সারিউল ইসলাম, মুর্শিদাবাদ, আপনজন: মুর্শিদাবাদের সুতি, ধুলিয়ান তথা সামশেরগঞ্জে অশান্তির ঘটনায় বহিরাগতদের ভূমিকা নিয়ে উঠেছে গুরুতর অভিযোগ। সোমবার ‘আপনজন’-এ প্রকাশিত ‘বহিরাগত শক্তির’ তত্ত্বকে সিলমোহর দিল তৃণমূল কংগ্রেস। উল্লেখ্য, শুক্রবার দুপুর থেকে সুতি, সামশেরগঞ্জ তথা ধুলিয়ানে শুরু হওয়া ওয়াকফ আইন বিরোধীতায় সহিংসতা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। শনিবার রাত পর্যন্ত পরিস্থিতি কার্যত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ঘটনায় বেসরকারি মতে মৃত্যু হয়েছে ৩ জনের, যদিও প্রশাসনিক ভাবে তা জানানো হয়নি। রাজ্য পুলিশের বিশেষ দলের পাশাপাশি বিএসএফ নামানো হয় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য। রবিবার সকাল থেকে ওই এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি। সোমবার সকাল থেকে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। বাজার-হাট খুলছে, রাস্তায় নেমেছে মানুষ, যান চলাচল বাড়ছে। রাজ্য পুলিশের এডিজি আইনশৃঙ্খলা জাভেদ শামীম বলেন, “পাশের রাজ্য থেকে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। গুজবে কান না দিয়ে প্রশাসনের উপর আস্থা রাখতে আবেদন জানানো হচ্ছে মানুষকে।” তিনি আরও বলেন, “যারা এই হিংসায় জড়িত তাঁদের পাতাল থেকে হলেও খুঁজে বের করে আইনের আওতায় এনে যথোপযুক্ত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” অন্যদিকে সোমবার সকাল থেকেই সুতি-ধুলিয়ান তথা সামশেরগঞ্জের পরিস্থিতি স্বাভাবিকের পথে বলে দাবি করেন অল ইন্ডিয়া ইমাম মুয়াজ্জিন অ্যান্ড সোশাল ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশনের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক। তিনদিন ধরে সেখানে পরিস্থিতি দেখার পর সোমবার সন্ধ্যায় তিনি বলেন, “কিছু গণমাধ্যম যেভাবে গুজব ছড়াচ্ছে তাতে মানুষের মনে আতঙ্ক কাজ করছে।” এখনো পর্যন্ত ১৬ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, হামলাকারীরা বাইরের লোক, যাদের বেশিরভাগের বয়স ১৪ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। তাদের কারও পরনে ছিল বিএসএফের পোশাক। কিন্তু পায়ে ছিল সাধারণ জুতো, যা সন্দেহ আরও বাড়িয়ে তুলেছে। দুই মহিলা বাসিন্দার চোখেমুখে এখনও আতঙ্ক। কাঁদতে কাঁদতে তারা বলেন, “ওরা বাড়িতে ঢুকে আমাদের মারধর করে, ছেলেদের ধরে নিয়ে যায়, জিনিসপত্র লুট করে নেয়। সবাই অচেনা, মুখ ঢাকা।”
তৃণমূল কংগ্রেস দাবি করেছে, এটি বিজেপির সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। দলের আইটি সেলের রাজ্য সভাপতি দেবাংশু ভট্টাচার্য ভাইরাল হওয়া একটি মেসেজের কথা উল্লেখ করেন, যেখানে ‘ছোট বস’ ও ‘বড় বস’-এর নির্দেশে এই হামলা সংগঠিত হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। বিজেপির বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা পুরনো হিংসার ছবি বাংলা প্রসঙ্গ বলে ছড়িয়েছে, পরে তা মুছেও দিয়েছে।
এদিকে সোমবার রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর এক মন্তব্যে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়েছে। তিনি বলেন, “বাংলাদেশি স্টাইলে লুঠ হয়েছে।” এই বক্তব্যকে নিশানা করে তৃণমূলের কুনাল ঘোষ প্রশ্ন তুলেছেন, “সীমান্ত পেরিয়ে দুষ্কৃতীরা এলে বিএসএফ কী করছিল? সীমান্তরক্ষার দায়িত্ব তো তাঁদের, তবে এই গাফিলতির দায় কার?”
অশান্তির ঘটনার প্রেক্ষাপটে কার্তিক মহারাজের সফরকে ঘিরেও প্রশ্ন উঠছে। রামনবমীর আগে তিনি ৩রা এপ্রিল সুতির অরঙ্গাবাদে মিছিল করেন। রাজনৈতিক মহলের মতে, এই সফর ও উত্তেজনার মাঝে সময়গত সংযোগ অস্বাভাবিক নয়। পাশাপাশি, আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের ফেব্রুয়ারির পূর্বাঞ্চলীয় সফরকেও কারণ হিসেবে দেখছেন অনেকে।
উত্তেজনার পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার নিজে এসেছিলেন। এডিজি দক্ষিণবঙ্গ সুপ্রতিম সরকার মুর্শিদাবাদে থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। এখনো পর্যন্ত ১৮ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে ওই এলাকায়। সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত নতুন করে কোন উত্তেজনার খবর পাওয়া যায়নি। মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ থাকার কথা মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন জায়গার পাশাপাশি মালদা ও বীরভূমের বেশ কিছু এলাকায়। পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় জারি থাকছে ১৬৩ ধারা। এখনও পর্যন্ত প্রায় ২০০ জনেরও বেশি গ্রেপ্তার বলে জানান এডিজি দক্ষিণবঙ্গ সুপ্রতিম সরকার।
সূত্রের খবর, গ্রেপ্তার হওয়াদের মধ্যে কয়েকজন আরএসএস ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিও রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, প্রশাসন দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করুক। ধুলিয়ানের বাসিন্দা সুজন রায়চৌধুরী বলেন, “এখানে এমন ছিল না। আমরা মিলেমিশে থাকি।” দোকানদার জিয়াউল হক জানান, “দোকান খুলেছি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে।” দেবাশিস দাস বলেন, “সবটাই গুজব। মানুষ এখন সচেতন।”
সব মিলিয়ে বলা যায় পরিস্থিতি স্বাভাবিকের পথে। অন্যদিকে বহিরাগত তত্ব আরও জোরালো হচ্ছে। হামলাকারীরা বাংলাদেশ থেকে এসেছিল? নাকি বিএসএফের পোশাকে সাধারণ জুতো পরা দুষ্কৃতীরা এই তান্ডব চালিয়েছে? প্রশ্ন উঠছে একাধিক। তদন্ত চালাচ্ছে প্রশাসন।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct