আপনজন ডেস্ক: উত্থান ও পুনরুত্থান—চ্যাম্পিয়নস লিগের এবারের আসরকে বোধ হয় এই দুটি শব্দ দিয়েই সবচেয়ে ভালো বোঝা যাবে। নাহ্, চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালের লাইনআপ এখনো নিশ্চিত হয়নি। দ্বিতীয় লেগ শেষে বদলে যেতে পারে অনেক সমীকরণও। কিন্তু প্রথম লেগের পর যে চারটি দল সেমিফাইনালের পথে এগিয়ে গেছে, এর মধ্যে দুটি দলের জন্য চ্যাম্পিয়নস লিগ সাফল্য এখনো ‘সোনার হরিণ’, কখনোই তারা চ্যাম্পিয়নস লিগের রুপালি ট্রফিটা উঁচিয়ে ধরতে পারেনি। অন্য দুই দলের এ অভিজ্ঞতা থাকলেও সর্বশেষ চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের স্মৃতিতে ধুলা জমতে শুরু করেছে আরও অনেক আগে থেকে। চ্যাম্পিয়নস লিগে শেষ আটের লাইনআপ ঠিক হওয়ার পরই মিলেছিল উত্তেজনার আভাস। প্রথম লেগ শেষে যদিও উত্তেজনার চেয়ে একপেশে লড়াইটাই বেশি চোখে পড়েছে।
প্রথম লেগ জিতে এরই মধ্যে এগিয়ে গেছে বার্সেলোনা, আর্সেনাল, পিএসজি ও ইন্টার মিলান। এর মধ্যে ইন্টার ছাড়া বাকিদের দাপট ছিল নিরঙ্কুশ। অতিনাটকীয় কিছু না ঘটলে এই তিন দলের সেমিতে যাওয়া অনেকটাই নিশ্চিত। পিএসজি আর আর্সেনালের কথা ভেবে অনেকেই আবার চ্যাম্পিয়নস লিগে নতুনের জয়গান শুনতে পাচ্ছেন।
আর্সেনাল ও পিএসজি কখনোই চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের স্বাদ পায়নি। অন্য দুই দলের মধ্যে কাছাকাছি সময়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের অভিজ্ঞতা আছে বার্সেলোনার। সেটাও ২০১৪–১৫ মৌসুমে। অর্থাৎ এক দশক ধরে ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের ট্রফির স্বাদ পায়নি কাতালান ক্লাবটি।
বার্সাকে সেবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের স্বাদ এনে দিয়েছিলেন লিওনেল মেসি–নেইমার–লুইস সুয়ারেজরা। এরপরই শুরু হয় দলটির আশ্চর্যপতন। বিশেষ করে সর্বশেষ তিন মৌসুম ছিল ভুলে যাওয়ার মতোই। এই তিন আসরের প্রতিটিতে বার্সা বিদায় নিয়েছে গ্রুপ পর্ব থেকে। সেই বার্সা অবশ্য হ্যান্সি ফ্লিকের জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় এখন অনেকটাই বদলে গেছে। মেসি–সুয়ারেজ–নেইমারের বিকল্প হিসেবে বার্সা পেয়ে গেছে রবাট লেভানডফস্কি–লামিনে ইয়ামাল–রাফিনিয়া ত্রয়ী। যাঁরা এখন বার্সাকে ইউরোপে রাজত্ব পুনরুদ্ধারের স্বপ্নও দেখাচ্ছেন। বদলে যাওয়া বার্সা শেষ আটের প্রথম লেগে বরুসিয়া ডর্টমুন্ডকে উড়িয়ে দিয়েছে ৪–০ গোলে। শুধু জয়ের ব্যবধানেই নয়, খেলার মানের দিক থেকেও প্রতিপক্ষের চেয়ে যোজন দূরত্ব এগিয়ে ছিল দলটি। রক্ষণ থেকে আক্রমণভাগ, প্রতিটি পজিশনে মুগ্ধতা জাগানো ফুটবল উপহার দিচ্ছে তারা। তবে আলাদা করে বলতে হয় আক্রমণভাগের ত্রয়ীর কথা। ইয়ামাল, রাফিনিয়া, লেভারা যেকোনো পরিস্থিতিতে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছেন। প্রতিপক্ষকে কোনো সুযোগই দিচ্ছেন না তাঁরা। আর দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর পর বার্সাকে নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন দলটির সমর্থকেরাও। সব মিলিয়ে এক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগের মুকুট মাথায় পরার স্বপ্নে বিভোর বার্সা।
অপেক্ষা শুধু ছন্দ ধরে রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়ার।
ইন্টার মিলানের ট্রফি ক্যাবিনেটে ধুলা জমতে থাকার গল্পটা আরও পুরোনো। ২০০৯–১০ মৌসুমে জোসে মরিনিওর উন্মাতাল উদ্যাপনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিরোপা উৎসব করেছিল ইন্টার। এর পর থেকেই ইন্টারের ট্রফি ক্যাবিনেটে চ্যাম্পিয়নস লিগের কোনো আলো নেই। ২০২২–২৩ মৌসুমে ফাইনালে উঠলেও ম্যানচেস্টার সিটির কাছে ১–০ গোলে হেরে শেষ পর্যন্ত শিরোপাবঞ্চিত থাকতে হয় দলটিকে।
এবার ইন্টারের সামনে সুযোগ এসেছে শিরোপা পুনরুদ্ধারের। লাওতারো মার্তিনেজ-মার্কোস থুরামরাও আছেন দারুণ ছন্দে। এরই মধ্যে বায়ার্ন মিউনিখকে প্রথম লেগে তাদের মাঠে ২–১ গোলে হারিয়ে সেমিফাইনালের পথে এক ধাপ এগিয়ে গেছে সিরি আর শীর্ষে থাকা দলটি। এখন পরের ম্যাচগুলোতে ছন্দ ধরে রাখার অপেক্ষা।
আর্সেনালের জন্য চ্যাম্পিয়নস লিগ তিক্ত এক অভিজ্ঞতার নাম। ইউরোপিয়ান ফুটবলে অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে পরিচিত দলটি এখন পর্যন্ত ফাইনালই খেলেছে একবার। এমনকি ধুলা জমার মতো কোনো ট্রফিও নেই তাদের ক্যাবিনেটে।
২০০৫–০৬ মৌসুমে আর্সেন ওয়েঙ্গারের অধীনে ফাইনালে উঠলেও শিরোপাটা শেষ পর্যন্ত অধরাই থেকে যায়। অবিশ্বাস্য ছন্দে থাকা আর্সেনালকে ফাইনালে ২–১ গোলে হারিয়ে দিয়েছিল বার্সেলোনা। সেই হারের ক্ষত প্রায় দুই দশক ধরে পুষে রেখেছে ‘গানার’রা। এর মধ্যে শিরোপা জয় দূরে থাক, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা নিয়েই বরং বেশি ভাবতে হয়েছিল লন্ডনের ক্লাবটিকে। তবে এই মৌসুমের আর্সেনাল একেবারেই অন্য রকম।
শেষ আটের প্রথম লেগে ইউরোপের রাজা রিয়াল মাদ্রিদকেই আর্সেনাল উড়িয়ে দিয়েছে ৩–০ গোলে। দলটা রিয়াল বলেই এখনো অনেকে ‘যদি’ আর ‘কিন্তু’ রেখে কথা বলছেন, নয়তো আর্সেনালের সেমিফাইনাল তো একপ্রকার নিশ্চিতই।
সাম্প্রতিক ছন্দ ধরে রাখতে পারলে অবশ্য রিয়ালকে তাদের মাঠে ঠেকিয়ে রাখা কঠিন কিছু নয়। আর রিয়াল–বাধা টপকাতে পারলে টগবগে আত্মবিশ্বাস নিয়েই শেষ চারের লড়াইয়ে নামবে মিকেল আরতেতার দল। যে আত্মবিশ্বাস তাদের নিয়ে যেতে পারে শিরোপার দুয়ারে।
সেমিফাইনালে যাওয়ার পথে এগিয়ে থাকা সর্বশেষ দল পিএসজি। সম্ভবত গত দেড় দশক ধরে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার জন্য সবচেয়ে বেশি চেষ্টা করেছে প্যারিসের এই ক্লাবটি। কিন্তু মেসি, নেইমার, এমবাপ্পেদের সঙ্গে নিয়েও বারবার ব্যর্থ হয়েছে পিএসজি।
অর্থ এবং বড় নাম যে সাফল্য এনে দিতে পারে না, তার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্তও বোধ হয় পিএসজি। অথচ বড় বড় নামগুলোর বিদায়ের পরই কীভাবে যেন বদলে গেল তারা। ২০২০ সালে অবশ্য পিএসজি চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল খেলে বায়ার্নের কাছে হেরেছিল।
কিন্তু এবারের দলটি একেবারেই ভিন্ন। এবার নামের ভারে নুয়ে পড়ছে না ক্লাবটি। লুইস এনরিকের অধীনে মাঠে রীতিমতো ছবির মতো সুন্দর ফুটবল খেলছে তারা। দলীয় সমন্বয়ের সঙ্গে উসমান দেম্বেলে–খিচা কাভারাস্কাইয়াদের মতো তারকাদের ব্যক্তিগত প্রদর্শনীও পিএসজির খেলায় যোগ করেছে বাড়তি ‘এক্স–ফ্যাক্টর’।
লিভারপুলের মতো দুর্দান্ত ছন্দে থাকা দলও পিএসজির সামনে খেই হারিয়েছে। শেষ আটের প্রথম লেগে অ্যাস্টন ভিলাকে ৩–১ গোলে হারিয়ে শেষ চারের পথ অনেকটাই পরিষ্কার করে রেখেছে তারা। ভারমুক্ত পিএসজি ছন্দ ধরে রেখে শিরোপা জিততে পারে কি না, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা।
আর্সেনাল ও পিএসজির জন্য অবশ্য আরও একটি প্রেরণা আছে। মিউনিখে যতবার চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল হয়েছে, ততবারই নতুন কোনো ক্লাব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
১৯৭৯ সালে নটিংহাম ফরেস্ট, ১৯৯৩ সালে অলিম্পিক মার্শেই, ১৯৯৭ সালে বরুশিয়া ডর্টমুন্ড আর সর্বশেষ ২০১২ সালে চেলসি মিউনিখে ফাইনাল খেলে শিরোপা জেতে। এবার কি তাহলে পিএসজি বা আর্সেনালের পালা, ইউরোপে হবে নতুন রাজার উত্থান?
কেউ আরেকটি প্রশ্নও করতে পারেন—পিএসজি বা আর্সেনাল প্রথমবারের মতো শিরোপা জিতবে নাকি বার্সা অথবা ইন্টারের পুনরুত্থান ঘটবে?
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct