২০২৫ সালের ২রা এপ্রিল, ভারতীয় সংসদের উভয় কক্ষে “ওয়াকফ (সংশোধন) বিল ২০২৫” গৃহীত হওয়ার পর দেশজুড়ে মুসলিম সমাজের মধ্যে এক গভীর অসন্তোষ ও আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। বহু বিশেষজ্ঞ, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ও নাগরিক সমাজ এই আইনের অসাংবিধানিক ও পক্ষপাতদুষ্ট চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। রাষ্ট্রযন্ত্র যেখানে সংবিধান অনুযায়ী ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে সকল ধর্মাবলম্বীর সমান অধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়, সেখানে এই আইন এক বিপরীত ধারা নির্মাণ করেছে। লিখেছেন পাশারুল আলম।
২০২৫ সালের ২রা এপ্রিল, ভারতীয় সংসদের উভয় কক্ষে “ওয়াকফ (সংশোধন) বিল ২০২৫” গৃহীত হওয়ার পর দেশজুড়ে মুসলিম সমাজের মধ্যে এক গভীর অসন্তোষ ও আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। বহু বিশেষজ্ঞ, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ও নাগরিক সমাজ এই আইনের অসাংবিধানিক ও পক্ষপাতদুষ্ট চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। রাষ্ট্রযন্ত্র যেখানে সংবিধান অনুযায়ী ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে সকল ধর্মাবলম্বীর সমান অধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়, সেখানে এই আইন এক বিপরীত ধারা নির্মাণ করেছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে বলেছিলেন,
“উপকার করতে গেলেই উপকার হয় না, উপকার করার অধিকার থাকা চাই; এবং যার উপকার করছ সে যদি তাতে উপকার না দেখে, তবে উপকারের দাবি থাকে না।” এই বিল পাস হওয়ার পর বেশ কিছু সংসদের মুখে জেএসআর, স্লোগান শোনার পর এ বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ থাকে না।
এই আলোকে বলা যায়, যাদের জন্য আইন রচিত, সেই সম্প্রদায় যদি তাতে উপকার না খুঁজে পায়, বরং অধিকার হরণ বলে মনে করে, তবে সেই আইন একটি প্রশ্নবিদ্ধ উদ্যোগ ছাড়া আর কিছুই নয়।
ওয়াকফ প্রথার ঐতিহ্য ও সাংবিধানিক অধিকার:
ইসলামে ‘ওয়াকফ’ একটি ধর্মীয় প্রথা যেখানে কোনো ব্যক্তি তাঁর সম্পত্তি আল্লাহর নামে সমাজকল্যাণের জন্য স্থায়ীভাবে উৎসর্গ করেন। এই দান ধর্মীয়ভাবে পবিত্র ও অপরিবর্তনীয় বলে গণ্য হয়। ভারতে এই প্রথা সংবিধানের ২৫ ও ২৬ নম্বর ধারায় গ্যারান্টি দেওয়া ধর্মীয় স্বাধীনতার অংশ। কিন্তু ২০২৫ সালের নতুন আইন সেই অধিকারকে সংকুচিত করে দিয়েছে।
হিন্দু মন্দির বনাম মুসলিম ওয়াকফ: দ্বৈত নীতির নগ্ন উদাহরণ:
ভারতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় যে দ্বৈতনীতি কার্যকর, তা স্পষ্ট হল এই আইনের দ্বারা। এই বৈষম্য ভারতীয় সংবিধানের ধারা ১৪-তে নির্ধারিত ‘সকল নাগরিকের সমান অধিকার’-এর সম্পূর্ণ পরিপন্থী। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ধর্মীয় সম্পত্তি শুধু মাত্র মুসলমানদের রয়েছে তা কিন্তু নয়। এই রকম সম্পত্তি হিন্দু মন্দিরের রয়েছে। রয়েছে খ্রিষ্টান ও শিখদের। ভারতের ওয়াকফ সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ কোনো বিশেষ মুসলিম সংগঠনের হাতে ছিলনা। এই সম্পত্তির দেখভালের দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল ওয়াকফ বোর্ডের উপরে। এই বোর্ড নিয়ন্ত্রণ ও বোর্ড মেম্বার, মিউটাওয়াল্লি নিয়োগ করতেন ভারত সরকার। তবে নিয়োগ প্রাপ্ত সকল মেম্বার চেয়ার পার্সন হতেন মুসলিম ধর্মের মানুষেরা। এখন অমুসলিম বিশেষ করে হিন্দু সমাজের মানুষ বোর্ডের সদস্য হতে পারবেন।
এই বোর্ড চালনা কিভাবে হবে তার জন্য বেশ কয়েকটি আইন তৈরি হয়েছিল যেমন, ১৯৫৪ ১৯৯৫ সালের আইন। এই আইন থাকা সত্ত্বেও ২০২৫ সালে ভারত সরকার UMEED ‘Waqf (Amendment) B।ll, 2025’ এর সম্পূর্ণ নাম হল ‘Un।f।ed Waqf Management, Empowerment, Eff।c।ency, and Development Act, 2025’ এই বার আমরা পূর্ববর্তী ও বর্তমান আইন: তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই-
ওয়াকফ অ্যাক্ট ১৯৯৫:
ওয়াকফ বোর্ড ছিল স্বশাসিত সংস্থা। মিউটাওয়াল্লি নিযুক্ত হতেন বোর্ড কর্তৃক। ওয়াকফ ট্রাইব্যুনাল ছিল নিরপেক্ষ বিচারপ্রক্রিয়া। দেওয়ানি আদালতে আপিলের সুযোগ ছিল। এই বোর্ডে অমুসলিমরা প্রতিনিধিত্ব করতেন না। যদিও বোর্ডকে পক্ষান্তরে বিভিন্ন রাজ্য সরকার পরিচালনা করতেন। এক্ষেত্রে বলা ভাল যে, আজ বিজেপি সরকার বলছে ওয়াকফ বোর্ডে দুর্নীতি হচ্ছিল, তা প্রতিরোধ করার জন্য এই বিল। তাই যদি হয় তাহলে এই দায় তো সমগ্র মুসলিম সমাজের নয়, এই দায়তো সরকারকে নিতে হবে। কেননা, বোর্ড তো পরিচালিত হত সরকারের দ্বারা, সরকারের মনোনীত প্রতিনিধি দ্বারা। তাহলে কি তারা দুর্নীতিগ্রস্থ মানুষদের প্রতিনিধি করে পাঠাত। এই বিজেপি সরকার তো কেন্দ্রে এগারো বছর ধরে সরকারে আছে, আবার একাধিক রাজ্যে ক্ষমতা ভোগ করে। তারা কেন ওয়াকফ বোর্ডকে দুর্নীতি মুক্ত করতে পারেনি। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ওয়াকফ সম্পত্তি দখল হয়েছে। কে করেছে এই জোর দখল ?
প্রথমেই নাম আসবে সরকারের। সরকার তাদের প্রয়োজনে ওয়াকফ সম্পত্তির দখল নিয়েছে আর সমাজের মুসলিম, অমুসলিম প্রভাবশালী ও বাহুবলী ব্যক্তিরা। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ পুরোনো আইনে ছিল। জামিন অযোগ্য ধারা ছিল, ছয় বছর সাজার ব্যবস্থা ছিল। তা কেন কার্যকরী হয়নি। এর জবাবদিহিতা কেন্দ্র ও রাজ্যে সরকার অস্বীকার করতে পারেনা। যেখানে ওয়াকফ বোর্ডের হিসাব পরীক্ষা করতেন ক্যাগ সেখানে সরকার দুর্নীতির ব্যবস্থা কেন নিতে পারেনি? মাননীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী লোকসভায় বললেন, ২০১৩ সালের সংশোধনী ফলে ১২৩ সম্পত্তি ওয়াকফ বোর্ডকে ফেরত দেওয়া হয়েছে কিন্তু ভিতরের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করলেন না। ২০১৩ সালের সংশোধনীর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক ছিলনা। যে সমস্ত মসজিদ, মজার ও দরগায় ভুল করে সরকার অধিগ্রহন করেছিল সেই সমস্ত ছোট ছোট মোট ১২৩ টি সম্পত্তি ফেরত দেওয়া হয়েছিল। আইনে উপায়ে অতি অল্প টাকার বিনিময়ে ওয়াকফ বোর্ডের জমি পুনরায় ফেরত দেওয়ার হয়।
পুরোনো আইনে ওয়াকফ বোর্ড ও ট্রাইব্যুনালের ক্ষমতা ছিল বিচার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করার ও শাস্তি প্রণয়ন করার। এই ট্রাইব্যুনালের দায়িত্বে থাকতেন একজন বিচারক। তিনি ভারতীয় বিচার প্রক্রিয়া ও আইনের দ্বারা বিচার করতেন। কারো প্রভাবে বিশেষ করে কোনো ব্যক্তি বা সরকারের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার সম্ভবনা ছিল খুবই কম।
সংশোধিত আইন ২০২৪:
জেলা শাসক মিউটাওয়াল্লি নিযুক্ত করবেন। কাকে করবেন তার পূর্ণ অধিকার তার হাতে ন্যস্ত থাকবে।
এই আইন তিনিই বিচারপতি, তিনিই প্রশাসক, তিনিই মিউটাওয়াল্লি নিয়োগ কর্তা।
ট্রাইব্যুনালের স্বাধীনতা বিলুপ্ত:
মুসলিম সমাজের নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা হরণ করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের প্রধান হিসাবে থাকবেন জেলা শাসক। এই ব্যবস্থায় আমরা ফিরে যাচ্ছি একধরনের ‘নব্য জমিদারি শাসন’-এ, যেখানে প্রশাসনের হাতে জমি, বিচার এবং কর্তৃত্ব—সবকিছু কেন্দ্রীভূত। তার কাছে মামলা বা আবেদন করা যাবে তিনি বিবাদী বা বাদী তিনিই বিচারক। এছাড়া নতুন এই আইন কতকগুলি বিষয় এমনভাবে নিয়ে আসা হয়েছে যা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। তা হল কোনো অমুসলিম হিন্দু ব্যক্তি ওয়াকফ বোর্ডে জমি দান করতে পারবে না। একইভাবে কোনো অমুসলিম ব্যক্তি যদি ধর্ম পরিবর্তন করে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে তাহলে সেই ব্যক্তি তার কোনো সম্পত্তি পাঁচ বছর ওয়াকফ করতে পারবে না। পূর্ববর্তী আইনে যদি ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে কোনো অপরাধ প্রমাণিত হত, তাহলে জামিন অযোগ্য ধারা লাগু হত এবং তাতে ছয় বছর সাজার ব্যবস্থা ছিল। নতুন আইনে জামিন যোগ্য ধারা লাগু হবে এবং সাজা ছয় বছর থেকে কমিয়ে ছয় মাস করা হয়েছে। উপভোক্তার ক্ষেত্রেও এই আইন পরিবর্তন করা হয়েছে। পূর্বে মৌখিক ওয়াকফ করার নিয়ম ছিল কিন্তু এখন রেজিস্ট্রি করতে হবে। হাজার বছরের পুরোনো দলিল খুঁজে বের করতে বললে অনেক বোর্ডেই তা দিতে পারবে না। যদিও পুরোনো সম্পত্তি বিষয়ে শিথিল করা হবে বলে জানানো হয়েছে। আইনের রুলস্ তৈরি হলে তা স্পস্ট হবে।
এই আইনের সমস্যা:-
এই আইন ধর্মীয় স্বাধীনতা হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। আমাদের দেশে একাধিক ধর্ম রয়েছে এবং তাদের ধর্মীয় সম্পত্তি রয়েছে। হিন্দু মন্দির বনাম মুসলিম ওয়াকফ বিষয়ে দ্বৈত নীতির নগ্ন উদাহরণ এই আইন। ভারতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় যে দ্বৈতনীতি কার্যকর, তা স্পষ্ট হবে এই তুলনায়:
হিন্দু মন্দির সম্পত্তির দেখাশোনা মন্দির ট্রাস্ট বা ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ করবেন। অন্যদিকে ওয়াকফ বোর্ড, এখন জেলা শাসকের হস্তক্ষেপে পরিচালিত হবে।
হিন্দু মন্দির সরকারের হস্তক্ষেপ সীমিত বা আদালত নির্দেশিত পথে চলবে। আবার ওয়াকফ সম্পত্তিতে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে প্রবল হস্তক্ষেপ। কেননা, জেলা শাসক সরকারের একজন নিয়োজিত প্রশাসক। সরকারের নীতি, উদ্দেশ্য ও নির্দেশ গুলি কার্যকরী করায় তার কাজ। হিন্দু মন্দির সম্পত্তির মালিকানা ও বিক্রয় ট্রাস্ট দ্বারা নির্ধারিত হয়। এদিকে ওয়াকফ সম্পত্তি সরকারের অনুমতি ছাড়া স্থানান্তর বা বিক্রয় নিষিদ্ধ। হিন্দু মন্দিরের বিরোধ নিষ্পত্তি দেওয়ানি আদালত ঠিক করবেন। ওয়াকফ সম্পত্তিতে জেলা শাসকই তদন্তকারী ও বিচারক। হিন্দু মন্দিরের ট্রাস্ট বা কমিটিতে মুসলমানরা থাকতে পারবেন না কিন্তু ওয়াকফ বোর্ডে হিন্দু সদস্য থাকবেন। হিন্দু মন্দিরে মুসলমান জমি বা সম্পত্তি দান করতে পারবেন কিন্তু কোনো হিন্দু ওয়াকফ বোর্ডে সম্পত্তি দান করতে পারবেন না। এই বৈষম্য ভারতীয় সংবিধানের ধারা ১৪-তে নির্ধারিত ‘সকল নাগরিকের সমান অধিকার’-এর সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ: প্রস্তাবযোগ্য সাংবিধানিক পয়েন্ট
ক. ধারা ২৫ ও ২৬ লঙ্ঘন:
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্বাধীন ব্যবস্থাপনার অধিকার খর্ব করা হয়েছে। ভারতের সংবিধানের ধারা ২৫ ও ২৬ নাগরিকদের ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব ব্যবস্থাপনা, ধর্মীয় কার্যাবলি পরিচালনা ও সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের অধিকার নিশ্চিত করে। তবে ২০২৫ সালের ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল এই সংবিধানিক অধিকারগুলোর পরিপন্থী বলে বহু বিশেষজ্ঞ মনে করেন।
১. ওয়াকফ বিলের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডগুলিকে অতিরিক্ত প্রশাসনিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
২. এই অতিরিক্ত ক্ষমতার ফলে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে।
৩. সংবিধানের ধারা ২৬ অনুযায়ী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্বশাসিত হওয়ার অধিকার রাখে, কিন্তু ওয়াকফ বোর্ডের হস্তক্ষেপে তা লঙ্ঘিত হচ্ছে।
৪. বোর্ডের অনুমতি ছাড়া কোনো সম্পত্তি ব্যবস্থাপনায় বাধা দেওয়া হচ্ছে।
৫. স্থানীয় মুসলিম সমাজের অংশগ্রহণ সীমিত করা হয়েছে।
৬. মসজিদ, মাদ্রাসা ও দরগাহ পরিচালনায় সম্প্রদায়ের সিদ্ধান্ত নয়, বরং সরকারি নির্দেশিকা প্রাধান্য পাচ্ছে।
৭. ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সংবিধান যেখানে ‘স্বাধীন অনুশীলন’-এর কথা বলে (ধারা ২৫), সেখানে ওয়াকফ বিল তা খর্ব করছে।
৮. ধর্মীয় উদ্দেশ্যে প্রস্তাবিত সম্পত্তি ও ব্যবস্থাপনায় সরকারের হস্তক্ষেপ বেড়েছে।
৯. ওয়াকফ বোর্ডের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ সীমিত করা হয়েছে।
১০. বোর্ডের সদস্য নিয়োগে স্বচ্ছতার অভাব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আত্মনিয়ন্ত্রণের পরিপন্থী।
১১. ধর্মীয় নেতাদের পরিবর্তে সরকারি কর্মকর্তাদের কর্তৃত্ব বেড়েছে।
১২. স্থানীয় ধর্মীয় ঐতিহ্য উপেক্ষিত হচ্ছে।
১৩. ওয়াকফ সম্পত্তি চিহ্নিতকরণে সম্প্রদায়ের মতামতের গুরুত্ব কমে গেছে।
১৪. আদালতে আপিলের সুযোগ জটিল ও সীমিত।
১৫. সাধারণ মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব কম।
১৬. সরকারি অনুমোদন ছাড়া ধর্মীয় সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
১৭. সংবিধানিক অধিকার থাকা সত্ত্বেও স্বতন্ত্র ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ দুর্বল হয়েছে।
১৮. ধর্মীয় উদ্দেশ্যে দানকৃত সম্পত্তির উপর সরকারি কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।
১৯. এটি মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের দিকে ইঙ্গিত করে।
২০. ফলে সংবিধানের ধারা ২৫ ও ২৬ অনুযায়ী ধর্মীয় স্বাধীনতা ও স্বশাসনের অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে।
খ. ধারা ১৪ লঙ্ঘন: এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে অন্যের তুলনায় বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে।
ভারতের সংবিধানের ধারা ১৪ সকল নাগরিককে আইনের দৃষ্টিতে সমতা ও সমান সুরক্ষা প্রদানের নিশ্চয়তা দেয়। তবে ওয়াকফ আইন অনুযায়ী শুধুমাত্র মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও দাতব্য সম্পত্তিকে আইনি স্বীকৃতি ও প্রশাসনিক সুবিধা প্রদান করা হয়েছে, যা অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য প্রযোজ্য নয়। হিন্দু, খ্রিস্টান, শিখ বা অন্যান্য সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সম্পত্তির জন্য সমান স্তরের স্বয়ংশাসিত প্রতিষ্ঠান বা আইনগত সুরক্ষা নেই। ওয়াকফ বোর্ডের মতো সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান কেবলমাত্র একটি সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষা করে। এর ফলে রাষ্ট্র এক সম্প্রদায়কে বিশেষ সুবিধা প্রদান করছে এবং অন্যদের সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত করছে। এই অসম আচরণ ধারা ১৪-র ‘সমানতা নীতি’-কে লঙ্ঘন করে। রাষ্ট্রের পক্ষপাতমূলক ভূমিকা আইনি সমতার পরিপন্থী। ধর্মীয় নিরপেক্ষতার নীতির সঙ্গে এই আইন অসঙ্গতিপূর্ণ। অতএব, ওয়াকফ আইন কার্যত ধারা ১৪ লঙ্ঘন করে।
গ. ধারা ২১ লঙ্ঘন: জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অন্তর্গত ধর্মীয় এবং সম্পত্তির স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হয়েছে।
ভারতের সংবিধানের ২১ ধারা অনুযায়ী, “প্রত্যেক ব্যক্তিকে জীবনের ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকার সংরক্ষিত থাকবে, তবে আইনের দ্বারা স্থাপিত প্রক্রিয়া অনুযায়ী ব্যতীত নয়”। এই ধারার অন্তর্গত রয়েছে ধর্মীয় স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত সম্পত্তির স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার। ভারতের ওয়াকফ আইন অনুযায়ী, মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সম্পত্তি ‘ওয়াকফ বোর্ড’-এর অধীনে চলে যায়। এতে ব্যক্তি তার নিজের ধর্মীয় বা পারিবারিক সম্পত্তির ওপর পূর্ণ অধিকার হারাতে পারে। অনেক সময় এই সম্পত্তিগুলো মালিকের সম্মতি ছাড়া বা ব্যক্তিগত অধিকার অস্বীকার করে রাজ্য কর্তৃক অধিগ্রহণ করা হয়। এতে ব্যক্তি-স্বাধীনতা এবং ধর্মপালনের অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জমি হস্তান্তর বা ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে ধর্মীয় অনুভূতির অবজ্ঞা করা হয়। এছাড়া, ওয়াকফ বোর্ডের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধিতা করে। বিচারব্যবস্থায় প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ সীমিত থাকায় ২১ ধারা কার্যকর হয় না। এইভাবে ওয়াকফ আইনের প্রয়োগ ব্যক্তি-স্বাধীনতা, ধর্মপালন ও সম্পত্তির অধিকারকে খর্ব করে ২১ ধারার লঙ্ঘন ঘটাতে পারে।
ঘ. ন্যায়বিচারপ্রাপ্তির অধিকার: প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার বিভাজন বিলুপ্ত, যা ভারতীয় গণতন্ত্রের মৌলিক ভিত্তির বিরুদ্ধে। ন্যায়বিচারপ্রাপ্তির অধিকার ও ২০২৫ সালের ওয়াকফ বিল: একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা
২০২৫ সালের ওয়াকফ বিলটি একটি বিতর্কিত প্রস্তাব, যার মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পর্কিত বিষয়াবলী নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে আদালতের হস্তক্ষেপ সীমিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বিলটি ওয়াকফ সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির অধিকাংশ ক্ষমতা প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ তথা ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালের হাতে অর্পণ করে, এবং উচ্চতর বিচারিক পুনর্বিবেচনার সুযোগ কমিয়ে দেয়।
এই বিলের মাধ্যমে প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার মধ্যকার সাংবিধানিক বিভাজন হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ভারতীয় সংবিধানের ৫০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে পৃথকীকরণ গণতন্ত্রের মৌলিক ভিত্তি। কিন্তু এই বিল বিচার বিভাগের স্বতন্ত্রতার পরিপন্থী বলে বহু আইনজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মী উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
এতে ন্যায়বিচারপ্রাপ্তির অধিকার (Art।cle 14 ও Art।cle 21) খর্ব হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, কারণ ব্যক্তিরা যথাযথ বিচারিক পুনর্বিবেচনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। ফলে, এটি ভারতীয় গণতন্ত্রে মৌলিক অধিকার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে একটি পদক্ষেপ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
ঙ. স্বশাসনবিরোধী হস্তক্ষেপ: একটি ধর্মীয় কমিউনিটির স্বতন্ত্র ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে। ২০২৫ সালের ওয়াকফ বিল ও স্বশাসন বিরোধী হস্তক্ষেপ ২০২৫ সালের সংশোধিত ওয়াকফ বিল ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বশাসনের অধিকারকে খর্ব করেছে বলে বহু পর্যবেক্ষকের অভিমত। বিলটির মাধ্যমে সরকার ওয়াকফ বোর্ডের ওপর প্রশাসনিক ও আর্থিক নিয়ন্ত্রণ জোরদার করেছে, যার ফলে সংশ্লিষ্ট ধর্মীয় কমিউনিটির নিজস্ব ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে। বিশেষ করে ওয়াকফ সম্পত্তি ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের ভূমিকা সীমিত করে দিয়ে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি সংবিধানের সংখ্যালঘুদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় স্বায়ত্তশাসনের অধিকার (ধারা ২৬ ও ২৯) লঙ্ঘনের আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। তাই সংখ্যালঘু সংগঠন ও নাগরিক সমাজ এই বিলকে স্বশাসনবিরোধী ও সম্প্রদায়ের ওপর রাষ্ট্রীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার একটি পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে।
উপসংহার
ওয়াকফ আইন ২০২৫ শুধু একটি প্রশাসনিক পরিবর্তন নয়, বরং ভারতীয় সংবিধান, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনায় এক গভীর আঘাত। এটি মুসলিম সমাজের প্রতি রাষ্ট্রের একতরফা নির্দেশ চাপিয়ে দেওয়ার একটি দৃষ্টান্ত। আজ প্রয়োজন সংলাপ, সহমর্মিতা ও বাস্তবধর্মী পুনর্মূল্যায়ন। এই আইনটি সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করে সংবিধানের মূলনীতিকে পুনরুদ্ধার করাই হবে সমাজের সকল ন্যায়নিষ্ঠ নাগরিকের কর্তব্য। একই সংগে গণতান্ত্রিক উপায়ে বৃহত্তর গণ আন্দোলন সংগঠিত করতে হবে। যেখানে বিভিন্ন ধর্মের সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি ভারতবর্ষে ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ, দলিত, আদিবাসী সমাজের মানুষ সম্মিলিতভাবে আওয়াজ তুলতে হবে সরকারকে এই বৈষম্যমূলক আইন প্রত্যাহার করতে হবে।
**মতামত লেখকের নিজস্ব
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct