এখানেই জন্মেছি, বড় হয়েছি, এই গঙ্গায় সাঁতার শিখেছি, মাছ ধরেছি। এপারের মোথাবাড়ি হোক কি ওপারের ধুলিয়ান— কোনোদিন কোনও দাঙ্গা দেখিনি, হিন্দু-মুসলিমকে এক অপরের বাড়ি-ধর্মস্থান আক্রমণ করতেও না। বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা হয়েছে, গুজরাটে দাঙ্গা হয়েছে। নানা স্থানে সাম্প্রদায়িকতার আগুন জ্বলেছে, তারপরও মালদা-মুর্শিদাবাদ শান্তিপূর্ণ থেকেছে। তবে হঠাৎ এই ভ্ৰাতৃঘাতী হিংসা কেন? তা নিয়ে লিখেছেন অক্সফোর্ডের গবেষক শাহনওয়াজ আলি রায়হান।
হলুদ পাখিগুলোকে জামরুল গাছের ডালে ডাকাডাকি করতে দেখার সেই কৌতুহলী শৈশবকাল থেকেই এই এলাকাগুলোকে চিনি। হাতের তালুর মতো। এখানেই জন্মেছি, বড় হয়েছি, এই গঙ্গায় সাঁতার শিখেছি, মাছ ধরেছি। এপারের মোথাবাড়ি হোক কি ওপারের ধুলিয়ান— কোনোদিন কোনও দাঙ্গা দেখিনি, হিন্দু- মুসলিমকে এক অপরের বাড়ি - ধর্মস্থান আক্রমণ করতেও না। বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়েছে, গুজরাটে দাঙ্গা হয়েছে। সারা ভারতের নানা স্থানে সাম্প্রদায়িকতার আগুন জ্বলেছে, তারপরও মালদা-মুর্শিদাবাদ শান্তিপূর্ণ থেকেছে। কোনো আদর্শ, কোনো বিষবাষ্প, কোনো বহিরাগত শক্তি গৌড় সুলতান-মুর্শিদাবাদ নবাবদের সময় থেকে চলে আসা এইসব এলাকার সমন্বয়কামী চরিত্রকে খর্ব করতে পারেনি। আমাদের স্কুল এক, আমাদের বাজার এক, মুদির দোকান এক, হাসপতাল এক, এমনকি আল্লাহ- ঈশ্বর যে নামেই ডাকি সেই সৃষ্টিকর্তাও এক। এইসব মিলিত ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার কাঁধে বহন করেই তো আমরা জীবনপুরের পথিক হিসেবে একে অপরের পাশাপাশি হাঁটছিলাম। তবে হঠাৎ এই ভ্ৰাতৃঘাতী হিংসা কেন ? কারণ একটাই - আমাদের দু’জনের মাঝে এক তৃতীয় শক্তি ঢুকে পড়েছে। সে বহিরাগত, তার আপাদমস্তক ঘৃণার চাদরে আবৃত। এই ঘৃণার বুনিয়াদ মুসলিমবিদ্বেষ । তবে দরকাল পড়লে সেটি দলিত থেকে বাঙালি হিন্দু বিরোধী কিছু হতেই বিন্দুমাত্র সময় লাগেনা (যেমনটা দিল্লির এক মাছের বাজারে আমরা সম্প্রতি দেখলাম)।
মালদা-মুর্শিদাবাদের স্থানীয় হিন্দু-মুসলিম সবার কাছে করজোড়ে অনুরোধ আপনারা বিজেপি-আরএসএস-এর ফাঁদে পা দেবেন না। বাংলার হিন্দুত্ববাদীরা বুঝে গেছে সুষ্ঠ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তারা জীবনেও বাংলায় ক্ষমতায় আসতে পারবে না। তাই দাঙ্গাকেই নির্বাচন বৈতরণী পারের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে। তাই তাদের নেতারা বাংলার বিভিন্ন জেলায় জেলায় ঘুরে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছে। তাদেরই কিছু অনুসারী কখনো মসজিদের সামনে অভব্যতা করছে, তো কখনো ওয়াকফের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে হামলা করছে। এগুলো সবই উস্কানি। তারা আপ্রাণ চায় মুসলিমরা এইসব প্ররোচনায় পা দিক। বিজেপির আইটি সেল থেকে বিজেপির সুরে সুর মেলানো গণমাধ্যম— সবাই মনে মনে চায়ছে মুসলিমরা দাঙ্গা শুরু করুক। তাই তো এলাকার পরিস্থিতি সার্বিকভাবে শান্তিপূর্ণ থাকার পরও ফেক নিউজ, ফেক ছবি, ফেক বয়ান সব ব্যবহার করে জলঘোলার চেষ্টা করছে। এখানেই মুসলিমদের পরীক্ষা। সবর, ইলম, হিকমত সবকিছুর। বিশ্বাস করুন, এই পরীক্ষা যদি ভালভাবে পাশ করে যান, ২০২৬-এ বিজেপি কুপোকাত! এই ঘৃণা ছড়ানো টিভি চ্যানেলগুলোকে উচিত উত্তর দেওয়া হবে। তাছাড়া, মানবিক সম্পর্কের সবকিছু ভোটের অংক দিয়েও হয় না। হাদীসে এসেছে, কোনো মুসলিম দ্বারা অপর কোনো অমুসলিমের অধিকার হরণ হলে কেয়ামতের দিন রাসূল (সা.) নিজেই সেই মুসলিমের বিরুদ্ধে নির্যাতিত অমুসলিমদের পক্ষে দাঁড়াবেন । মজলুম মুসলিম বা অমুসলিম যা-ই হোক, তাঁর বদদোয়া থেকে বেঁচে থাকতে বলা হয়েছে।
আপনি হিন্দু হন, মুসলিম হন, জৈন হন, নাস্তিক হন, কংগ্রেস হন, তৃণমূল হন, বাম হন— এই সংবেদনশীল মুহূর্তে এক থাকুন। মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্য সরকার সবাই বিজেপির এই বিভেদকামী রাজনীতির বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিয়েছে। রাজ্যের পুলিশ আপ্রাণ চেষ্টা করছে দাঙ্গা এড়ানোর। সেন্ট্রাল ফোর্স আসার সুযোগ করে দেওয়া মানেই বিজেপির কোর্টে বল! নাগরিকদের মানবিক ঐক্যের সামনে বিজেপির উস্কানি, প্ররোচনা খড়কুটো বই কিছুই না। শুধু আবেগের উপর মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ লাগবে এই যা। আমাদের শৈশবের মালদা-মুর্শিদাবাদ জুড়ে ডালে ডালে ডাকুক শুধুই হলুদ পাখি, কোনো ভাঙা মন্দির বা অস্ত্র হাতে দাপাদাপির গল্প এখানে অচেনাই থাক।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct