে, কারণ বের হওয়া মানেই প্রাণ হারানোর ঝুঁকি।
গাজার মানুষগুলো এখন এই যুদ্ধকে দেখছে অস্তিত্বের লড়াই হিসেবে। তারা জানে না আর কতদিন এভাবে চলবে, কিন্তু তবুও প্রতিটি রাত পার করার মানে তাদের কাছে একেকটা বিজয়। বিশ্বজুড়ে সমর্থন, প্রতিবাদ, বিবৃতি—সব কিছুই পৌঁছাতে দেরি করে। কিন্তু গাজার জন্য প্রতিটি রাত, প্রতিটি মুহূর্ত হলো সত্যিকারের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct