আপনজন ডেস্ক: সাত বছর আগে মেটার প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ প্রথমবারের মতো মার্কিন কংগ্রেসে সাক্ষ্য দেন। আইনজীবীদের তত্ত্বাবধানে দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের পর তিনি দুই দিনে পর পর তিনটি শুনানিতে অংশ নেন, যা ছিল তার জন্য একধরনের কঠিন পরীক্ষার মতো।
৪০ বছর বয়সী জাকারবার্গ তার পর থেকে আরো বেশ কিছুবার এমন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে গেছেন। কংগ্রেসে তিনি আটবার এবং আদালতে অন্তত দুইবার সাক্ষ্য দিয়েছেন, যা বড় প্রযুক্তি কম্পানিগুলোর অন্য যেকোনো নির্বাহীর চেয়ে বেশি।
গোপনীয়তা, শিশু নিরাপত্তা ও ভুল তথ্য ছড়ানোর মতো নানা ইস্যুতে তিনি বহুবার তার কম্পানির পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। সোমবারের মধ্যেই জাকারবার্গ আবারও সাক্ষ্য দিতে যাচ্ছেন, এবার একটি ঐতিহাসিক অ্যান্টিট্রাস্ট (একচেটিয়াবিরোধী) মামলায়, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ট্রেড কমিশন (এফটিসি) মেটার বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একচেটিয়া আধিপত্য বজায় রাখতে ‘কিনে নাও বা ধ্বংস করে দাও’ কৌশলের অভিযোগ এনেছে। অভিযোগ অনুযায়ী, মেটা ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ অধিগ্রহণ করে এই কৌশল প্রয়োগ করেছে। জাকারবার্গের ধারাবাহিক সাক্ষ্য এখন প্রযুক্তি জগতের ওপর ওয়াশিংটনের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভের প্রতীক হয়ে উঠেছে এবং প্রযুক্তিশিল্পকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার প্রচেষ্টায় ইন্ধন জুগিয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে প্রযুক্তি কম্পানির নির্বাহীরা হোয়াইট হাউসের সান্নিধ্য কামনা করলেও তার নিযুক্ত কর্মকর্তারা এখনো কড়া নজরদারি অব্যাহত রেখেছেন।
কংগ্রেসে আইন প্রণেতারা বারবার জাকারবার্গের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার ও সামাজিক ক্ষতির জন্য ব্যক্তিগতভাবে দায়ী থাকার অভিযোগ তুলেছেন। তবে আগের কঠিন অভিজ্ঞতাগুলো এফটিসি মামলায় তার সাত ঘণ্টার সাক্ষ্যকে কিছুটা সহজ করতে পারে বলে আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। স্ট্যানফোর্ড ল স্কুলের অ্যাসোসিয়েট ডিন অ্যাডাম স্টার্লিং বলেন, ‘আগের তুলনায় এখন তিনি ভালো করেই জানেন কাদের উদ্দেশে কথা বলছেন—সে আপনি আদালতে হন, কংগ্রেসে বা অন্য কোথাও। তিনি এখন বার্তা পৌঁছনোর কৌশল রপ্ত করেছেন।’ মেটা ও এফটিসি—দুই পক্ষই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এই পরিস্থিতি অনেক দূরে জাকারবার্গের সেই শুরুর সময় থেকে, যখন তিনি হার্ভার্ডের ছাত্রাবস্থায় ‘দ্য ফেসবুক’ গড়ে তোলেন এবং এরপর স্কুল ছেড়ে সিলিকন ভ্যালিতে পাড়ি জমান।
তার সাফল্য যেমন আলোচনায় এসেছে, তেমনি ব্যর্থতাও ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে। ২০২১ সালে তিনি কম্পানির নাম বদলে মেটা রাখেন, অতীতের কিছু নেতিবাচক ইমেজ ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা হিসেবে।
সম্প্রতি তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করেছেন, এমনকি এফটিসি মামলা নিষ্পত্তির জন্য হোয়াইট হাউসে গিয়ে আলোচনাও করেছেন।
এই সরকারি তদন্ত ও মামলাগুলো মেটার ওপর দীর্ঘ মেয়াদে কোনো বড় আঘাত হানেনি। কংগ্রেসে জাকারবার্গের প্রথম সাক্ষ্যের পর থেকে কম্পানির শেয়ারদর দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে।
তবে এই অ্যান্টিট্রাস্ট মামলায় তার সময় আরো কঠিন হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন। কংগ্রেস শুনানিতে আইন প্রণেতারা বেশির ভাগ সময় নাটকীয়তা দেখান এবং তাদের সময়সীমা সীমিত থাকে। বিপরীতে এফটিসি আইনজীবীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন এবং তাদের হাতে রয়েছে জাকারবার্গের বহু ই-মেইল ও যোগাযোগ—যেগুলো তারা কম্পানির ‘খারাপ উদ্দেশ্য’ প্রমাণে ব্যবহার করতে চান।
ফোর কর্নার্স পাবলিক অ্যাফেয়ার্সের উপদেষ্টা ও মেটার সাবেক নীতিনির্ধারক নিউ ওয়েক্সলার বলেন, ‘আদালতের পরিবেশ একেবারেই আলাদা—প্রতিপক্ষের আইনজীবীরা প্রস্তুত থাকেন, ভালো প্রশ্ন করেন এবং মামলার বিষয়বস্তুর ওপর কেন্দ্রীভূত থাকেন।’
২০১৭ সালে জাকারবার্গ ডালাসে একটি শুনানিতে সাক্ষ্য দেন, যেখানে ভিডিও গেম কম্পানি জেনিম্যাক্স মিডিয়া তাদের ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি চুরির অভিযোগ এনেছিল। ২০২৩ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার সান হোসেতে তিনি আবারও সাক্ষ্য দেন মেটার ভার্চুয়াল রিয়ালিটি কম্পানি উইদিন অধিগ্রহণ ঠেকাতে এফটিসির আরেকটি মামলায়।
তবে এইবার পরিস্থিতি আরো জটিল। কারণ এফটিসি চায় আদালত মেটাকে অ্যান্টিট্রাস্ট (একচেটিয়াবিরোধী) আইন লঙ্ঘনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করুক। ফলে ‘এখানে অনেক বেশি ঝুঁকি রয়েছে’ বলে মনে করেন অ্যাংকর চেঞ্জ কনসালটিংয়ের সিইও ও মেটার সাবেক নীতিনির্ধারক কেটি হারব্যাথ। মেটার ইতিহাসের প্রথম ভাগে জাকারবার্গ কখনোই খোলামেলাভাবে জনসমক্ষে কথা বলতেন না। ২০১০ সালে একটি টেক কনফারেন্সে গোপনীয়তা নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে ঘামতে থাকা অবস্থায় তিনি জবাব দিতে হিমশিম খেয়েছিলেন। তার বেশির ভাগ সাক্ষ্য কংগ্রেসেই হয়েছে।
২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর ওয়াশিংটনের তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়েন জাকারবার্গ। জানা যায়, ফেসবুক রাজনৈতিক পরামর্শদাতা সংস্থা কেমব্রিজ অ্যানালিটিকাকে ব্যবহারকারীদের ডেটা দিয়ে দিয়েছিল, তাদের সম্মতি ছাড়াই। এর জেরে ২০১৮ সালের এপ্রিলে কংগ্রেসের জনাকীর্ণ শুনানিতে হাজির হন জাকারবার্গ। মেটার কর্মীদের মতে, আইনজীবীরা তাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন কিভাবে বিরতি সহ্য করতে হবে এবং কঠিন প্রশ্নে উত্তরের সময় বিলম্ব করতে হবে।
সে সময় তিনি বহুবার বলেছিলেন, ‘আমার দল আপনাকে পরে জানাবে।’
পরের বছর তিনি হাউস ফিন্যানশিয়াল সার্ভিসেস কমিটিতে ফেসবুকের ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রকল্প ‘লিব্রা’ নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হন। তখন ডেমোক্র্যাট প্রতিনিধি আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্তেজ তাকে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনে ভুল তথ্য নিয়ে প্রশ্ন করেন এবং মাঝেমধ্যে বাধা দেন। জাকারবার্গ তখন কিছুটা অস্বস্তিতে পড়েন এবং সঠিক উত্তর খুঁজে পেতে বেগ পান।
কমিটির তৎকালীন ডেমোক্র্যাটিক চেয়ার ম্যাক্সিন ওয়াটার্স অভিযোগ করেন, জাকারবার্গ কম্পানির লাভের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী, নারী, সংখ্যালঘু, এমনকি গণতন্ত্রকেও পদদলিত করছেন। জাকারবার্গ তখন বলেন, ‘আমি জানি, এই মুহূর্তে আমি আদর্শ বার্তাবাহক নই। আমাদের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে অবশ্যই আরো কাজ করতে হবে।’
পরবর্তী দুই সাক্ষ্যে জাকারবার্গ অনেক বেশি পরিপক্ব ও আত্মবিশ্বাসী ছিলেন বলে জানান আইনি বিশ্লেষক ও সাবেক কর্মীরা। ২০২০ সালে কভিড মহামারির মধ্যে হাউস জুডিশিয়ারি কমিটির সামনে অ্যাপল, অ্যামাজন ও গুগলের সিইওদের সঙ্গে তিনিও হাজির হন। ২০২১ সালে তিনি টুইটার ও গুগলের প্রধানদের সঙ্গে ভুল তথ্য নিয়ে শুনানিতে অংশ নেন।
এ ছাড়া গত বছর শিশু নিরাপত্তা নিয়ে এক শুনানিতে মিসৌরির রিপাবলিকান সিনেটর জশ হাওলি জাকারবার্গকে শিশু আত্মহত্যা ও অনলাইন বুলিংয়ের শিকার পরিবারগুলোর কাছে ক্ষমা চাইতে বলেন। জাকারবার্গ বলেন, ‘আপনারা যা সহ্য করেছেন, তার জন্য আমি দুঃখিত। কারো এমন কিছুর মধ্যে দিয়ে যাওয়া উচিত নয়।’
হাওলি জানান, মেটা ও জাকারবার্গকে জবাবদিহির মুখে আনা ছিল তার মূল লক্ষ্য। তিনি বলেন, ‘আমি চেয়েছিলাম সত্য প্রকাশ পাক। কিন্তু সত্য হচ্ছে, তিনি ঠিকই এগিয়ে যাচ্ছেন এবং যাবেন, যতক্ষণ না কংগ্রেস বা আদালতের পক্ষ থেকে প্রকৃত কোনো শাস্তি না আসবে।’
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct